পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংরক্ষণে নাগরিক সমাজের সাথে সিএইচটি কমিশনের একাত্মতা প্রকাশ

0
205

হিল ভয়েস, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, পার্বত্য চট্টগ্রাম: ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন (সিএইচটি কমিশন) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তা সংরক্ষণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই আইন সংরক্ষণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সাথে সিএইচটি কমিশন একাত্মতা প্রকাশ করছে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞগণ আইনী প্রক্রিয়ায় ১৯০০ সালের শাসনবিধির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, এই আইনের মৌলিক দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি অশুভ চক্রান্তের সন্দেহ উদ্রেক করে।

গত বুধবার (২৭ সেপ্টম্বর), কমিশনের তিন কো-চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল, এলসা স্ট্যামাটোপলু এবং মিরনা কানিংহাম কাইন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, ২৭ নভেম্বর ২০১৬ দেশের সর্বোচ্চ আদালত, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওয়াগ্গাছড়া টি এস্টেট লিমিটেড বনাম মুহাম্মদ আবু তাহের এবং অন্যান্য, ১৬ বিএলডি (এডি), ৩৬ (২০১৬) মামলায় ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে একটি বৈধ ও কার্যকর আইন বলে ঘোষণা করে।

ইহা ২০১৭ সালের বাংলাদেশ সরকার বনাম রাঙ্গামাটি ফুড প্রোডাক্টস এ্যান্ড আদারস ৬৯ ডিএলআর(এডি) (২০১৭)-এ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে বাতিল করে, এবং হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ১৯০০ সালের সিএইচটি রেগুলেশনকে “মৃত আইন” হিসেবে ঘোষনা করে। অন্য কথায়, রাঙ্গামাটি ফুডস-এর মামলায় আদালত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির বৈধতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ওয়াগ্গাছড়া রায়ের ধারা অব্যাহত রেখেছে।

তবে ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ির দুই অভিবাসাী বাঙালি যাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয় অজ্ঞাত, তারা রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে উপরোক্ত দুটি রায়কে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, কেন এই আবেদনগুলি এখনও পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করা হয়নি তা নিয়ে আইনি বিশেষজ্ঞরা দু:খ প্রকাশ করেছেন, যা শুধুমাত্র সরকারের অবস্থানকেই নয়, সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও চ্যালেঞ্জ করেছে।

যেটা সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বর্তমান সরকারের উল্লিখিত নীতি ও ঘোষণার বিপরীতে, কীভাবে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী অ্যাটর্নি জেনারেল প্রথাগত আইন, “রাজা” ও “আদিবাসী” সম্পর্কিত অপরিহার্য শব্দ, বাক্য এবং অনুচ্ছেদ বাতিলের আবেদন করেছেন। গণ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, এটা পার্বত্য চ্ট্টগামের আদিবাসী সম্প্রদায় স্থায়ী নিবাসীদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, যেখানে স্বয়ং বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।

বিষয়টি নিষ্পত্তি কল্পে, পার্বত্য জেলাসমূহের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের এক প্রতিনিধি দল ১৯ জানুয়ারী ২০২২ এবং ২৬ জুলাই ২০২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন, যাতে বিষয়টির গুরুত্ব এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নাগরিকদের অধিকার, কল্যাণ এবং ঐতিহ্য বিশেষ করে আদিবাসী মানুষের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়।

সিএইচটি কমিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য অপরিসীম তাৎপর্য রয়েছে, কারণ এতে ঐতিহ্যগত আদিবাসী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সীমিত স্ব-শাসনের বিধান রয়েছে এবং প্রথাগত আইন, রীতি, ব্যবহার এবং পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট ভূমি, ভূখন্ড এবং সম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট জনগণের পারিবারিক আইনের প্রতি সংবেদনশীলতা রয়েছে। আইনটি উক্ত ভূখন্ডে বসবাসকারী আদিবাসীদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অনন্য ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।

আইনি প্রক্রিয়ায় ১৯০০ সালের শাসনবিধির সম্প্রতি প্রশ্ন তোলার প্রবণতাও একটা বড় উদ্বেগের বিষয়। যদি এই আইনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় বা কোনভাবে দুর্বল করা হয়, তবে এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের আরও প্রান্তিক করে দেবে এবং অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করবে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক এবং বহুসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের জন্যও এটা নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে।।

১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ১৯০০ শাসনবিধির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং সংশোধনের ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ও উপদেশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়া হয়েছে। আইনটি “মৃত আইন” হিসাবে ঘোষণা করা বা বাতিল করার যে কোনও প্রচেষ্টা এই চুক্তির চেতনার সাথে মৌলিকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং আরও জোর দিয়েছিলেন যে, ১৯০০ সালের বিধিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম ভিত্তি এবং ইহার যে কোনও পরিবর্তন করতে স্থানীয় জনগণের সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ধারাবাহিকভাবে ১৯০০ সালের শাসনবিধির সংরক্ষণের দাবি করে আসছে এবং একান্তভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সাথে ঐক্যমত্য থাকার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ বলবৎ রাখতে সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে এতদাঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সুরক্ষার জন্য সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের আহ্বান জানাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, এই শাসনবিধি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ (বাংলাদেশ কর্তৃক অনুমোদিত) এবং বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।