পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম এর ১৭তম বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত

0
722

হিল ভয়েস, ২৩ জানুয়ারী ২০২২,বিশেষ প্রতিবেদক: গত ২১ জানুয়ারি ২০২২ সকাল ১০ ঘটিকায় বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি চাকমা ও অমর কৃষ্ণ চাকমার সভাপতিত্বে এশিয়ান হোটেলে পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত অনুষ্ঠানে উদ্ভোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক তাপস হোড়। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঐক্য ন্যাপ চট্টগ্রাম জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পাহাড়ি ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ল শরিফ চৌহান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলার সহ-সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা প্রমুখ। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ সভাপতি অনিল চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাপস হৌড় বলেন, আজকের বাংলাদেশে এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও যে আন্দোলন করতে হচ্ছে, সেখানা আমরা দেখতে পাই দেশে সুষ্ঠু ও শান্তিভাবে রাজনীতির চর্চা করার সুযোগ দিচ্ছে না। সরকারকে বার বার চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আবেদন করা হচ্ছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার তা কোনোভাবে বাস্তবায়ন করছে না বরং চুক্তির ধারাগুলি প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে চলেছে। পাহাড়ের সমস্যা পুরো বাংলাদেশের সমস্যা । আজকে পাহাড়ের চুক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে পাহাড়ী জনগণের শোষণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি করছে। যদি এভাবে সরকার প্রতিনিয়ত লঙ্গন করতে থাকে তাহলে জুম্ম জনগণ মানবেন্দ্র লারমার আদর্শকে ধারণ করে অধিকতর আন্দোলন করতে বাধ্য হবে।

বিশেষ আলোচকের বক্তব্যে নিপন ত্রিপুরা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর চলছে কিন্তু এ দেশের শ্রমিক, মেহনতি ও আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূলমন্ত্র ছিল জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার নিশ্চিত করা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হাওয়ায় এ পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল রুপ ধারণ করেছে। সরকার কর্তৃক চুক্তি বাস্তবায়নের কোন সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছেনা। উল্টো তাবেদার গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সমস্যাকে সমাধানের জন্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

সম্প্রতি ঢাকায় একটি আলোচনা সভায় জে এস এসকে দায়ী দেয়া চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে খুন করতে হবে এমন কোন ধারা লেখা আছে মন্ত্রী বীর বাহাদুরের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, পার্বত্য চুক্তি নিয়ে ঢাকায় আলোচনা সভা হয় কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরকারী জে এস এসের প্রতিনিধিকে আলোচনা সভায় রাখা হয় না। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কেবল চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ে আরও রক্ত ঝরবে। তার জন্য পিসিজেএসএস দায়ী থাকবেনা, তার দায় সরকারকে নিতে হবে। জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের আন্তরিক শুরু থেকে এখনো অবধি বজায় রেখে চলেছে।

তিনি দেশের অধিকার হারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ব্যক্তি সংগঠনকে অধিকতর সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান ।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রদীপ কুমার বলেন বিপ্লবীদের রক্ত বৃথা যায় না। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অতীত ইতিহাস সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। ৯৭ সালে চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে মনে করেছিলেন । কিন্তু সরকার চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না করায় পাহাড়ে আজ ভিন্ন শাসন চলছে। সংবিধানে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান বলেন, ঐতিহ্য ও জাতি অধিকার রক্ষায় অনিয়মতান্ত্রিক পথ শুরু হয় যখন নিয়মতান্ত্রিক পথ বন্ধ হয়। ১৯৭১ সাল হতে আজ পর্যন্ত পাহাড়ে যে পরিমাণ হত্যাকান্ড এবং মৃত্যু হয়েছে তা শুনলে শিউরে উঠি। আজকে ছাত্র ও যুব সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে পাহাড়ী জনগণকে মুক্তি দেওয়া। বর্তমানে পাহাড়ে চলাফেরার যে নিয়ম তা দেখে মনে হয় আমরা ভিন্ন জগতে আছি। আজকে পাহাড়ের মানুষ বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাছে অবরুদ্ধ। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করছি পাহাড়ী জনগণ আজ বঞ্চিত নির্যাতিত। রাষ্ট্র চরিত্র আজ পরিবর্তন হয়ে গেছে, যা দেখেছি সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। আজকের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে মিছিল দিয়ে হবে না।পাহাড়ের মানুষ আজ ভূমি হারাচ্ছে , সেটেলার ও প্রশাসনের মানুষ দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে এবং বড় বড় কোম্পানীর দ্বারা উচ্ছেদ হচ্ছে। তিনি আরো বলেন “পাহাড়ে জুম্ম জাতির অস্থিত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং রক্ত দিতে হবে রক্ত না দিলে কোথাও শান্তি আসবে না” ।

ঐক্য ন্যাপ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই বরং তাদেরকে নানাভাবে শোষণ করা হচ্ছে। পাহাড়ের মানুষ শ্রমজীবী মানুষ তারা আদিকাল থেকেই কৃষি কাজ করে আসছে আজ তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে নানা গার্মেন্টস কোম্পানীতে শ্রম বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করছে । আজকে শ্রমজীবী মানুষ চার সপ্তাহে বেতন ঠিকমত পায় না, শ্রমজীবী মানুষের আজকের যে অধিকার পাওয়ার কথা সে অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে নারী শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের যে চারনীতি ছিল তা সরকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার যে সংগ্রাম প্রথমে কিন্তু সশস্ত্র ছিল না। পরবর্তীতে শাসকগোষ্ঠীর যে অনিয়ম অত্যাচার অধিকতর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সশস্ত্র সংগ্রাম করতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ২৪ বছর সশস্ত্র সংগ্রামের পরে পার্বত্য চুক্তি হয়। চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সরকার দায়ী থাকবে।

দ্বিতীয় অধিবেষনে দিসন তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি এবং এলিন চাকমার সঞ্চালনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় অধিবেষন শুরু হয়। উক্ত অধিবেষনে আলোচক হিসেবে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক জগদীশ চাকমা,পিসিপি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রীয় তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি, চবি শাখার অর্থ সম্পাদক নরেশ চাকমা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সদস্য সন্তোষ চাকমা।

আলোচনা সভা শেষে অমর কৃষ্ণ চাকমা (বাবু) কে সভাপতি, জগৎ জ্যোতি চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক এবং জিশন চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।