বমপার্টি কর্তৃক চুক্তি সমর্থকদের উপর উস্কানীমূলক অতর্কিত সশস্ত্র হামলা

0
1106

হিল ভয়েস, ১৯ এপ্রিল ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীদের মদদপুষ্ট বমপার্টি নামে খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সমর্থকদের উপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক এক অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই হামলায় চুক্তি সমর্থক এক নিরীহ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এই ঘটনাটি গত রবিবার ১৭ এপ্রিল ভোরের দিকে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়া/সাইজাম পাড়া (তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া) এলাকায় ঘটেছে বলে এলাকাবাসীর সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। ঘটনায় নিহত ব্যক্তির নাম এ্যাকশন চাকমা বলে জানা গেছে।

প্রতিপক্ষের কোনরূপ উস্কানী ছাড়াই বমপার্টি এই সশস্ত্র আক্রমণ চালায় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চুক্তি সমর্থক স্থানীয় এক গ্রামবাসী জানান। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে আবির্ভূত হতে না হতেই সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীদের মদদে বমপার্টি এই হামলার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক সশস্ত্র সংঘাতের সূত্রপাত ঘটালো বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে পার্বত্য চুক্তি সমর্থক কয়েকজন কর্মী রুমা উপজেলার সীমান্তবর্তী বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন। গত ১৬ এপ্রিল ২০২২ তারা বিলপাড়া গ্রামে জনৈক এক গ্রামবাসীর বাড়িতে রাত্রি যাপন করেন।

১৭ এপ্রিল ভোর প্রায় ৪:০০ টার দিকে বমপার্টির সশস্ত্র সদস্যরা কোনরূপ উস্কানী ছাড়াই চুক্তি সমর্থক কর্মীদের উপর অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায়। এই হামলায় এ্যাকশন চাকমা নামে একজন কর্মী প্রস্রাব করার জন্য বাড়ি থেকে বের হলে গুলিবিদ্ধ হন। এতে তিনি ঘটনাস্থলে নিহত হন। এছাড়া স্থানীয় একজন নিরীহ তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীও আহত হন বলে জানা গেছে।

পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করলেও কোন উস্কানী ছাড়াই বমপার্টির সশস্ত্র সদস্যরা একতরফাভাবে চুক্তি সমর্থক কর্মীদের উপর এভাবে অতর্কিত সশস্ত্র হামলা করবে এটা তারা ভাবতে পারেনি বলে চুক্তি সমর্থক একজন কর্মী জানান।

তিনি বলেন, বমপার্টি যে অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে বলে দাবি করছে, সেই দাবি  তো সরকার থেকেই আদায় করতে হবে। তাই আন্দোলনরত আরেকটি গোষ্ঠীর উপর এভাবে এত শীঘ্রই সশস্ত্র আক্রমণ করবে তা ভাবা যায়নি।

বমপার্টি (কেএনএফ)-এর দায় স্বীকার ও হুমকি:

এই উস্কানীমূলক হামলায় দায় স্বীকার করে ১৮ এপ্রিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট তাদের ফেসবুক একাউন্টে উল্লেখ করে যে, ‘গতকাল রাত থেকে সারাদিন আমাদের কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)-র “হেড হান্টার টিম”-এর দক্ষ কমান্ডোগণ অপারেটিভ ছিল।’

১৯ এপ্রিল আরেক স্টাটাসে কেএনএফ একইভাবে উল্লেখ করে যে, “আমাদের সুদক্ষ “হেড-হান্টার” কমান্ডোগণ দক্ষতার সাথে প্রতিপক্ষ জেএসএস’র জেএলএ নামক কমান্ডো ফোর্সকে পুরোপুরি সফলভাবে ঘায়েল এবং পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।” তবে জেএসএসের (জনসংহতি সমিতির) এ ধরনের কোন জেএলএ নামক কোন কমান্ডো ফোর্স আছে বলে জনসংহতি সমিতির এক নির্ভরযোগ্য সূত্র অস্বীকার করেন।

বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কেবল সশস্ত্র হামলার দায় স্বীকার করেনি, সেই সাথে হুমকিও দিয়ে চলেছে। ১৯ এপ্রিল দেয়া আরেক ফেসবুক স্টাটাসে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয় যে, “মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে অতীতের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে দূর্ধর্ষ কুকি বিদ্রোহ আবার শুরু হবে।”

স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে বিলাইছড়ির বড়থলি ও রুমা উপজেলার গ্রামে গ্রামে বমপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়ে চলেছে যে, চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, ত্রিপুরা গ্রামবাসীদেরকে কাউকে এই এলাকায় থাকতে দেয়া হবে না। এতে এলাকায় চরম হতাশা ও ভীতি দেখা দিয়েছে।

গ্রামবাসীর সূত্রে আরও জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে বমপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়া, বৈরেখ্যা ছড়া, খাঙগে ছড়া, টাইগার পাড়া ইত্যাদি তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আনাগোনা করছিল। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাউল, শুকর, হাঁস-মুরগী ইত্যাদি আদায় এবং নানাভাবে হয়রানি ও হুমকিপ্রদর্শন করে আসছিল। এতে এলাকাবাসীরা চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্যে আছে।

উল্লেখ্য, এসব গ্রামের অধিবাসীরা অধিকাংশই জুমচাষী ও গরীব। তাদের তেমন কোন খাদ্যশস্য বা চাউল জমা থাকে না। যৎসামান্য চাউল যা জমা আছে, সেগুলোও বমপার্টির সন্ত্রাসীরা জোর করে নিয়ে যাচ্ছে বলে গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেছে। আর ঘরে ঘরে গ্রামবাসীরা কিছু মোরগ-মুরগী, শুকর পালন করে থাকে, সেগুলোও জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুধু তাই নয়, এক বছরের অধিক সময় ধরে প্রত্যেক বম পাড়ার প্রতিটি পরিবার থেকে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে চাঁদা তুলে আসছে। আরো কিভাবে চাঁদা সংগ্রহ বাড়ানো যায় সে বিষয়ে গত ৪ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত গিলগাল বম পাড়ায় অনুষ্ঠিত বমপার্টির সভায় আলাপ-আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়।

আরো অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, বমপার্টি (কেএনএফ) সন্ত্রাসীরা শুধু বম পাড়াবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ক্ষান্ত হয়নি, বিভিন্ন চার্চের রেভারেন্ড বা পাস্টররাও বমপার্টির চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ধর্মীয় গুরুদের কাছ থেকেও তারা জোরপূর্বক চাঁদা তুলে চলেছে।

বমপার্টি গঠন এবং পার্বত্য চুক্তি ও চাকমা বিরোধী প্রচারনা:

‘ভাগ করো শাসন করো’ উপনেবিশক নীতির ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীদের মদদে ২০০৮ সালে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার নাথান বমকে সভাপতি ও ভাঙচুনলিয়ান বমকে সাধারণ সম্পাদক করে বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ও তাবেদার ব্যক্তি কর্তৃক কুকি-চিন ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে বমপার্টি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ঐ সংগঠনটির নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে এর সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করা হয়।

আবির্ভাব হওয়ার সাথে সাথে এই সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে এবং চাকমা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক প্রচারনা শুরু করে।

কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বমপার্টির নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টে ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রচার করা হয় যে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্মল্যান্ড নয়, এটি কুকি-চীন টেরিটোরি।”

উক্ত ফেসবুক একাউন্টে আরো বলা হয় যে, “পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি এবং তাদের গঠিত আঞ্চলিক পরিষদ কুকি-চীন জনগোষ্ঠীদের জন্যে নয়, এটা একটা চাকমা চুক্তি এবং চাকমা জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নমূলক পরিষদ মাত্র।”

ইসলামীদের সাথে বমপার্টির আঁতাত ও একসাথে অবস্থান:

বমপার্টি (কেএনএফ) ও শামীম মাহফুজ নামে প্রাক্তন জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের জঙ্গী নেতার নেতৃত্বাধীন “জামায়াতে আরাকান”-এর মধ্যে এক পারষ্পরিক সহযোগিতামূলক আঁতাত রয়েছে বলে জানা গেছে। সেই আঁতাত অনুসারে বমপার্টি ও জামায়াত আরাকানের সশস্ত্র সদস্যরা রুমা উপজেলার দুর্গম রেমাক্রী প্রাংসা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে একসাথে অবস্থান করে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সেনাবাহিনীর এজেন্ডা অনুসারেই বমপার্টি (কেএনএফ) ও জামায়াতে আরাকানের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে বলে জানা গেছে। উক্ত চুক্তি অনুসারে কেএনএফ মিজোরামের পারবায় ও জামায়াতে আরাকান ত্রিসীমানায় ক্যাম্প স্থাপন করবে, কর্তৃক কেএনএফ’কে জামায়াতে আরাকান মাসিক অর্থ সহায়তা প্রদান করবে এবং ইসলামী জঙ্গীদের জন্য বমপার্টি মিয়ানমার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারূদ ক্রয় ও সংগ্রহ করবে এবং সংগৃহিত অস্ত্রের একটা নির্দিষ্ট অংশ বমপার্টিকে দেয়া হবে।

গত ৪ এপ্রিল হিল ভয়েস কর্তৃক “জামায়াতে আরাকান ও কেএনএফের মধ্যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত” শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ইসলামী জঙ্গী সদস্যদেরকে বমপার্টি ক্যাম্প থেকে সরিয়ে নিকটবর্তী স্থানে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ইসলামী জঙ্গীদেরকে যাতে কেউ দেখতে না পায়, তজ্জন্য বমপার্টি সদস্যরা রুমা উপজেলার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের সিলৌপি পাড়ার দিকে বম গ্রামবাসীদেরকে যেতে বারণ করেছে।

বমপার্টির নেতারা একজন বম মুরব্বীকে বলছিলেন যে, কেএনএফের সাথে ইসলামী জঙ্গীরা যে অবস্থান করে থাকে এবং বমপার্টি সদস্যদের ভরনপোষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে, তা নাকি মিজোরামের লোকদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে। তাই ইসলামী জঙ্গীরা যাতে কারো চোখে না পড়ে সেজন্য রেমাক্রী প্রাংসার সিলৌপি পাড়ার উপরে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ সিলৌপি পাড়ায় কেউ গেলে ইসলামি জঙ্গীদেরকে তারা দেখতে পাবে।

ফলে আত্মীয়দের কাছে বা ধর্ম প্রচার করতে সিলৌপি পাড়ায় যেতে চাইলে অনেক বম চার্চের পাষ্টর, চার্চ এল্ডার এবং জনপ্রতিনিধিসহ অনেক বম গ্রামবাসীদেরকে শারিরীক নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বমপার্টির হাতে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তারা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। শারীরিক নির্যাতনের খবর কেউ ফাঁস করলে তাদেরকে হত্যা করা হবে বলে বমপার্টির সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়েছে। নির্যাতনের ঘটনা যাতে কেউ ফাঁস না করে সেজন্য অনেককে রাইফেলের গুলি মুখে দিয়ে শপথ বা প্রতিজ্ঞা করানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইসলামী জঙ্গীদেরকে যাতে কেউ না দেখে থাকে সেজন্য রাত-দিন বমপার্টি সদস্যদের পালাক্রমে পাহারা দিতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। ইসলামী জঙ্গীদের জন্য খাদ্য সামগ্রী থানচি বাজার থেকে বাকতলাই বম পাড়া হয়ে ফাইনোয়াম বম পাড়া পৌঁছে দেওয়া হয়। আর ফাইনোয়াম বম পাড়া থেকে আগে ইসলামী জঙ্গী সদস্যরা নিজেরাই বহন করে সেসব খাদ্য-সামগ্রী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেতো। কিন্তু কেএনএফের ক্যাম্পে ইসলামী জঙ্গীদের একসাথে অবস্থানের খবর জানাজানি ও প্রচার হওয়ার পর এখন ইসলামী জঙ্গীদেরকে ক্যাম্প থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। এখন বমপার্টির সদস্যরা ইসলামী জঙ্গীদের খাদ্য-সামগ্রীগুলো ফাইনোয়াম বম পাড়া থেকে নিজেরাই বহন করে নিয়ে ইসলামী জঙ্গীদের আস্তানায় পৌঁছে দিয়ে থাকে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।