ভূমি দখল, নিপীড়ন-নির্যাতনে অস্তিত্ব সংকটে হাজং জনগোষ্ঠী

0
273

হিল ভয়েস, ২১ সেপ্টেম্বর , ২০২৩, সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেরার টাঙ্গুয়ার হাওরের তীরঘেঁষা ভারতের সীমান্তবর্তী ৯টি গ্রামের বসবাসরত আদি বাসিন্দা হাজং জনগোষ্ঠী আজ বহিরাগত বাঙালিদের দ্বারা ভূমি দখল, নিপীড়ন-নির্যাতনে অস্তিত্ব সংকটের মুখে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের আদি বাসিন্দা হাজং জনগোষ্ঠী আজ আর এই হাওর ভূমির সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী নন। নানকার প্রথা, টংক প্রথা, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডসহ সব আন্তঃরাষ্ট্রিক রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো হাজংদের আপন বসতভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছে। এছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরের অনেক বিল আজ আর আগের মতো নেই। ভরাট হয়ে গেছে পাহাড়ি বালি ও ঢলের পলিতে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে হাজংদের অনেক দলা (উর্বর ফসলিজমি)। কিছু দলার অস্তিত্ব রয়েছে যেমন- লক্ষীপুর দলা, তারাবাড়ি দলা, গহীন দলা। এসবই ছিল হাজংদের কৃষিজমি। এককালের হাজং জমিদার গহীন অধিকারীর নামে ‘গহীনের দলা’ নামকরণ হয়। বর্তমানে এসব দলা বহিরাগত বাঙালির দখলে।

মধ্যনগর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের তীরঘেঁষা ভারত সীমান্তবর্তী ৯টি গ্রামে বসবাসরত আদিবাসী হাজং সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যা ২৬৬৩ জন। জানা যায়, এককালে এ অঞ্চলে মূল স্রোতের জনগণ বা বাঙালিদের অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর থেকে এ অঞ্চলে বাঙালিরা বসতি স্থাপন করতে শুরু করে এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় হাজং অধ্যুষিত এ অঞ্চলে বাঙালিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকেই হাজংরা বিভিন্নভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরেই এই অঞ্চলের হাজংদের শুরু হয় চরম দুর্দিন। হাজং গ্রামগুলোতে রাতের অন্ধকারে সিঁদকাটা চোরের উপদ্রব শুরু হয়, যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

হাজংদের ভূসম্পত্তি বেহাত হওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা কবি ও লেখক হাজং দশরথ চন্দ্র অধিকারী বলেন, মাটিয়ার বন্দ গ্রামের হাজং জমিদার মহিম অধিকারীর পুত্র গহীন অধিকারী। তাকে গহীনগিরি নামেই সবাই চিনত। মাত্র ৪৮ শতাংশ জমি বিক্রি করতে গিয়ে সমস্ত সম্পদের মালিকানা হারিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী কার্তিকপুর গ্রামের এক প্রভাবশালী বাঙালি চাতুরি করে ৪৮ শতাংশের স্থলে ৪৮ কিয়ার (১৫৩৬ কাঠা) জমি এক দলিলে হাতিয়ে নেয়। গহীনগিরি শেষ জীবনে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে চালিয়েছেন সংসার। গহীনগিরির বাড়ির তালপুকুরের অস্তিত্ব দেখা যায় আজো। তবে তালগাছ নেই, গহীনগিরির মালিকানা তো গেছে সেই কবেই।

গহীনগিরি হাজংয়ের একমাত্র মেয়ে লক্ষ্মীরাণী হাজংয়ের ছেলে বিমল হাজং জানান, জামালপুর মৌজায় তার নানা গহীনগিরি হাজংয়ের ৫৭ একর চাষযোগ্য জমি এখনো প্রভাবশালীদের দখলে আছে। যা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গহীনগিরি হাজং ঘিলাগড়া গ্রামে মেয়ে লক্ষ্মীরাণীর বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দেশত্যাগী না হয়েও তার ৫৭ একর জমি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হয় কী করে? সেই প্রশ্নের উত্তর আজো খুঁজে চলেছেন বিমল হাজং।

উপজেলা আদিবাসী ট্রাইব্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হাজং নেতা অজিত কুমার হাজং বলেন, আমাদের আদিবাসী গ্রামগুলোতে ভূমি দখল, বিভিন্ন কায়দায় সংখ্যাগুরুদের নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে অহরহ। ভূমি দখলের মধ্য দিয়ে এখানকার হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সর্বহারা করে দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক ও ন্যায্যবিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছি। ভূসম্পত্তি হারানোর পাশাপাশি আমাদের সনাতনী জীবন প্রথা, আচার, ধর্ম, উৎসব, অভ্যাস ইত্যাদির ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্যও হারানোর পথে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সোহেল হাজং বলেন, সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছে আদিবাসীরা। আমরা সরকারের কাছে এ ভূমি কমিশন গঠন করে দেশের হাজংসহ সব আদিবাসীর ভূমি সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছি।