আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সংলাপ: আদিবাসী নারী কমিশন গঠন ও জেন্ডারভিত্তিক বাজেট দাবি

0
634

হিল ভয়েস, ২৩ জুন ২০২১, ঢাকা: ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের উদ্যোগে কাপেং ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় “কোভিডকালীন আদিবাসী নারীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি” বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সংলাপে নেতৃবৃন্দ আদিবাসী নারী কমিশন গঠন ও জেন্ডারভিত্তিক জাতীয় বাজেট প্রণয়নের জোর দাবি জানিয়েছেন।

গতকাল ২২ জুন ২০২১ ঢাকার আসাদ এভিনিউতে অবস্থিত সিবিসিবি সেন্টারে এই জাতীয় সংলাপ আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরার সঞ্চালনায় এবং নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস এর আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা, সংসদ সদস্য ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এর সাবেক সদস্য আরোমা দত্ত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এর সদস্য ড. নমিতা হালদার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, টিআইবি ট্্র্র্রাস্টি বোর্ড এর সদস্য এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ্যাডভোকেসি বিভাগের পরিচালক জনা গোস্বামী এবং দ্য ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদক জাইমা ইসলাম প্রমুখ।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য হেলেনা তালাং তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে করোনার সময়ে আদিবাসী নারীর মানবাধিকারের ভয়াবহ চিত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই সময়ে মানুষ যেখানে শুধু করোনার সাথে যুদ্ধ করছে টিকে থাকার জন্য, সেখানে আদিবাসী নারী করোনার সাথে সাথে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা (ধর্ষণ, হত্যা) এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথে প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করছে। নারীদের সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ ভূমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলোই দায়ী।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে বিশেষ করে মূলস্রোতধারার নারী সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার জন্য আহ্বান জানান।

এরপর বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য মিতা হাজং মূল প্রবন্ধ পাঠ করে জাতীয় সংসদে আদিবাসী নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, জাতীয় নীতিমালাসহ অন্যান্য নীতিমালা গ্রহণের সময় নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ইত্যাদি সুপারিশ পেশ করেন ।

সংসদ সদস্য ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য এরোমা দত্ত বলেন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ করে সমতলের আদিবাসীরা অনেক অবদান রেখেছেন। আদিবাসীদের কথা তুলে ধরার জন্য প্রশাসনে আদিবাসী নারীদের থাকা অনেক জরুরি। আজকের সংলাপের উপর ভিত্তি করে আদিবাসী নারীদের জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরী ও বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন বিষয়ক নীতিপ্রণেতা, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জমা দেয়ার পরামর্শ দেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এর সদস্য ড. নমিতা হালদার বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর প্রতি পরামর্শ দিয়ে বলেন, যদি সম্ভব হয় তাহলে বিআইডব্লিউএন এর অঞ্চলভিত্তিক শাখা গঠন করে ভিকটিমকে সহায়তা দেয়াসহ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এর সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আদিবাসী নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। সে কারণে, আদিবাসীদের উপর নারীর সহিংসতা হ্রাস করার পদক্ষেপ হিসেবে পার্শ্ববর্তী ভারতের নর্থ ইস্ট-এ সরকার আদিবাসীদের জন্য যেমন আদিবাসী নারী কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে, বাংলাদেশ সরকারও আদিবাসী নারী কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। শুধু তাই না, আদিবাসী নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আনয়নে বৃহত্তর সমাজের নীতিপ্রণেতা, মূলস্রোতধারার নারী সংগঠনের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ্যাডভোকেসী পরিচালক জনা গোস্বামী বলেন, আদিবাসী নারীদের মানবাধিকার অবস্থা দেশের জন্য লজ্জাজনক। অথচ প্রত্যেক আন্দোলনে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা ছিল। টংক আন্দোলনে রাশিমনি, মুক্তিযুদ্ধে কাকন বিবিসহ অনেক আদিবাসী নারীর ভূমিকা ছিল। তাদের অবদানগুলো মূলধারার জাতিগোষ্ঠীসহ সকলকে জানতে এবং জানাতে হবে। প্রান্তিক আদিবাসী নারীরা প্রান্তিকতার কারণে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শেষে তিনি জেন্ডারভিত্তিক বাজেট ছাড়া আদিবাসী নারী উন্নয়নে কাজ করাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, দুর্গম পাহাড়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে কিনা তা দৃষ্টি দেয়া খুব জরুরী।

দ্য ডেইলী স্টার এর নিজস্ব প্রতিবেদক জাইমা ইসলাম বলেন, সিস্টেম্যাটিক ডিসক্রিমিনেশন এর কারণে আদিবাসী নারীরা প্রাধান্য পায় না। বাঙালি নারী বিচার পাওয়ার কারণ তাদের জাতিসত্তা। মিডিয়ার সচেতনতার অভাবে আদিবাসী নারীরা কভারেজ পায় না এবং গণমাধ্যমে আদিবাসী নারীদের ভিসিভিলিটি কম। সেই সাথে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের সময় বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন। ভিকটিমকে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়াসহ আপোষ করতে বাধ্য করা এবং বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বৈরিতা।

কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার উজ্জ্বল আজিম বলেন, যুব সমাজের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ অধিকার আদায়ে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়তে হবে।

উন্মুক্ত আলোচনায় উত্তরবঙ্গ থেকে আদিবাসী নারী পরিষদের সদস্য রাণী হাসদা সেখানকার আদিবাসী নারীদের প্রতি মজুরী বৈষম্য, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন সহিংসতা তুলে ধরেন। তিনি সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ স্বাস্থ্য খাত নিশ্চিতকরণ এবং কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ জানান।

নারী প্রগতি সংঘের ডেপুটি ডিরেক্টর শাহনাজ সুমি আদিবাসী নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা এবং আদিবাসী নারী আন্দোলনকে মূলস্রোতধারার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার জোর আবেদন জানান।

সমাপনী বক্তব্যে চঞ্চনা চাকমা আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সকলের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, দুনীতি, ভুমি দখল, ধর্মান্তর, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আদিবাসীদের নারীদের অবস্থা শোচনীয়। তিনি কোচ আদিবাসী নারী ধর্ষণ এর ঘটনায় দুই আসামী গ্রেফতার হলেও সুস্থ বিচার পাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। শেষে আদিবাসী নারীদেরকে বিভিন্ন উন্নয়নে সম্পৃক্ত করণ, আদিবাসী বান্ধব নারী উন্নয়ন নীতি করা এবং সরকার স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতিকরণ সরকারিভাবে অনুসরণ করার জোর আবেদন জানান।