সাজেক ও লামায় হঠাৎ হামের প্রাদুর্ভাব, ৭ শিশুর মৃত্যু, আক্রান্ত প্রায় ৩০০ জন

0
961

হিল ভয়েস, ২২ মার্চ ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম:  সম্প্রতি হঠাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় সাজেক ইউনিয়নে ও বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার লামা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামে হামের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের কথা জানা গেছে। মাত্র মাস খানেকের মধ্যে এতে অন্তত ৩০০ জন আক্রান্ত হওয়া এবং ৭ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এনিয়ে এলাকায় গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের দুর্গম এলাকার আদিবাসী জুম্মদের নাগরিক সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

জানা গেছে, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সাজেক ইউনিয়নের কেবল ছয়টি গ্রামেই অন্তত ২৫০ জন জুম্ম গ্রামবাসী হামের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের সিংহভাগই শিশু। এদের মধ্য থেকে দুর্গম তুইছুই মৌজার অরুণপাড়া গ্রামই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে এই গ্রামের ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অরুণপাড়ায় মৃত্যুর শিকার ৬ শিশু হল-

১. ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সুজন ত্রিপুরার কন্যা সাগরিকা ত্রিপুরা (১১ বছর);
২. ১৫ মার্চ ২০২০ মোহেন্দ্র ত্রিপুরার পুত্র দীনেশ ত্রিপুরা বিষণ (২ বছর ৬ মাস);
৩. ১৬ মার্চ ২০২০ মনার মোহন ত্রিপুরা কন্যা রুজিনা ত্রিপুরা (৩ বছর);
৪. ১৭ মার্চ ২০২০ বিবরণ ত্রিপুরার পুত্র কহেন ত্রিপুরা (৩ বছর ৬ মাস);
৫. ১৭ মার্চ ২০২০ কৃষ্ণ মোহন ত্রিপুরার পুত্র রাকেশ ত্রিপুরা (২ বছর) ও
৬. ১৭ মার্চ ২০২০ কেষ মোহন ত্রিপুরার কন্যা দেবী ত্রিপুরা (দেড় মাস)।

আক্রান্ত অন্য গ্রামগুলি হল- লংথিয়ান পাড়া, তরুণ ত্রিপুরা পাড়া, কমলাপুর চাকমা পাড়া, নিউথাং/নতুন পাড়া, হাইচ্যাপাড়া ইত্যাদি।

এছাড়া আরও জানা গেছে, সাজেকের প্রত্যন্ত গ্রামে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন এবং বয়স্ক লোক ৭-৮ জন এখনও গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তাদের গ্রামের শিশুদের কখনো টিকা দেওয়া হয়নি এবং তারা এযাবৎ কোন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাননি। দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে কোন চিকিৎসক যান না বলে জানান তারা। উল্লেখ্য, আর্থ-সামাজিক দূরবস্থা এবং সরকারি-বেসরকারি সেবা ও সহযোগিতার অভাবের কারণে গ্রামের লোকজন, বিশেষ করে শিশুরা চরম পুষ্টিহীনতার মধ্যে থাকতে বাধ্য হয় বলে খবর পাওয়া যায়।

জানা গেছে, হামের প্রাদুর্ভাবের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর, বাঘাইছড়ি উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একদল স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত এলাকায় যান এবং পনের বছরের কম বয়সী মোট ২৮৫ জন শিশুকে হামের টিকা দিয়েছেন। তবে এমন গুরুতর প্রাদুর্ভাবে কেবল টিকা দানই যথেষ্ট নয়। এর সাথে সাথে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অসুস্থ শিশু ও ব্যক্তিদের নিবিড় স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থাও জরুরি। পাশাপাশি এসমস্ত এলাকায় স্থায়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণও অপরিহার্য।

আরো জানা যায় যে, পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা এতই দূর্বল যে, টিকা দিয়েও তারা সহজেই সুস্থ হতে পারছে না। অতিদূর্বল শিশুদের জরুরি চিকিৎসায় অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হলেও তাতে অক্সিজেনের কোন ব্যবস্থা নেই বলে জানা যায়।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের মে মাসে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঐ একই এলাকায় ৭ জনের মৃত্যু হয়।
অপরদিকে সম্প্রতি প্রায় একই সময়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলাধীন লামা সদর ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার ম্রো জনগোষ্ঠী অধুষিত লাল্যাপাড়া গ্রামেও এই হামের প্রাদুর্ভাবে ৪ মাস বয়সী এক ম্রো শিশু মারা যায় এবং প্রায় ৪২ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন, যাদের মধ্যে অন্তত ৩৩ জনই শিশু রয়েছে।

গত ১৬ মার্চ ২০২০ হামে আক্রান্তদের মধ্যে ৩১ জন শিশু ও ২ জন তরুণ বয়সী রোগী দুর্গম লাল্যাপাড়া গ্রাম থেকে ট্রাক যোগে এনে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে গ্রামে এই রোগে দুই-তিন শিশু আক্রান্ত হয়। এরপর তা দ্রুত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা প্রথমে স্থানীয় ঔষদের দোকান ও স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে পরামর্শ ও ঔষধ চাইলে, ঔষধের দোকানদার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এটিকে একটি ‘অজানা রোগ’ বলে দাবি করে। বলাবাহুল্য, এই লাল্যাপাড়াসহ বান্দরবানের আরও অনেক প্রত্যন্ত এলাকায়ও সরকারি কোন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছায় না বলে জানা যায়।

উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সাজেক ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমপক্ষে ৪৫টি গ্রামে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ৫০টি গ্রামের ২,৫০০ পরিবারের প্রায় ১৫,০০০ আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসী এই খাদ্য সংকটের শিকার রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, সাজেক ইউনিয়নের উদোলছড়ি, নতুনজৌপুই, পুরান জৌপুই, নিউথাংমাং, নিউলংকর, ব্যাটলিংপাড়া, ব্যাটলিং তারুংপাড়া, কমলাপুর, লংত্যাং, অরুণপাড়া, কাছ্যাপাড়া, শিয়ালদাই, গন্ডাছড়া, থলছড়া, এগাজ্যাছড়ি, মোন আদাম, ধাব আদাম, কলকপাড়া, বাদলছড়ি, নিমুইপাড়া, হাগড়াকেজিং, দুলুছড়ি, দুলবন্যাসহ প্রভৃতি গ্রামে খাদ্য সংকট চলছে। এছাড়া খাদ্যসংকটের সম্মুখীন হয় বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার ৩০০ পরিবার জুম্ম গ্রামবাসী।

সাজেক একটি আদিবাসী জুম্ম অধুষিত অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চল। এই এলাকায় জুম্ম অধিবাসীরা মূলত জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। জুম চাষ করে বড়জোর তারা ৬ থেকে ৯ মাসের খাদ্য যোগাড় করতে পারে। বাকি ৩ থেকে ৬ মাস তাদের মধ্যে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে এই খাদ্য সংকট জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত চলতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে জুমের ধান পাকলে ধীরে ধীরে এই খাদ্য সংকট কেটে যায়। খাদ্যের অভাবে দুর্গম গ্রামের মানুষগুলো কলা গাছের নরম অংশ খেয়ে আছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছে নারী ও শিশুরা। দেখা দেয় চরম পুষ্ঠিহীনতা।

আরো উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলা এবং বান্দরবান জেলার থানছি ও রুমা উপজেলায় পাহাড়ি আদিবাসীদেরকে খাদ্য সংকট আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০০ আক্রান্ত পরিবার একই সময়ে ৬ মাস ধরে ত্রাণের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এরপর ২০১৩ সাল হতে কয়েক বছর ধরে থানছি উপজেলা প্রান্তিক অনেক জুমিয়া পরিবার খাদ্য সংকটের মুখোমুখী হয় এবং তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে আরো গভীর অরণ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।