৫১-তে জেএসএস ও তার পটভূমি: মুক্তির সংগ্রামে এখনও নির্ভীক যোদ্ধা

0
446

বাচ্চু চাকমা

১৫ ফেব্রুয়ারি নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য কাঁধে নিয়ে জনসংহতি সমিতির আবির্ভাব ঘটে। ৭২-এ জন্ম নেওয়া সেই নাবালক পাহাড়ি শিশুটি আজ হয়ে গেছে পরিণত। আর জুম্ম জাতির মুক্তির সংগ্রামে পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন একজন তরুণ বিপ্লবী এখন হয়ে গেছে বয়সে প্রবীণ। ৫১-তে পা দিয়েছে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের বয়স্কাল। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, মহান চিন্তাবিদ, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামের পথপ্রদর্শক ও অত্যন্ত দূরদর্শী মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার হাতে গড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আজ ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এদিনে জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ফিরে দেখা যেমন প্রয়োজন তেমনি সংগঠনের অসংখ্য সফলতা ও ব্যর্থতার দিকগুলো নিয়ে আত্ম-জিজ্ঞাসার গভীরে গিয়ে লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা জুম্ম জাতির সামনে তুলে ধরাও আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। আমরা প্রায়ই জানি ৫১-তে পৌঁছাতে এই মহান পার্টির অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থী শত্রুপক্ষের যুক্তিহীন, বুদ্ধিহীন, বিবেচনাহীন, বাস্তব-বিবর্জিত ও পদ্ধতিবিহীন সমালোচনা এবং পার্টির অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, পার্টি ও জনগণের মধ্যেকার সংগ্রাম, বহু তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি ও নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত জনসংহতি সমিতিকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পরেও জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতার দায় আমরা এখনও মুছে ফেলতে পারিনি। জুম্ম জাতির অসংখ্য সংগ্রামী নিবেদিত প্রাণ সুদীর্ঘ আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছেন। সশস্ত্র সংগ্রামের সময়কালীন প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল বিপদসংকুল, আঁকা-বাঁকা, রক্ত-পিচ্ছিল, জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের। সময়ের আবর্তনে দেশে-বিদেশে অসংখ্য ত্যাগী, সংগ্রামী ও জাতির মুক্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ আমাদের জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। ৫১ বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বহু শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি হয়েছে, চারিদিকে অসংখ্য ডাল-পালা গজিয়ে সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং এই জনসংহতি সমিতি এখন বিশাল মহিরুহে আত্মপ্রকাশ করেছে।

সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ঘটে যাওয়া পরাধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রামের কৌশল, দক্ষতা, ইতিহাসের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসী ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সামনে থেকে এখনও নির্ভীক ও সাহসের সাথে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে জনসংহতি সমিতি। আজ নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে বলিষ্ঠ উদ্যমে জুম্ম জাতীয়তাবাদের চেতনায় জেগে উঠার দিন এবং বিজাতীয় শাসন-শোষণের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির মন্ত্র নিয়ে সমগ্র জুম্ম জনগণের কান্ডারী সংগঠনের আত্মপ্রকাশের ঐতিহাসিক দিন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে স্মরণে আসছে সেই অতীতের ফেলে আসা দেশভাগের গভীর ক্ষত ও পীড়িত মানুষের গ্লানিভরা যন্ত্রণার কথা। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আমলে জুম্ম জাতিসমূহের শাসনতান্ত্রিক অধিকার ও আদিবাসীদের ভূমি অধিকার খর্ব করাসহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি হাতে নিয়ে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তিকরণের জঘন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। পাহাড়ের জাতিগত ও সম্প্রদায়গত নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার অবসান তথা বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পথচলা শুরু হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আত্মপ্রকাশের পেছনে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আমলে দীর্ঘ দুই দশকের অধিক সময়ের মধ্যে জুম্মস্বার্থ বিরোধী ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমসহ অসংখ্য জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী ঘটনাপ্রবাহ কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর এই অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহ জমাট বেঁধে এক পর্যায়ে জনসংহতি সমিতি আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তার বিস্ফোরণ ঘটে।

ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা জুম্ম জাতির প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের রণাঙ্গনে এখনও গভীরভাবে প্রেরণা দিয়ে যায়। কথিত আছে স্বাধীন রাজার আমল পেরিয়ে মোঘল কিংবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যায়ভাবে শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতিসমূহের মোঘল কিংবা ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। তৎকালীন সময়ে ১৭৭৮ হতে ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহ এখনও পরাধীনতা থেকে মুক্তির লক্ষে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তান আমলের শুরুতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তিকরণের জন্য জঘন্য নীতি ছলেবলে কৌশলে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারই প্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশ আমলে ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত পাহাড়ি পুলিশ বাহিনী পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তার আমলে ১৯৪৮ সালে বাতিল ঘোষণা করে। তারপর ধীরে ধীরে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৫০ সালে ব্রিটিশের আইন লংঘন করে নান্যাচর, লংগদুসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তান সরকার বহিরাগত মুসলিমদের বসতিস্থাপন শুরু করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার দুই বছর পরে ১৯৫৮ সালে কালো আইন হিসেবে স্বীকৃত ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করে পাকিস্তান সরকার।

১৯৬০ সালের কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের অনিবার্য পরিণতি হল জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় লক্ষাধিক পাহাড়ি নিজের বসতভিটা হতে উদ্বাস্তু হয়ে ভিনদেশের মাটিতে কষ্টকর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ৫৪ হাজার একর ধান্য জমিসহ লক্ষাধিক একর জমি পানির তলে তলিয়ে যায়। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে স্থায়ী অধিবাসীদের জাতীয় জীবনধারা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, ডুবে যায় অসংখ্য ঘরবাড়ি, ধানখেত, গবাদি পশু, সহায়-সম্পত্তি এবং বিশাল এলাকা জুড়ে বন ধ্বংস হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ১৯৬১ সালে ১৯০০ সালের আইন সংশোধন করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার খর্ব করা হয়। ১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে “এক্সক্লুডেড এরিয়া মর্যাদা’ বাতিল করে দিয়ে ‘ট্রাইবেল এরিয়া’ ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৬৩ সালে ‘ট্রাইবেল এরিয়া মর্যাদা’ও বাতিল করা হয়। এরমধ্যে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যেমনি সংগঠিত হয় তেমনি অন্যান্য জুম্মস্বার্থ বিরোধী ঘটনা প্রবাহ নিয়ে স্থায়ী অধিবাসীগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপ্লবী এম এন লারমাকে পাকিস্তানের জেলে যেতে হয়। ১৯৬২ সালে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, বর্তমান জনসংহতি সমিতির বিপ্লবী সভাপতি ও জুম্ম জনগণের প্রিয়নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি গঠিত হয় এবং একই সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষক সমিতি গঠন হয়। এরপর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচন, এই নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তারপর পাকিস্তান সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। দীর্ঘ দুই দশকের অধিক পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্তিকরণের অসংখ্য কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরবর্তীতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নিপীড়িত জুম্ম জনগণের একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে বৈপ্লবিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

স্বাধীন বাংলাদেশের আমলে ১৯৭২ সালে সংবিধান রচিত হয়। কিন্তু সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের আত্মপরিচয়ের অধিকার স্বীকৃতি পায়নি। বরঞ্চ ‘বাংলাদেশের সকল নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবে’ এই বলে সংবিধান প্রণয়ন হয়ে যায়। এই ক্ষোভে ও দুঃখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রতিবাদের ঝড় তুলে সংগ্রাম চালিয়ে যান। তৎকালীন আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট সাংসদদের সামনে তিনি মহান জাতীয় সংসদের ভেতরে একাই একজন আদিবাসী সংসদ সদস্য হিসেবে সাহসের সাথে লড়াই করেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় নেতৃবৃন্দ বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার যৌক্তিক দাবিকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাম্ভিকতায় অগ্রাহ্য করেন। সমগ্র জুম্ম জনগণের আত্মপরিচয়ের অধিকার খর্ব হওয়াতে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বুকভরা বেদনা ও যন্ত্রণাকে নিজের অন্তরে লালন করে জাতীয় সংসদ হতে প্রতিবাদস্বরূপ ওয়াক-আউট করেন।

বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলাদেশ সরকারের নিকট ধর্না দেন। জুম্ম জাতির বঞ্চনা ও অধিকারের কথা বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও নেতৃবৃন্দকে বুঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তৎকালীন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের জ্যত্যভিমানের অহংকারের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে বাঙালি জাতি ছাড়াও অন্যান্য বহু ভাষাভাষী আদিবাসী জাতিসত্তা ও বহু বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি লালনকারী মানুষের বসবাস রয়েছে তা যেন মুছে ফেলতে চাইলেন। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হবার পর গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের সমস্ত পথ স্তব্ধ হয়ে যায়। এমনতর পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ছেড়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর সাথে জনসংহতি সমিতিকে যুদ্ধ ও সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বুঝতে পেরেছে যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বেঁচে থাকার বিকল্প কোনো রাস্তা আমাদের খোলা নেই। ইতিহাস বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ খুবই সহজ-সরল এবং শান্তিপ্রিয় একটি জাতি। কিন্তু বিজাতীয় ও বহিরাগত শক্তি বারবার জুম্ম জনগণের উপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। তবে জুম্ম জনগণ বরাবরই বীরত্বের সাথে তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক নীতি গ্রহণ করাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণের সাথে যে অন্যায়-অবিচার করেছে, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও একইভাবে সেই অন্যায় আচরণ করে যাচ্ছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জাতিসমূহকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যা যা করতে পারেনি, বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী তা ছলেবলে কৌশলে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী সামরিক ও বেসামরিক উভয়ই শক্তি দিয়ে সুগভীর ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

১৯৭৫ সালে সারাদেশে সামরিক শাসন জারী হলে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আত্মগোপনে চলে আসেন। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়নের স্টিমরোলার নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৎসময়ে একই বছরে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার প্রায় ৫ লক্ষ বহিরাগত মুসলিম সেটেলার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি কঠিনতর পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।

আশির দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূল করতে অত্রাঞ্চলে জুম্মদের গ্রামে গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নিজস্ব বাস্তুভিটা হতে উচ্ছেদ ও লোমহর্ষক গণহত্যার মতো জঘন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার এভাবে জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়নের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠী যতই নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালিয়ে ছিলেন ততই জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র কার্যক্রম ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতির সুদক্ষ পরিচালনায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে সশস্ত্র সংগ্রামের অভূতপূর্ব সফলতা চলে আসে। কিন্তু এক পর্যায়ে পার্টির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থী চার কুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের তৎকালীন সময়ে জাতীয় বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতক গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের বিভৎস ও ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের মধ্যে বৈপ্লবিক শক্তিকে দ্বিধাবিভক্ত করে বিভেদপন্থী চক্র জুম্ম জাতির বিধ্বংসী ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়। জুম্ম জাতীয় জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা, উদ্বেগ ও ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খলতা। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ তাদের সবচেয়ে কাছের জন ও প্রাণের মানুষ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হারাতে বাধ্য হন। জুম্ম জাতির এই সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম কান্ডারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মহান নেতার যোগ্য উত্তরসূরী, তাঁরই ছোট ভাই, জুম্ম জনগণের জীবন্ত কিংবদন্তী বিপ্লবী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। এম এন লারমার মৃত্যুর পর বর্তমান নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে জুম্ম জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায়। প্রিয়নেতা সন্তু লারমার সুদক্ষ পরিচালনায় গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে বিভেদপন্থী, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক চার কুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের রাজনৈতিক মৃত্যুর ঘন্টা বেজে উঠে। বিভেদপন্থীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ১৯৮৩ সাল হতে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছরের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থী নির্মূলীকরণের যুদ্ধাভিযানের পাশাপাশি সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে বিশাল সাফল্য প্রদর্শন করে শান্তিবাহিনী গেরিলারা। সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধাভিযানের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির সংলাপও সমানতালে চলতে থাকে। উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে প্রথমে চার দফা দাবিনামা বাংলাদেশ সরকারের নিকট পেশ করা হয়, এরপর ৫ দফা দাবিনামা ও তারপর সংশোধিত ৫ দফা দাবিনামা পেশ করা হয়। এক পর্যায়ে তিনটি ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে দীর্ঘ ২৬ বার বৈঠক করার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশ সরকারের সাথে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়।

যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে-কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার সময় হতে জুম্ম জনগণের সাথে শাসকগোষ্ঠীর যে দ্বন্দ্ব তার কোনটিই এখনো নিরসন হতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা দেশের একটি জাতীয় এবং রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যাকে রাজনৈতিকগতভাবে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের একটা মুক্তির সনদ, যা জুম্ম জনগণের অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে দশ দফা কর্মসূচি পার্টি কর্তৃক ঘোষণা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির ঘোষিত কর্মসূচি কার্যকর করতে গিয়ে সরকার জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে পেশি শক্তি ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমগ্র জুম্ম জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং এই আন্দোলনের ফলে সমগ্র জুম্ম জনগণকে জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে একত্রিত করার একটা অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করেছে, তখনই সরকার জনসংহতি সমিতির সক্রিয় কর্মীদের পাইকারি হারে মিথ্যা মামলা, ধড়-পাকড়, গ্রেফতার, হুমকি ও ক্রসফায়ারে হত্যা করাসহ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশকে বিনষ্ট করেছে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী। শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশকে জুম্ম জনগণের অনুকূল পরিবেশে রূপান্তরিত করতে জনসংহতি সমিতির আন্দোলনের নীতি ও কৌশল এখনও সম্পূর্ণ সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। তারই আলোকে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামের প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের আরও সুগভীর উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পার্টির সংগঠন ও পার্টির কার্যক্রম জোরদারকরণে আমাদের প্রত্যেকের মনোযোগ বাড়াতে হবে। আন্দোলনকে যেমনি ফেলে রাখা যায় না, তেমনি আন্দোলন থেকে সরে যাওয়াও সঠিক নয়। আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর নিকট নতজানু হয়ে জীবনকে তিলেতিলে ধ্বংস করা সত্যিকার একজন নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মীর উদ্দেশ্য হতে পারে না।

১৯৩০ সালের দিকে এক সময় চীন বিপ্লবে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন তা বুঝতে এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্রটি বুঝতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই চীনের বিপ্লবী আন্দোলন কিছু সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। বস্তুত জনগণই আন্দোলনের মূল শক্তি এবং জনগণ ব্যতীত আন্দোলন সফল হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিও জুম্ম জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে এযাবৎকালে পার্টি আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে যাচ্ছে। আমাদের মহান পার্টি জনসংহতি সমিতিও সেই দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামের চরিত্রটি গভীরভাবে বুঝে নিয়ে সবসময় জুম্ম জনগণের সুখ-দুঃখের সাথে থেকে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন বোধ করে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পার্টির এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জুম্ম জনতার মনে আন্দোলনের জাগরণ সৃষ্টি করে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের অভিষ্ট লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। দ্ব্যর্থহীনভাবে আওয়াজ তুলতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থীরা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবচেয়ে বিপদজনক শত্রু। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল কথা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও প্রগতিশীল শক্তির মধ্যেকার জীবন-মরণের লড়াই-সংগ্রাম। তাই, জুম্ম তরুণদের এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময়-‘জুম্ম জাতির মুক্তির পথ, না বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ঔপনিবেশিকতার পথ?’ এই প্রশ্নের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার শক্তি ও সাহস এখন জুম্ম জাতির সবচেয়ে অগ্রগামী অংশ সংঘবদ্ধ জুম্ম তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নিহিত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এখনও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে এবং তারই আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপক জুম্ম তরুণদের নিজের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ক্লান্ত হয় না।

জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে পাহাড়ের বাস্তব পরিস্থিতিতে তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি-আদর্শকে সমুন্নত রেখে সত্য ও ন্যায়কে সকল কাজের মধ্যে প্রয়োগ করে জুম্ম জাতির মুক্তির শপথ নিয়ে নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় চারটি ঐতিহাসিক যুগ পেরিয়ে আমাদের পার্টি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্যাপক জুম্ম জনতাকে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুকঠিন ও তিক্ত প্রতিরোধ সংগ্রামে অবিচল নেতৃত্ব প্রদান করে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ চার যুগের অধিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিহাস যেমন রয়েছে তেমনিভাবে পরাধীনতার মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসের বিষয়ে মহান পার্টি সমৃদ্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্টি এবং জুম্ম জনগণের ভ্যানগার্ড হিসেবে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমার মতো আপোষহীন, আজীবন সংগ্রামী নেতা পেয়েছি। জুম্ম জনগণ যেখানে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রয়েছে, সেখানে পার্টির আশু লক্ষ্য বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন হতে সমগ্র জুম্ম জনগণকে মুক্ত করার সংগ্রামকে আরও বিকশিত করেছে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের সময় প্রতিরোধ-যুদ্ধে জুম্ম জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র জাতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠেছিলো জনসংহতি সমিতি। এভাবে জুম্ম জনগণ তথা পার্টির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলন দূর্বার গতিতে অগ্রসর হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় একটি অধ্যায় রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তা সত্ত্বেও ৮৩-তে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে চার কুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে বানচালের অপচেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নতুন করে ৮৩-এর প্রেতাত্মা হিসেবে আবির্ভূত হয় প্রসিত-সঞ্চয়-রবি শংকর চক্র। ২০০৭-৮ সালে সারা দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময় বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে ৮৩-এর বিভেদপন্থীদের অনুসরণ করে পার্টির লাইন থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রস্ত হয় এবং পার্টিকে ও আন্দোলনে আঘাত হানে সুধাসিন্ধু-রূপায়ন-পেলে বিভেদপন্থী চক্র।

ব্যাপক জুম্ম জনগণের অক্লান্ত শ্রম ও রক্তে গড়া ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সরকার, সেনাবাহিনী ও তাদের সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আজ ব্যাপকাকার ধারণ করেছে। শাসকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করতে চাইছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রেখে অসংখ্য বিপ্লবী যোদ্ধা নির্ভীকভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলনের ইতিহাসে অসংখ্য বিপ্লবী বন্ধু আত্মবলিদান দিয়েছেন। অন্যদের আত্মোৎসর্গের ফলে যে স্থান শূন্য হয়েছে, তা পূর্ণ করতে অসীম সাহস ও শক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছে নতুন প্রজন্মের অসংখ্য সাহসী যোদ্ধা। জুম্ম জাতিকে এই পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেদের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় নিয়ে বেঁচে রাখার জন্য একমাত্র মেরুদণ্ড হিসেবে জনসংহতি সমিতি এখনও তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে এক পাও পিছুপা হয়নি। পার্টির অসংখ্য সক্রিয় ও জাতির মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এবং ব্যাপক জুম্ম জনগণ বিভিন্ন ফ্রন্টে সাহসের সাথে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, এই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের পার্টির পতাকাতলে সমবেত হয়ে পরাধীনতার দাসত্বের শৃঙ্খল মোচনের জন্য অসংখ্য বিপ্লবী বন্ধুর জন্ম হয়েছে। সেই মুক্তিপাগল মানুষের জাগ্রত চেতনার কন্ঠস্বর হয়ে জনসংহতি সমিতি এখনও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য মানব মুক্তির ডাক দিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে কেবল নয়, সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসেও জনসংহতি সমিতি অন্যতম স্মরণীয় একটি নাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই লড়াকু যোদ্ধারা আজও সংগ্রামী মানুষের মনে সাহস, শক্তি ও প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীর চোখে ধুলো দিয়ে স্রোতের বিপরীতে হেঁটে বৈপ্লবিক চেতনার মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের জন্য জনসংহতি সমিতিই অসংখ্য আত্মবলিদানের নিবেদিত প্রাণ তৈরি করেছে। জুম্ম সমাজের আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর ছেলেটি এক সময় সমগ্র জুম্ম জনগণের জাতীয় স্বার্থে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়ে পাহাড়ের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির লড়াই করে গেছে। পাহাড়ের জুম্ম জনগণের মুক্তির জন্য সৃষ্টির উন্মাদনায় এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জুম্ম তরুণরা। ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষিপ্রতা নিয়ে জুম্ম তরুণরা সমাজ বিনির্মাণের কাজে মনোযোগ দিয়ে যাচ্ছে। পদানত জীবন থেকে মুক্তির কঠোর সাধনায় নিবেদিত জুম্ম তরুণরাই আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ৫১ বছরেও জুম্ম জাতির মুক্তির রণাঙ্গনে এখনও নির্ভীক যোদ্ধার ন্যায় কান্ডারীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের জন্য জনসংহতি সমিতি আছে এবং থাকবে-যুগে যুগে লড়বেই!

জনসংহতি সমিতি-জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ!