মহান নেতা এম এন লারমার ৮৩তম জন্মদিবস: বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচি

0
480
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

হিল ভয়েস, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামীকাল (১৫ সেপ্টেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত মহান নেতা, জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সংসদ সদস্য, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (যিনি এম এন লারমা নামে সমধিক পরিচিত) ৮৩তম জন্মদিবস।

দিবসটি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা, পুরস্কারবিতরণীসহ নানা অনুষ্ঠান। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির খবর উল্লেখ করা গেল।

রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠান

রাঙ্গামাটি শহরের আশিকা কনফারেন্স হলে ১৫ সেপ্টেম্বর, বিকাল ৪:০০ টায় এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগার, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’এর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার উদ্যোগে এক আলোচনা সভা ও স্মারকগ্রন্থ বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সৌখিন চাকমা এবং বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’র পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন, জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক ফোরামের সভাপতি, বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমা, রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমির অধ্যক্ষ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান রীতা চাকমা ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি দীপন কুমার ঘোষ।

পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর, বিকাল ৪:০০ টায় রাঙ্গামাটি শহরের দেবাশীষনগরে এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগারের অন্যতম সংগঠক সাগর ত্রিপুরা এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’র পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা ও প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা। এছাড়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সচেতন নাগরিক কমিটি’র রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সভাপতি অমলেন্দু হাওলাদার, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান সুনীল ময় চাকমা, বরকল উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শকুন্তলা চাকমা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার সমিতি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন রানা ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী ও আর্য্যদেব লয়াল ক্লাবের উপদেষ্টা ইন্দ্রদত্ত তালুকদার।

ঢাকায় তিন সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও পিসিপি’র স্মরণ অনুষ্ঠান

১৫ সেপ্টেম্বর, বিকাল ৩:০০ টায় ঢাকার বাংলামটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এর উদ্যোগে ‘বর্তমান প্রজন্মেও ভাবনায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আন্তনী রেমা। আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাইদ খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র দেব, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা।

এছাড়া একই দিন সকাল ৬:০০ টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহীদ বেদীতে অনুষ্ঠিত হবে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও স্মরণ অনুষ্ঠান।

চট্টগ্রামে আলোচনা সভা

১৫ সেপ্টেম্বর, সকাল ১০:০০ টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার উদ্যোগে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে অনুষ্ঠিত হবে ‘তারুণ্যের চোখে এম এন লারমা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা।

এম এন লারমার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত

এম এন লারমার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার স্বনামখ্যাত মহাপুরম বা মাওরুম গ্রামে। ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের নীচে অন্যান্য বহু গ্রামের সাথে এই গ্রামটিও ডুবে যায়। তাঁর পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন একজন গুণী শিক্ষক, সমাজহিতৈষী ও দেশপ্রেমী এবং মাতা সুভাষিণী দেওয়ান ছিলেন ধৈর্য্যশীলা ও ধর্মপ্রাণা এক নারী। তাঁর আপন জ্যেঠা কৃষ্ণ কিশোর চাকমা ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারের আন্দোলনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার প্রসার, জুম্ম জাতীয় চেতনা বিকাশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এম এন লারমাদের পরিবারটির বৈপ্লবিক ও নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত।

তাঁর দুই ভাই ও সবার বড় একমাত্র বোন, সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর বড় ভাই শুভেন্দু প্রভাস লারমা ১৯৮৩ সালে তাঁরই সাথে একই ঘটনায় শহীদ হন। অপরদিকে তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর মৃত্যুর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আবির্ভূত হন। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর একমাত্র বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনু জনসংহতি সমিতির নারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে বিএড এবং ১৯৬৯ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৬ সাল হতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হাই স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।

এছাড়া তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের শুরু পর্যন্ত পাহাড়ি ছাত্রদের সম্মেলনে ও সংগঠনে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তনমূলক আইনে পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ি ছাত্রাবাস হতে গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে থাকার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি লাভ করেন।

পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরই নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ৪ দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জুম্মদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। ১৯৭২ সালে তাঁরই নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছর জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগদান করেন।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তাঁর ও তাঁর ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৭৭ সালে জনসংহতি সমিতির প্রথম জাতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে পরপর সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোর রাতে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত এক আক্রমণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার খেদারছড়া থুমে আট সহযোদ্ধাসহ নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।