আগামীকাল পিসিপি’র ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

0
564

হিল ভয়েস, ১৯ মে ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: ১৯৮৯ সালের ৪ মে সংঘটিত লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ৩৩ বছরে পর্দাপণ করেছে। ’৮৯ হতে ২০২২ সাল সুদীর্ঘ তিন দশকের অধিক সময় ধরে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি, জেল, জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও  বঞ্চনার স্টিমরোলার উপেক্ষা করে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পূর্ণ করেছে গৌরব ও সংগ্রামের তেত্রিশটি বছর।

৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ২৬তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উপলক্ষ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ আগামীকাল ২০ মে শুক্রবার রাঙ্গামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে সকাল ৯:৩০ টায় উদ্বোধন এবং সকাল ১০:০০ টায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য সভায় উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। পরদিন ২১ মে শনিবার রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমীতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দিনব্যাপী প্রতিনিধি সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে।

৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ২৬তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উপলক্ষ্যে পিসিপি পোষ্টার, বিৃবতি, পিসিপি’র মুখপত্র ‘কেওক্রডং’ প্রকাশ করেছে। পিসিপি’র এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়: “আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদারকরণে ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হউন”।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭৫ সালের পর তৎকালীন পাহাড়ি ছাত্র সমিতির সদস্যবৃন্দসহ অধিকাংশ দেশপ্রেমিক জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করা এবং এ লক্ষ্যে জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজকে সংগঠিত করার প্রক্রিয়া ছিল না বললেই চলে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর অব্যাহত গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্বিচারে ধর-পাকড় ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার এবং সশস্ত্র আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে জুম্ম ছাত্র সমাজের দেশপ্রেমিক অংশের মধ্যেও সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা-চরিত্র হতে থাকে।

কিন্তু জুম্ম ছাত্র সমাজের সেই চেষ্টা-চরিত্র ও চিন্তা-ভাবনা ছিল একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ, ঢাকায় ট্রাইবেল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, রাজশাহীতে হিল ষ্টুডেন্ট ইউনিয়ন, কুমিল্লায় হিল ষ্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সংগঠন গড়ে উঠে। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস না থাকায় এবং অনেক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক চরিত্র প্রাধান্য থাকার কারণে এসব ছাত্র সংগঠনগুলো জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তেমন কোন ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে।

তবে আশি দশকের শেষ প্রান্তে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সারাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকের পর অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামে না হলেও দেশের অপরাপর অংশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা বিকাশ লাভ করতে থাকে।

সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখা এবং দেশে-বিদেশে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও সমর্থন আদায় করা, সর্বোপরি পিসিপি’র মাধ্যমে ছাত্র-যুব সমাজকে সংগঠিত করে সশস্ত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে সামিল করার লক্ষ্যে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তৎসময়ে সশস্ত্র আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে ছাত্র সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করতে থাকে।

এমনিতর ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ও সময়ের দাবিতে লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৮৯ সনের ২০ মে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জুম্ম ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’-এর জন্ম হয়। লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সেদিন ২০ মে বিকালে বুয়েটের রশিদ হলের ২০২ নম্বর রুমে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই মিটিঙে রাত অবধি আলাপ আলোচনা করে প্রশান্ত ত্রিপুরাকে আহ্বায়ক করে ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তারপর দিন ২১ মে লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে মৌন মিছিলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মৌন মিছিলে সামিল হয় শত শত জুম্ম ছাত্রছাত্রী। সেদিন বিকালে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

পররর্তীতে ১৯৮৯ সালের ৯ জুলাই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় পাদদেশে। উক্ত সম্মেলনে বিধান চাকমাকে সভাপতি ও ধীরাজ চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ১৭ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।

এভাবেই লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাম্য ও প্রগতির মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যাত্রা শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। জন্মলগ্ন থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের দাবিসহ সার্বজনীন বিজ্ঞান-ভিত্তিক গণমুখী সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার দাবির পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সাংবিধানিক নিশ্চয়তাসহ সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের দাবি তুলে ধরে। জুম্ম ছাত্র সমাজ পিসিপি’র পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।

পিসিপি’র বিবৃতিতে বলা হয় যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তর সময়েও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম ছাত্রদের সংগঠিতকরণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বৃদ্ধি, আদিবাসী জাতিসমূহের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু, বিনামূল্য কোচিং ক্লাস, শিক্ষা ক্যাম্পেইন, বার্ষিক শীত বস্ত্র বিতরণ প্রভৃতি জুম্ম জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। অপরদিকে জুম্মদের ভূমি বেদখল, জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, চুক্তি লঙ্ঘন করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন এবং ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ময়দানে সোচ্চার। এ লড়াইয়ে পিসিপি’র অনেক ত্যাগী নেতা শহীদ হয়েছেন।

বিবৃতি আরো বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহভাবে বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক জীবন এক অলিখিত কারাগারে বাস করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর হতে চললেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার বর্তমানে এক নাগাড়ে ১৩ বৎসর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পার্বত্য চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত রেখে দিয়ে সরকার উল্টো ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অব্যাহতভাবে দেশে বিদেশে অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিবৃতিতে পিসিপি উল্লেখ যে, এভাবেই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী সরকারগুলোর মতো সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক ও জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তির ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করেছে। জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালিয়ে হচ্ছে। জুম্ম জনগণের ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের, নারীর প্রতি সহিংসতা, অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল, চুক্তি বিরোধী অপপ্রচার ইত্যাদি মানবতা ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

অপরদিকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ, জেএসএস (সংস্কারপন্থী), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি, আরএসও, আরসা, জামায়াতে আরাকানসহ পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বশেষ কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে আরেকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন গঠনের মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এককথায় বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থা চুক্তি পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের ফলে ক্রমান্বয়ে অস্তিত্ব হুমকিতে থাকা জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব ছাত্র সমাজ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবতর্নশীল কূটনীতি এবং সম্প্রসারণশীল আঞ্চলিক মেরুকরণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পতাকাতলে সম্পূরক অবস্থান নিশ্চিত করে আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে। জুম্ম জনগণের এই দুর্দিনে অবিচল সাহস ও ত্যাগের মহিমা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে এতদিনকার চলমান চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সংগ্রামকে এক সম্ভাবনাময় মাত্রায় উপনীত করতে জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদারকরণে ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হতেই হবে বলে পিসিপি তার বিবৃতিতে উল্লেখ করে।