পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজকে সামিল হতে হবে- রাঙ্গামাটিতে পিসিপি’র কাউন্সিলে সন্তু লারমা

0
340

হিল ভয়েস, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) রাঙ্গামাটি জেলা শাখার ২৪তম বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজকে সামিল হতে হবে। আজকের তরুণ-ছাত্র সমাজকে তাদের ঐতিহাসিক দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।

গতকাল ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাঙ্গামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট হলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে ছাত্র ও যুব সমাজ বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হউন’ শ্লোগান নিয়ে আয়োজিত পিসিপি’র এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রী সন্তু লারমা এসব কথা বলেন।

পিসিপি’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি মিলন কুসুম তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ম্রানু সিং মারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা। সভা সঞ্চালনা করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক টিকেল চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা আরো বলেন, একটা জাতির, একটি জনগোষ্ঠীর, গোটা বিশ্বের তথা একটি মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশে দেশে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, সমস্ত অঞ্চলে এই তরুণ সমাজেরই জয়জয়কার। আজকের এই তরুণ সমাজের ওপরই নির্ভর করছে, এই অঞ্চলের, এই রাষ্ট্রের, এই দেশের তথা সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যৎ। যুব সমাজ যেভাবে গড়ে ওঠে, যেদিকে ধাবিত হয়, সেই অঞ্চল, সেই জনগোষ্ঠী সেভাবেই ধাবিত হয়। বর্তমান ছাত্র-যুব সমাজকে জেনে নিয়ে, বুঝে নিয়ে আমাদের ছাত্র সমাজকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে এবং এই দায়িত্বটা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কর্মীদের ওপরই বেশি বর্তায়।

তিনি বলেন, পাকিস্তান শাসনামলে এবং অধুনা বাংলাদেশের শাসনামল পর্যন্ত পাহাড়ী ছাত্র সমিতির ভূমিকা ছিল বিশাল ও ব্যাপক। এই পাহাড়ী ছাত্র সমিতির কার্যক্রমের মধ্যে দিয়েই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর যে উপস্থিতি তাঁর যে ভূমিকা সেটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।

তিনি আরো বলেন, এক সময়ে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের স্বার্থ নিয়ে কারা কাজ করেছে? এই পাহাড়ী ছাত্র সমিতির নেতৃত্বেই ছাত্র সমাজ জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থ নিয়ে, জুম্ম জনগণকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, একটা সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠা করার কাজ তারা করেছে। তাদের মধ্য দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ হয়েছে এবং পরবর্তীতে তাদেরই নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ তাদের স্বাধিকার-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে গেছে। সেই প্রেক্ষিতেই আজকের তরুণ ছাত্র সমাজকে তাদের ঐতিহাসিক দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জুম্ম জনগণের সর্বোচ্চ ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা না বলা এবং সেই চুক্তি মানুষ যাতে ভুলতে পারে, ভুলে যেতে বাধ্য হয়, সেই প্রক্রিয়াই এখন পাহাড়ে চলছে। এই প্রক্রিয়াকে আজকের তরুণদের রুখে দিতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজকে সামিল হতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি সুমিত্র চাকমা বলেন, জুম্ম জনগণের ওপর সংঘটিত লংগদু গণহত্যার মতো জঘন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে, সংগ্রামী একটা আদর্শ ধারণ করে পিসিপি’র জন্ম হয়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ একটা বিশাল পাঠশালা। আদর্শিক চেতনা ধারণ করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কর্মীরা ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। রক্ত পিচ্ছিল সংগ্রামের পথ ধরে পিসিপির সংগ্রামের পথচলা। সংগ্রাম বেগবান করতে এম এন লারমার আদর্শ ধারণ করতে হবে।

পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা বলেন, সমাজকে জানতে সমাজ পরিবর্তনের সুশিক্ষা খুবই জরুরী। এই সুশিক্ষাটা আমাদের তরুণ ছাত্র-যুব সমাজে বর্তমানে ভীষণভাবে অনুপস্থিত। এই সুশিক্ষা প্রতিষ্ঠায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করে উল্টো চুক্তি বানচাল করতে হীন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। আগামী দিনগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে যেকোনো লড়াই সংগ্রামে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ যেকোনো দায়িত্ব কাঁধে নিতে প্রস্তুত বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং অবিলম্বে সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার জোর দাবি জানান তিনি।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ম্রানু সিং মারমা বলেন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম জনগণের সংগ্রামের আদর্শের প্রতীক। উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবসময় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পিসিপির সুদীর্ঘ পথচলা এখনো চলমান। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে পিসিপির নেতাকর্মীরা ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সমস্ত সংশয় আর দ্বিধা কাটিয়ে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে নিতে হবে।

আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% আদিবাসী কোটা চালু করারও দাবি জানান।

উল্লেখ্য, সম্মেলনের শুরুতে জাতীয় সংগীতের মধ্যে দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও দলীয় সংগীতের মধ্যে দিয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি মিলন কুসুম তঞ্চঙ্গ্যা। জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের পর বেলুন উড়িয়ে সম্মেলন ও কাউন্সিলের উদ্বোধন করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রতিনিধি সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক শ্যামা চাকমা, পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা। সভা পরিচালনা করেন পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ জিকো চাকমা।

পরবর্তীতে জিকো চাকমাকে সভাপতি, টিকেল চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও রনেল চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ২৭ সদস্য বিশিষ্ট নতুন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে শপথবাক্য পাঠ করান পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি থোয়াইক্য জাই চাক।