ভূ-রাজনৈতিক আলোচনায় যখন কেএনএফ

0
414

মিতুল চাকমা বিশাল

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের মিডিয়ায় বান্দরবানের কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নিয়ে সংবাদ বা তথ্যচিত্রের বেশ সরগরম উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ যেন “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে”-সেই প্রবাদের একেবারেই বাস্তব প্রতিফলন। ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)-এর প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে এসে কেএনএফে রূপান্তর ও অবস্থান এবং তাদের প্রতিষ্ঠাতা সহযোগী বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে কোন কথা না বললেও এই সমস্ত ভূঁইফোড় রিপোর্টগুলোতে হর-হামেশাই দেখতে পাবেন, কুকি-চিন ন্যাশনাল (কেএনএফ)-এর সাথে জাতিগত বিষয়কে উস্কে দিয়ে দক্ষিণ-এশিয়ার জো জাতিগোষ্ঠীর সাথে বলপূর্বক একটা ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি করিয়ে দেওয়ার, একইসাথে দেখতে পাওয়া যায় এই তথাকথিত কেএনএফ ইস্যুটিকে একটি ধর্মীয় মৌলবাদের ইস্যুতে পরিণত করিয়ে পাহাড়ে খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের একটা যোগসাজশ তৈরি করার অথবা সেই ইস্যুর সাথে কোন সাবেক ভিপি (ভিপি নূর)-এর এক অদৃশ্য যোগাযোগ খোঁজার বৃথাচেষ্টা। হয়তো আগামীতে এ নিয়ে বিরোধী দলের একটা চক্রান্তের খবরও আমাদের পড়তে হবে, দেখতে হবে।

বাস্তবিকপক্ষে বলতে গেলে এসবের মধ্য দিয়ে কেএনএফের মূল চরিত্র এবং ইস্যুটিকে কেবল পাশ কাটিয়ে যাওয়াই হচ্ছে না, বরং সেটাকে উল্টিয়ে একেবারে ভিন্নখাতে, ভিন্ন ধারায় প্রবাহিতকরণের একটা নগ্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি দেশের স্বনামধন্য পত্র-পত্রিকাগুলোর মতামত কলামগুলিতেও এর বাস্তবিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবগুলোকে বিবেচনায় না এনে, এটাকে জোর করে ভূ-রাজনীতির একটা ফল হিসেবে দেখানোর পাঁয়তারা চলমান রয়েছে, যা আমাদের হতাশ এবং নিরাশ না করে পারছে না। তাছাড়াও এটাও একদম পরিষ্কার যে, এসবের পেছনে একটি অদৃশ্য মহলের ইন্ধন বা মদদ নিশ্চয়ই রয়েছে। আর এসব উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ ও মতামত প্রচারের নিমিত্তে কেএনএফকেই সুকৌশলে প্রমোট করার একটা হীন রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে। পরিশেষে জাতিগত সংঘাতকে উস্কে দিয়ে “জো জাতীয়তাবাদ” বনাম “জুম্ম জাতীয়তাবাদ”-এর তকমা লাগিয়ে পরিস্থিতিকে আরো অধিকতরভাবে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে।

এদিকে অনেকেই আবার কেএনএফের সাথে কেবল ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠীর সম্পর্কটাকে দেখতে পান, কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাহিনী সেনাবাহিনীর সাথে কেএনএফের সম্পর্কটা তারা একেবারেই দেখতে নারাজ। এর অর্থ হচ্ছে, বস্তুর কেবল একটা অংশকে দেখতে পাওয়া। ফলশ্রুতিতে বরাবরই ভূলের পথে পা বাড়ায় আমাদের গবেষক, লেখক এবং তথাকথিত অধিকারকামীরা। একইসাথে তারা কেবলমাত্র বস্তুর একটি দিককেই দেখার ফলে সমস্যার কেন্দ্রে পৌঁছতে পারে না এবং সমাধানের পথটাও খুঁজে পায় না।

সত্যি বলতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নীতি অনুসারে প্রত্যেক বস্তু একে-অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং একে-অপরকে প্রভাবিত করে। তাহলে পাহাড়ের কেএনএফ ইস্যুটিও যে পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে না, তা কিন্তু নয় (বর্তমানে কিঞ্চিৎ প্রভাব ফেলছে)। কিন্তু এই ইস্যুটি কোনভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় (অতএব জো জাতীয়তাবাদের সাথে তূলনা করা বা সমপর্যায়ের মনে করা ভুল)। অধিকিন্তু কেএনএফকে দিয়ে রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী ভূ-রাজনীতিতে একটা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তজ্জন্যই কেএনএফকে প্রমোট করার একটা দূরভিসন্ধি চলমান রয়েছে। তথাপি কেএনএফের এই আকস্মিক উত্থানকে কোনভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার অধিকারকামী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর লড়াইয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। যদি তাই করা হয়, তাহলে আবারো ইতিহাসের গতিপথে চরম ভুল করা হবে।

প্রসঙ্গক্রমে যদি আমরা মণিপুরের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে সেখানে দেখা যায় যে, মণিপুর একটি স্বাধীন স্বশাসিত রাজ্য ছিল এবং যার নাম ছিল কাংলেইপাক রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময়েও মণিপুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা রেখেছিল। কিন্তু বার্মার আগ্রাসনের ভয়ে ১৯৪৯ সালে মণিপুর ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করার চুক্তিপত্রে সই করে। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে এটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য এবং ১৯৭২ সালে পূর্ণ রাজ্যের অনুমোদন পায়। ১৯৫০ সালের দিকে “নাগালিম”-এর দাবিতে নাগা’রা যখন তাদের আন্দোলন গড়ে তোলে, সেই জোয়ারের হাওয়া মণিপুরে এসেও লাগে। একই সময়ে মণিপুরের মেইতেইরাও ভারতে অন্তর্ভূক্তির বিরোধীতা করে স্বাধীন মণিপুরের দাবিতে ১৯৬৪ সালে গড়ে তোলে ” ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (ইউএনএলএফ)”, তারও পরে গড়ে ওঠে “পিপলস রেভোলিউশনারী পার্টি অব কাংলেইপাক (প্রিপাক)” এবং “পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)।

একইভাবে ১৯৯৩ সালে এনএসসিএন (আই-এম) কুকিদের উপর গণহত্যা চালালে তার বিরুদ্ধে স্বাধীন ভূমি (জালেংগাম)-এর দাবিতে গড়ে ওঠে কুকি জনগোষ্ঠীর “কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (কেএনও)” এবং “জোমি রেভোলিউশনারী অর্গানাইজেশন (জেডআরও)” সহ আরো অনেক অধিকারকামী সংগঠন।

অপরদিকে মায়ানমারের চিন হিল এবং এতদঞ্চলের চিন জাতিগোষ্ঠীর একটা নিজস্ব রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। তারা শুরু থেকেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে লড়াই করছে এবং বর্তমানে সিডিএফ-এর সাথে একযোগে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই জারী রেখেছে চিন হিলের সিএনএফ।

অতএব, এসবের প্রত্যেকটি আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক চরিত্র আছে। একইসাথে ভারত এবং মিয়ানমারের কুকি/জো জনগোষ্ঠী যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে একই (জাতীয় মুক্তি) আন্দোলনের সাথে যুক্ত, অতএব তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক, যোগাযোগ, রাজনৈতিক ঐক্য অবশ্যই আছে, যা বাংলাদেশের কেএনএফের সাথে নেই।

অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে মণিপুরে ঘটে যাওয়া সহিংসতার উপর ভর করে নতুন করে “জো” জাতীয়তাবাদের উত্থান দেখতে পাচ্ছেন এবং সেই উত্থানের সাথে বাংলাদেশের কেএনএফের সংশ্লিষ্টতাকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগেই বলেছিলাম, এসবের মধ্য দিয়ে কেএনএফের আসল চরিত্রটিকে পাশ কাটিয়ে জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরিয়ে দেওয়া ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। “জো” জাতীয়তাবাদ নতুন কিছু নয়। এর একটি সামগ্রিক-রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। যদি সত্যই এরকম কিছু হতো, তাহলে এদের (কেএনএফ) শুরুটা মিজোরাম বা চিন হিল থেকেই হতো। কেননা বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলীর মধ্যে “পশ্চাদভূমি” অন্যতম।

কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত-পালিত হয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন কিভাবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হতে পারে? যে সংগঠনটি শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ আর শোষণের প্রতিবাদের বদলে ঐতিহাসিকভাবে অধিকারকামী একটি সংগঠনের (জেএসএস) বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে জাতিগত বিভাজন সৃষ্টির দুঃসাহস দেখাতে পারে, সেই সংগঠনের সাথে কিভাবে অধিকারের রাজনীতি খোঁজা হয়?

২০১২ সালে কেএনডিও অফিস উদ্বোধন করেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সায়েদ সিদ্দীকি, পিএসসি। উক্ত অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন রুমা জোন কমান্ডার লে: কর্ণেল আরিফুল বারী ও ক্যাপ্টেন নাহিদ। ২০১৬-১৭ সালে কেএনএফের ৪২ জন সদস্য মায়ানমারের কাচিন রাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছিল, তখন ৪২ জনের ন্যাশনাল আইডি কার্ড রুমা জোনের নিকট জমা দিয়ে গিয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে, সেনাবাহিনীর পরামর্শেই এ বিষয়টি সম্পাদিত হয়েছিল।

তাহলে বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করা যাক, গত ২১ জুন ২০২২ বিলাইছড়ি উপজেলার রেইংখ্যং ভ্যালীর সাইজাম পাড়া এলাকায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে কেএনএফ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দুইজনকে হত্যা (একজনকে গলা কেটে) ও শিশুসহ ৪ জনকে আহত করে। এই ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ও ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম সমাবেশ করতে চাইলে বান্দরবান সেনা ব্রিগেড থেকে প্রকাশ্যে বাধা দেওয়া হয়।

২৩ জুন ২০২২ বান্দরবান ব্রিগেড থেকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই ঘটনা নিয়ে যেন বেশি বাড়াবাড়ি না করা হয়। একইসাথে বান্দরবানের সমস্ত প্রিন্টিং প্রেসগুলোতে সেনাবাহিনী নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখে যে, “এই ঘটনায় যাতে কোনপ্রকার প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ছাপানো না হয়। যদি কেউ ছাপাতে আসে, তাহলে অতিসত্ত্বর যেন সেনাবাহিনীকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ এবং ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে চাইলে, সেনাবাহিনী তাতেও নিষেধাজ্ঞা দেয়। তৎপরবর্তী ৩ জুলাই বিলাইছড়ি থানা থেকে ৪ জন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য ররুমায় পৌঁছলে, সেনাবাহিনী তাদেরকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

২২ অক্টোবর ২০২২ কেএনএফের প্রতিনিধি সাংপা বম রুমা জোনে গিয়ে জোন কমান্ডার হাসান শাহরিয়ার ইকবালের সাথে দেখা করেন। এসময় জোন কমান্ডার বলেন যে,”তোমরা তো এখনও জেএসএস-এর একটি লাশও দেখাতে পারলে না। আগামী ০৬ অক্টোবরের মধ্যে যদি জেএসএসের লাশ দেখাতে না পার,তাহলে তোমাদের অবস্থা খারাপ হবে।”

০৩ অক্টোবর ২০২২ থেকে সেনাবাহিনী রুমা উপজেলা ও বিলাইছড়ি বড়থলি ইউনিয়নে এক যৌথ অপারেশন শুরু করে। পরের দিন ০৪ অক্টোবর রোয়াংছড়ি উপজেলার রনিন পাড়াতে কেএনএফ এবং সেনাবাহিনী মিলে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গয়াল কিনে খায়।

এর পরেই ঘটনার মোড় আচমকা ঘুরে যায়, যখন র‌্যাব ঢাকায় ইসলামী জঙ্গী দমন বিষয়ে এবং নতুন জঙ্গী সংগঠনের বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে। র‌্যাব ০৬ অক্টোবর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় যে, নতুন জঙ্গী সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা পাহাড়ে কেএনএফের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

তৎক্ষণাৎ ৯ অক্টোবর সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুকৌশলে নাথান বম এবং শামীম মাহফুজকে রামেত্তং পাহাড়ে অবস্থিত কেএনএফ ক্যাম্প থেকে সরিয়ে নেয়। এবং তৎপরবর্তী র‌্যাব ও এসএসএফ ইসলামী জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরু করলে সেনাবাহিনী বেকায়দায় পড়ে যায়। এমনকি স্থানীয় সেনাবাহিনীদের বদলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লা থেকে সেনা এনে অপারেশনে সহযোগিতা করা হয়।

অতএব, সমস্ত কিছুর শুরুতে কেএনএফের সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বিশেষ করে ডিজিএফআই এই কেএনএফের উত্থানের সবচেয়ে বড় কারিগর। চলমান অপারেশনে ডিজিএফআই ও আর্মি সিকিউরিটি ইউনিটের মতপার্থক্য ও মতবিরোধের বিষয় এটিকে আরো সুস্পষ্ট করে। ডিজিএফআইয়ের থিওরি হচ্ছে স্লো পয়জনিং-এর সুত্র ধরে অপারেশন পরিচালনা করা, বিপরীতে আর্মি সিকিউরিটি ইউনিটের থিওরী হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন ক্লোজ করা। কিন্তু প্রসঙ্গত, ডিজিএফআই একইসাথে সেনাবাহিনী এবং কেএনএফ’কে তথ্য সরবরাহ করে থাকে। ফলশ্রুতিতে ডিজিএফআইয়ের ভিত্তিতে অপারেশনে গেলে সেনাবাহিনী আক্রান্ত হয়। এছাড়াও সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডে কোন না কোনভাবে ডিজিএফআইয়ের একটা বড় প্রভাব থাকে।

তার আরো অধিকতর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ রুমা সেনাজোন (২৮-বীর)-এর জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল হাসান শাহরিয়ার ইকবাল রুমা উপজেলার জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের ডেকে একটি বৈঠক করেন, সেই বৈঠকে। কিন্তু বৈঠকে কাউকে কথা বলার সুযোগ তিনি দেননি। তিনি একাই বলে গেলেন যে, “নাথনা’রা বলতো, তারা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তার জন্য কেএনডিও প্রতিষ্ঠা করতে এবং প্রতিষ্ঠার পরেও অর্থ দিয়ে এবং নানাভাবে আমরা তাদেরকে সহযোগিতা দিয়েছিলাম।” একই সময়ে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন যে, “কই! কোথাও তো শুনলাম না! নাথান’রা কারো ঘর তৈরি করে দিয়েছে! কোন রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে! কারো ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে! কোন স্কুল তৈরি করে দিয়েছে! তাহলে এত টাকা গেল কোথায়?”

অতএব এটাই সুস্পষ্ট যে, কেএনএফকে সেনাবাহিনী গঠন করেছিল জুম্ম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এক মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে। কেননা তারা বম জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে জাতিগত বিভাজনকে উস্কে দিতে চেয়েছিল। ফলশ্রুতিতে কেএনএফকে দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন,হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের সেই অত্যাচার-নিপীড়নের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা এবং ত্রিপুরাদের দিয়েও আলাদা সশস্ত্র দল গঠনের পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনীর। একই সাথে জনসংহতি সমিতিকে “চাকমা পার্টি” বলে চাকমা বিদ্বেষ মনোভাব বৃদ্ধি করা। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও, তারা বম জনগোষ্ঠীকে বাদবাকি জনগোষ্ঠীদের থেকে একপ্রকারে পৃথক করে ফেলেছে। কেএনএফের অজুহাতে বমদের গ্রামের পর পর শূন্য করে, তাদেরকে দেশান্তরী করে ভূমি দখলের এক হীনউদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। কেননা বম জনগোষ্ঠীরা যেসমস্ত জায়গাগুলোতে নিজেদের গ্রাম পত্তন করে, সেগুলো তূলনামূলকভাবে একটু উঁচু এবং সবদিক দিয়ে সুবিধাজনক হয়।

অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ের চলমান কেএনএফ বিরোধী অভিযান নিয়ে এত খুশী হওয়ারও কোন কার্যকারণ নেই। কেননা সেনাবাহিনীর এই অভিযান কখনই কেএনএফ বিরোধী ছিল না, এটি তাদের ইসলামী জঙ্গীবিরোধী অভিযান। যে কারণে শামীম মাহফুজকে আটক করার পরে সেনাবাহিনী এখন কেএনএফের সাথে আলোচনায় বসতে “শান্তি কমিটি” গঠন করেছে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এই কমিটি কার্যত এক ছায়া মাত্র। এর পেছনের সমস্ত কলকাঠি সেনাবাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য কখনই কেএনএফকে পূনর্বাসন করা নয়, বরং কেএনএফকে আবারো পূর্বের মত ব্যবহার করা জুম্ম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী চায়, পাহাড়কে উত্তপ্ত করে পাহাড়ে তাদের উপস্থিতিকে বৈধতা দিতে। মোদ্দাকথায় পাহাড়কে তারা ব্যবহার করতে চায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পশ্চাদভূমি হিসেবে।