সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থীদের ব্রাশ ফায়ার, বান্দরবানে তাদের অপকর্ম বিস্তারে ষড়যন্ত্র

0
1732
ছবি: প্রতিকী

হিল ভয়েস, ১৫ মে ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম: এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি, পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা ও সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী সশস্ত্র গ্রুপের আধিপত্য প্রশস্থ করার লক্ষ্যে সেনা-মদদপুষ্ঠ সংস্কারপন্থী সশস্ত্র গ্রুপ কর্তৃক রাতের অন্ধকারে বান্দরবানের কুহালঙে অন্তত দু’টি জায়গায় এবং রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে অন্তত একটি জায়গায় ব্রাশ ফায়ার করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সহায়তায় বান্দরবান জেলায় তাদের আধিপত্য ও সন্ত্রাসী অপকর্ম বিস্তারকল্পে সংস্কারপন্থী সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা বান্দরবানে পদার্পণ করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বান্দরবান প্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে যে, গত ৮ মে ২০২০ মধ্য রাতে সংস্কারপন্থী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বান্দরবান সদরের দিকে যাওয়ার সময় কুহালং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের কিবুক পাড়া এলাকায় অন্তত পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি এবং গলাচিপা নামক এলাকায় আরো অন্তত ৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। এতে এলাকায় চরম আতঙ্ক দেখা দেয়।

অপরদিকে রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে যে, গত ১৩ মে ২০২০ বুধবার রাত সাড়ে ৮:০০ টার দিকে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের তালুকদার পাড়ার ১নং রাবার বাগান এলাকায় সশস্ত্র সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা ৭/৮ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে।

এতে কেউ হতাহত না হলেও বাঘাইছড়ি এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীকে সহায়তায় এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সংস্কারপন্থীরা ব্রাশ ফায়ার করেছে বলে স্থানীয় এক গ্রামবাসী জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবান শহরের এক জুম্ম অধিবাসী জানান যে, এ পর্যন্ত বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী সংস্কারপন্থী সশস্ত্র গ্রুপের প্রকাশ্য উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় ও ষড়যন্ত্রে সংস্কারপন্থীদের একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করে। তবে তাদের সংখ্যা কত তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ মে ২০২০ রাতের বেলায় সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা সরাসরি খাগড়াছড়ি থেকে গাড়িতে করে এসে বান্দরবানে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে তারা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বান্দরবান জেলার কয়েকটি এলাকায় অবস্থান নিয়েছে।এমনকি তারা ঘরভাড়া নেয়ার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, ঐ রাতে উবামং মারমা ও রতন তনচংগ্যা নামের দুই ব্যক্তি প্রথমবার ছোট ট্রাকের মত বি-৭০ নামের এক গাড়িতে করে খাগড়াছড়ি থেকে সংস্কারপন্থীদের একটি সশস্ত্র গ্রুপ বান্দরবানে নিয়ে আসে। করোনাভাইরাস ঠেকাতে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলেও সেনাবাহিনীর ইঙ্গিতে গাড়িটি রাত প্রায় ২:০০টা-৩:০০টা’র মধ্যে বান্দরবানে অবাধে প্রবেশ করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মধ্য রাতে বান্দরবান সদর উপজেলাধীন ২নং কুহালং ইউনিয়ন হয়ে একটি গাড়ি বান্দরবান সদরের দিকে যায়। যাওয়ার সময় কুহালং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের কিবুক পাড়া এলাকায় পৌঁছলে সংস্থারপন্থী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গাড়ি থেকে অন্তত পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে বলে। এছাড়া যাওয়ার পথে গলাচিপা নামক একটি এলাকায় পৌঁছলে সেখানেও অন্তত ৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে।

আরও একটি সূত্র জানায়, সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের ৮ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ বর্তমানে বান্দরবান সদর উপজেলার বালাঘাটা এলাকার মাংপ্রু ঝিরি নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছে।

অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের অপর একটি দল ইতোমধ্যে রোয়াংছড়িতেও প্রবেশ করেছে। সেখানে তারা দুটি ঘরভাড়া নেয়ার চেষ্টা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। একটি হলো রোয়াংছড়ি সেনাক্যাম্পের পাশে থাংসাং বিল্ডিং, অপরটি বাজারের দীপক বিল্ডিং। তবে তাদেরকে ঘর ভাড়া দিতে কেউ রাজি হচ্ছে না বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতে, বান্দরবানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, সংস্কারপন্থীদের দিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা, জুম্মদের উপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন জোরদার ও জায়েজ করা এবং বান্দরবানের পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও অস্থিতিশীল করার হীনউদ্দেশ্য নিয়েই সেনাবাহিনী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এবং প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়ে সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করিয়েছে।

সেনাবাহিনী, গোয়েন্দাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বসহ সরকার জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করার মাধ্যমে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তিবর্গকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী’, ‘বিচ্ছিন্নবাদী’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

তারই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ-অস্ত্রধারী খোঁজার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনাচে-কানাচে রাত-বিরাতে তল্লাশী অভিযান, গ্রেফতার, মিথ্যামামলা, ক্রসফায়ারের নামে হত্যা, গুম, হুমকি, হয়রানিসহ ফ্যাসীবাদী দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, অন্যদিকে প্রত্যক্ষভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা দিয়ে দিচ্ছে।

ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং বাজারে, নানিয়ারচর এলাকায়, লংগদু সদরে, বাঘাইছড়িতে অবস্থান নিয়েছে। এসমস্ত এলাকায় সেনাবাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চলছে সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যা ও হুমকি।

আরও উল্লেখ্য যে, ২০০৭-২০০৮ সালের জরুরি অবস্থার সুযোগে সেনাবাহিনী যেভাবে পার্বত্য চুক্তিকে নস্যাৎ করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপকে এনে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির রাজত্ব কায়েম এবং সাথে সাথে সেনাশাসন জোরদার করেছিল, একইভাবে বর্তমানেও কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় চলমান লকডাউনের সুযোগে সেনাবাহিনী সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’কে ব্যবহার করে যাচ্ছে। বান্দরবান এলাকায়ও একই উদ্দেশ্য হাসিল করতে সেনাবাহিনী এমন ভূমিকা গ্রহণ করছে বলে অনেকেই বলছেন।