২০২২ সালে ২৩৫টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার শিকার ১,৯৩৫ জন: জেএসএসের রিপোর্ট

0
702

হিল ভয়েস, ১ জানুয়ারি ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: ২০২২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক ২৩৫টি ঘটনায় ১,৯৩৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা কর্তৃক আজ রবিবার (১লা জানুয়ারি) গণমাধ্যমকে প্রেরিত ২০২২ সালের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়।

উক্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো ২০২২ সালে সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের কার্যক্রম জোরদার করেছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী এই সরকার একনাগাড়ে ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করে উল্টো চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। ফলে ২০২২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক ২৩৫টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ১,৯৩৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, ২৩৫টি ঘটনার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১১০টি ঘটনার ৭৭৯ জন, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক ৮৫টি ঘটনার ৭০৮ জন, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ৪০টি ঘটনার ৪৪৮ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।

বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ ও সেনাবাহিনীর হুমকি ও উৎপীড়নের ফলে রুমার বম জনগোষ্ঠীর অন্তত ২৯৪ জন মিজোরামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে তারা মিজোরাম সীমান্তে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকন্তু রুমার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন ট্রেনিং সেন্টার (কেটিসি) নামে কেএনএফের ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার জঙ্গীদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বের জন্য বিপদজনক তো বটেই, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও অধিকতর হুমকিমূলক।

জনসংহতি সমিতি আরো যোগ করে যে, সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে বাঘাইছড়িতে ১৮৮ পরিবারসহ তিন পার্বত্য জেলায় জুম্ম গ্রামবাসীদের অন্তত ৫০০ পরিবারের ঘরবাড়ি, বসতভিটা ও বাগান-বাগিচা ধ্বংস হয়েছে, এসব পরিবার চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদের মুখে পড়েছে এবং অত্রাঞ্চলের জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গত ২ ডিসেম্বর ২০২২ পার্বত্য চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়র ফ্রান্সিসকো ক্যালি জাই-এর প্রদত্ত বিবৃতিতেও পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক পরিস্থিতির চিত্র ফুটে উঠেছে।

গত ১২-১৭ নভেম্বর ২০২২ রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সফরের সময় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রদত্ত বর্ণবাদী ও বিতর্কিত ১০টি নির্দেশনার ফলে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে কূটনীতিক প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়নি। ১০টি শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সভার উপর নজরদারি রাখার জন্য রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলের বৈঠকে রাঙ্গামাটি আসনের ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও রাঙ্গামাটি জেলার ডিসি এবং চাকমা সার্কেল প্রধানের সাথে বৈঠকে রাঙ্গামাটি জেলার ডিসির উপস্থিতি রাখার নির্দেশনা।

নিম্নে প্রতিবেদনের বিস্তারিত অংশ দেয়া গেল-

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম:

ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজতজয়ন্তী অতিক্রান্ত হলেও এখনো অর্জিত হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর সুদীর্ঘ ২৫ বছরের মধ্যে দীর্ঘ ১৮ বছর চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। তথাপি পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি এ সরকার। ২০২২ সালে সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে সরকার ২০২২ সালে অগণতান্ত্রিক, হিংসাত্মক ও ঔপনিবেশিক কায়দায় জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তি ও দমন-পীড়নের নীতি জোরদার করেছে। ফলে ২০২২ সালে পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি অধিকতর সংঘাতপূর্ণ ও সহিংস হয়েছে।

বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স পুনর্গঠিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু এসব কমিটির সিদ্ধান্তবলী বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৫ম সভার এক বছর পর ৩ ডিসেম্বর ২০২২ ৬ষ্ঠ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেখা গেছে যে, বিগত সভাসমূহের গৃহীত সিদ্ধান্তসহ ৫ম সভার কোন সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়নি।
পক্ষান্তরে সরকার কমিটির সিদ্ধান্তের বিপরীতে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। যার অন্যতম উদাহরণ হলো চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৫ম সভায় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর এবং পরিষদের আইন মোতাবেক জেলা পুলিশ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সরকার তা বাস্তবায়নের পরিবর্তে ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা ছিল চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন।

২০২২ সালের আগষ্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরকালে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ ও বেসামরিকীকরণের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অব্যাহত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও স্বাধীন পক্ষসমূহের ওই এলাকা পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে অবাধ অনুমতি প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু এই আহ্বানের প্রেক্ষিতেও বর্তমান সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর হয়রানি ও নির্যাতন:

পূর্ববর্তী সামরিক ও স্বৈরশাসকদের মতো বর্তমান সরকার পার্বত্য সমস্যার সামরিক উপায়ে সমাধানের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে একের পর এক ক্যাম্প পুন:স্থাপন করে চলেছে এবং সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে পূর্বের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে জুম্ম জনগণের উপর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচিহ্নিত (ক্রিমিনালাইজ) করার জন্য সরকার ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিকে ধ্বংস করতে সরকার আজ উঠেপড়ে লেগেছে। জুম্ম জনগণের ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের, নারীর প্রতি সহিংসতা, অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল, চুক্তি বিরোধী অপপ্রচার ইত্যাদি মানবতা ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

২০২২ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১১০টি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। ১১০টি ঘটনায় কমপক্ষে ৭৭৯ জন ব্যক্তি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন। তাদের মধ্যে ৫৬ জনকে গ্রেফতার, ২৮ জনকে সাময়িক আটক, ৫ জনকে খুন, ৪৮ জনকে মারধর, ১৭ জনকে হুমকি ও হয়রানি, ৩১টি বাড়ি তল্লাসী, ২২ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা, ৬টি ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ, সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে অন্তত ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, ২ জুম্ম নারীর উপর শারীরিক ও যৌন সহিংসতা ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করার বিধান লঙ্ঘন করে বর্তমান সরকার ২০২২ সালেও প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের জায়গায় নতুন নতুন ক্যাম্প বসানোর চুক্তি-বিরোধী উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছিল। গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬টি নতুন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল ২০২২ এপিবিএন সদর দপ্তরের ইস্যুকৃত এক সার্কুলেশনের মাধ্যমে প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ২৬ মে ২০২২ রাঙ্গামাটিতে এপিবিএনের আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র তৎপরতার মনগড়া অভিযোগ এনে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণকে সম্মুখ যুদ্ধের আহ্বান জানান এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি প্রদান করেন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন।

সেনাবাহিনীর ন্যাক্কারজনক কার্যক্রমের অন্যতম উদাহারণ হলো সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ কর্তৃক প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাঅধিদপ্তর থেকে ৪ জুলাই ২০২২ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অজুহাত দেখিয়ে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও বাক-স্বাধীনতা পরিপন্থী এবং বর্ণবাদী ও ষড়যন্ত্রমূলক বিধায় তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে।

আগষ্টের শেষান্তে সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন জুরাছড়ি উপজেলার আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদের নিকট হতে ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে। এতে জনগণের মধ্যে যেমন উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি এভাবে জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা সেনাবাহিনীর কাজ কিনা বা এর পেছনে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যই বা কী তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্মীয় পরিহানি ও বাধা প্রদানের অন্যতম ঘটনা হচ্ছে গত অক্টোবর মাসে বরকল উপজেলাধীন সুবলং ইউনিয়নের বাঘাছোলা জ্ঞানোদয় বৌদ্ধ বিহারে বিভিন্ন এলাকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণের অংশগ্রহণে কঠিন চীবর দানোৎসব চলাকালে রাঙ্গামাটি সেনা জোনের কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল আতিকুর রহমান ও সুবলং সেনা সাব-জোনের কম্যান্ডার ক্যাপ্টেন আওয়াল এর নেতৃত্বে প্রায় ১২০ জনের একটি সেনাদল কর্তৃক বিহারটিকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে বিহারের ভিতর ও বাইরে তল্লাসি চালানো। ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর এমন মারমুখী আচরণে উপস্থিত পূণ্যার্থী জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে ভন্ডুল করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী, প্রশাসন ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ জুম্মদের কতিপয় সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালিপ্সু লোকদের নিয়ে একটির পর আরেকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করে চলেছে এবং বিভিন্ন কৌশলগত জায়গায় মোতায়েন করে তাদেরকে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে। তারই অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট ও মদদপ্রাপ্ত প্রসিত নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ, জেএসএস সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি খ্যাত এমএনপি ইত্যাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের পর সর্বশেষ সশস্ত্র গ্রুপ বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) গঠিত হয়েছে।

এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, পানছড়ি ও দীঘিনালা, রাঙ্গামাটির বরকলের সুবলং, সদর উপজেলার জীবতলী ও নান্যাচরে এবং বান্দরবানে বালাঘাটা ও পৌর এলাকায়; মগপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়া; বমপার্টি সন্ত্রাসীদেরকে রোয়াংছড়ির সিপ্পি পাহাড়ে ও রুমার রেমাক্রী প্রাংসা এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্রসহ মোতায়েন রেখে অবাধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে মদদ দেয়া হয়েছে।

২০২২ সালে মগপার্টি খ্যাত এমএনপি, বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), সংস্কারপন্থী জেএসএস ও প্রসিত সমর্থিত ইউপিডিএফ ইত্যাদি সন্ত্রাসী দল কর্তৃক ৮৫টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ৮৫টি ঘটনায় অন্তত ৭০৮ জন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। তার মধ্যে ২৪ জনকে খুন, ৪৭ জনকে অপহরণ, ১৫ জনকে হুমকি ও মারধর, অপহৃত ২ জনকে মিথ্যা মামলায় পুলিশের নিকট সোপর্দ, ১০০ পরিবারের প্রায় ৩০০ জনকে উচ্ছেদ এবং ২৯৫ জন শরণার্থী হিসেবে মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনার সবচেয়ে জঘন্য ছিল বমপার্টি নামে খ্যাত কেএনএফ সন্ত্রাসী কর্তৃক বিলাইছড়ির বড়থলিতে একটি ত্রিপুরা পাড়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নিরীহ ৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা ও ২ শিশুকে গুরুতর জখম করা এবং তার পরবর্তীতে বড়থলি ও রোয়াংছড়ির আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাদের ১০০-এর অধিক জুমচাষী পরিবারের প্রায় ৩০০ জনকে উচ্ছেদ করা। কেএনএফের এই নৃশংসতার বিষয়ে প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা হলেও প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি এই ঘটনাকেই ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল রাষ্ট্রীয়বাহিনী। ঘটনার শিকার গ্রামবাসীরা রুমা সেনা জোনে সম্পূর্ণ ঘটনাটি খুলে বলার পরেও সেনাবাহিনী সেটিকেও বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। অপরদিকে কেএনএফ ও সেনাবাহিনীর হুমকি ও উৎপীড়নের ফলে রুমার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বম জনগোষ্ঠীর ২৯৫ জন নিরীহ শিশু, নারী ও পুরুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

সেনাবাহিনী তথা সরকার কেবল বমপার্টি খ্যাত কেএনএফকে মদদ ও পৃষ্টপোষকতা প্রদান করেনি, কেএনএফ কর্তৃক জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” নামক আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয়প্রদানের ঘটনা জেনেও না জানার ভান করে প্রকারান্তরে মদদ দিয়ে থাকে। এমনকি গত অক্টোবর থেকে ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গীদের প্রশ্রয়দানকারী কেএনএফের বিরুদ্ধে পরিচালিত যৌথবাহিনীর কম্বিং অপারেশনের সময়ও কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গীদেরকে রোয়াংছড়ির সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে যেতে কৌশলে সুযোগ দিয়েছিল। রুমার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন ট্রেনিং সেন্টার (কেটিসি) নামে কেএনএফের ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার জঙ্গীদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কেএনএফের কথিত ৬ জাতির মধ্যে ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জনগোষ্ঠী কেএনএফের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী জঙ্গী গোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রদানের কার্যক্রমকে সমর্থন করে না বলে জানিয়েছেন ৫ জাতির প্রতিনিধিবৃন্দ।

সেনাবাহিনী কর্তৃক মগপার্টিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দানের অন্যতম উলঙ্গ ঘটনা হচ্ছে বান্দরবান সেনা ব্রিগেড থেকে প্রকাশ্য সেনা গোয়েন্দা সংস্থার তিনজন লোকের নিরাপত্তার আশ্রয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মগপার্টির ২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে বান্দরবান শহরের উজানী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাতযাপনের ব্যবস্থা করা এবং তার পরদিন শহরের বড়ুয়া টেকের মধ্য দিয়ে তামব্রু এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা।

বস্তুত সরকারের মদদে এভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের কায়েমী স্বার্থান্বেষী বিশেষ মহল একদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও মদদ দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে, অপরদিকে সন্ত্রাসী দমনের নামে জনসংহতি সমিতিসহ জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার দায়ভার সমিতির উপর চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগসহ জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে যুক্ত জুম্মদের সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু ও তাঁবেদার লোকদেরকে মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

সেটেলারদের পার্বত্য চুক্তি বিরোধী তৎপরতা, ভূমি বেদখল ও নারীর উপর সহিংসতা:

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং ভূমি বেদখল, জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণে সংগঠিত করার লক্ষ্যেই সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই মুসলিম সেটেলার ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্টপোষকতা ও মদদ দিয়ে চলেছে। ২০২২ সালে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ভূমি জবরদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগ, মিথ্যা মামলা দায়ের, নারীর উপর সহিংসতা সংক্রান্ত ৪০টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ৪০টি ঘটনায় অন্তত ৪৪৮ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। তার মধ্যে ২ জনকে হত্যা, ১২ জন নারীর উপর শারীরিক ও যৌন সহিংসতা, ২৫ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের, জুম্মদের ৪৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লামায় ৩টি গ্রামের ৩৯টি পরিবারের ৩৫০ একর জমি বেদখলের শিকার, ৪টি সাম্প্রদায়িক হামলা ও ৫ জনকে আহত করার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

এসব ঘটনাবলীর অন্যতম হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদে সেটেলারদের সা¤প্রদায়িক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কর্তৃক ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ রাঙ্গামাটিতে আহূত ভূমি কমিশনের সভা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ৩২ ঘন্টা হরতাল পালন করা। এ সময়ে নাগরিক পরিষদের প্রতিবাদকারীদের প্রতিরোধ না করে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনী তাদের প্রতি প্রকারান্তরে সমর্থন ও মদদ দিতে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল।

গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই বৌদ্ধ ভিক্ষু হামলার শিকার হয়। এদের মধ্যে ৩০ জানুয়ারি ২০২২ খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গুঙড়াছড়িতে বিশুদ্ধানন্দ মহাথের (৫২) নামে এক ভিক্ষু নৃশংসভাবে খুন হন। তার পরদিন ৩১ জানুয়ারি মুখোশ পরিহিত একদল দুর্বৃত্ত কর্তৃক চট্টগ্রাম নগরীর বায়োজীদ থানাস্থ জুম্ম চাদিগাং বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশ করে জ্ঞানজ্যোতি ভিক্ষুকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়। মুসলিম সেটেলার বাঙালি ও ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠী কর্তৃক এই হামলা সংঘটিত হয় বলে সন্দেহ করা হয়।

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংলগ্ন বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নে সক্রিয় রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গী সশস্ত্র গ্রুপ, আরসা, আরএসও ও আলিকান কর্তৃক স্থানীয় জুম্ম অধিবাসীদের উপর নানা ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার ফলে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত জুম্ম অধিবাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে জুম্মদেরকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে সংঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ৫ জুলাই ২০২২ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় দুই শতাধিক জন সেটেলার কর্তৃক খাগড়াছড়ির মহালছড়ির মাইসছড়িতে জুম্মদের ৩৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর এবং দুইজন আহত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এতে ১৫০-এর অধিক লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলের পাশে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারী সেটেলারদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

অস্থানীয়দের নিকট জুম্মদের প্রথাগত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি ইজারা দেয়ার ফলে ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত সংঘাতের বহুল আলোচিত ঘটনা হচ্ছে গত ২৬ এপ্রিল ২০২২ কথিত লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্তৃক লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে জুম্মদের ৩৫০ একর জুম ভূমি, ফলজবাগান ও গ্রামীন বনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং ২৫ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দু‘টি মামলা দায়ের। এর ফলে ৩৯ পরিবারের ২০০ জন গ্রামবাসী জীবন-জীবিকা, খাদ্য ও পানীয় জলের সংকটের মুখে পড়েছে। দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও বহিরাগত ইজারাদার কোম্পানী এখনো অবাধে জুম্মদের প্রথাগত ভূমি বেদখল করে চলেছে।

জাতিগত নির্মূলীকরণে সরকারের ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং:

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইনে পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা এবং জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার বিধান করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, যা পার্বত্য জেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী অধিকার তথা স্বশাসনের এখতিয়ারকে খর্ব করছে। অপরদিকে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে পাশ কাটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ণ করে চলেছে এবং প্রশাসন ও উন্নয়নে জটিলতা সৃষ্টি করছে।

সরকার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্র কাজে লাগিয়ে চারিদিকে ঘিরে ধরার মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই অংশ হিসেবে উন্নয়ন ক্ষেত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ, অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া, এলাকার জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একতরফা রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট জুম্মদের প্রথাগত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি লিজ দেয়া, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্যাস-তেল অনুসন্ধান ইত্যাদি অন্যতম।

এ ধরনের ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের একটি হচ্ছে সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের নাম সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পাবত্য জেলা) নির্মাণ প্রকল্প’। এ প্রকল্পের অধীনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশের সাথে মায়ানমার ও ভারতের সীমান্তে ৩১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ সড়ক নির্মাণ এবং এ সড়কের সাথে সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে বাঘাইছড়িতে ১৮৮ পরিবারসহ জুম্ম গ্রামবাসীদের অন্তত ৫০০ পরিবারের বসতবাড়ি, বাগান-বাগিচা, স্কুল, মন্দির উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে খুবই সামান্য পরিমাণ যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনষ্ট্রাক্টশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক জুম্মদের বসতবাড়ি, বাগান-বাগিচা ও বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে জোরপূর্বক এ ধরনের সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি দিয়েছে বাঘাইছড়ির ক্ষতিগ্রস্ত ১৮৮ পরিবারের লোকজন। এছাড়া পানছড়ি ও মাটিরাঙ্গা উপজেলায়ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণের নামে জুম্মদের বাগান-বাগিচা ও স্থাপনা ধ্বংস করা হচ্ছে। আগষ্ট মাস থেকে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়নে সেনাবাহিনীর বীর ৩২ রেজিমেন্ট কর্তৃক গাছ-বাঁশের ব্যবসা ও গ্রামের প্রথাগত ভূমিতে চাষাবাদ করতে বাধা দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, যেখানে সড়ক নির্মিত হয়েছে, সেখানে বহিরাগত মুসলিম বাঙালিরা অনুপ্রবেশ ও বসতি স্থাপন করছে। এর ফলে পার্বত্য চুক্তিতে স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধান হুমকির মধ্যে পড়ছে। আর রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রশাসনের সহায়তায় মুসলিম সেটেলাররা জোরপূর্বক জায়গা-জমি দখল করে স্থানীয় জুম্মদেরকে উচ্ছেদ করেছে। অথচ পার্বত্য চুক্তিতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত প্রদান এবং অলিখিত চুক্তি অনুসারে মুসলিম সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির এসব ধারা বাস্তবায়নের পরিবর্তে যেখানেই সড়ক নির্মিত হচ্ছে সেখানে মুসলিম সেটেলার বসতি প্রদান এবং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। এভাবেই উন্নয়ন কার্যক্রমকে সরকার অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।