পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তপাত ও সংঘাতের জন্য সেনাবাহিনী তথা সরকারই দায়ী

0
2851
ছবি: প্রতীকী

                প্রীতিবিন্দু চাকমা                  

      সম্প্রতি গত ৭ জুলাই ২০২০ বান্দরবানের বাঘমারা বাজারে বন্দুক যুদ্ধে সংস্কারপন্থী নামে খ্যাত জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) এর দুই কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যেকার হানাহানি ও রক্তপাত বন্ধের দাবি আবারো জোরালো হয়েছে। এ নিয়ে দৈনিক সমকালে ১২ জুলাই ২০২০ প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক ও আদিবাসী জনগণের প্রাণের বন্ধু ড. রাহমান নাসির উদ্দিন মহোদয়ের ‘পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হোক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের স্বার্থে পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হওয়া নি:সন্দেহে অতীব জরুরী। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ হবে কিভাবে, যদি সেখানে রক্তপাতের জন্য প্রতিনিয়ত তাপ দেয়া হয়? যদি রাজাকারের ভূমিকা নিতে কোন না কোন গোষ্ঠীর আর্বিভাব হয়?

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়, যা শান্তিচুক্তি নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম প্রভাবশালী অঙ্গ- দেশের তিন বাহিনীর সমর্থনে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। সরকার চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়িত করলেও চুক্তির মৌলিক ধারাসমূহ, যেগুলোর উপর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার ভিত্তি নির্ভর করে এবং যে ধারাগুলোতে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণ ও স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীদের স্বশাসনের অধিকার নিহিত রয়েছে, সেসব ধারাসমূহ বিগত ২৩ বছর ধরে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে।

বিগত ২৩ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও চুক্তিতে স্বীকৃত স্বশাসনের অধিকার প্রদানে মোটেই আগ্রহী ছিল না। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনে তিন বাহিনীসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গের সমর্থন থাকলেও তারা চুক্তির প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা বিগত ২৩ বছরে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ গোষ্ঠী নানা টালবাহানা চালাতে থাকে, তেমনি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ও চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে।

সেই ষড়যন্ত্রেরই ফসল হচ্ছে পাহাড়ে অবিরত রক্তপাত। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হতে না হতেই পিসিপির একটা অংশ চুক্তির বিরোধিতা শুরু করে, যারা পরে ১৯৯৮ সালে প্রসিত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ আদায় কিংবা অন্য যে কোন মাপের অধিকার আদায়ের যতই মহান লক্ষ্যই থাকুক না কেন, তারা অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে আগত জেএসএসের সদস্যদের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সশস্ত্রভাবে হামলে পড়ে, যা কখনোই রাজনৈতিক দূরদর্শীসম্পন্ন ছিল না। ফলে এক পর্যায়ে জেএসএসের কিছু সদস্যও সশস্ত্র উপায়ে তার পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। এটা বললে হয়তো ইউপিডিএফের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারবে না, তবে বাস্তব সত্য যে, এসময় ইউপিডিএফের সশস্ত্র সদস্যরা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে ক্যাম্পের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে পার্বত্য চুক্তি সমর্থকদের উপর চড়াও হয়েছিল। তাতে করে সংঘাত ও রক্তপাত আরো বেশি ত্বরান্বিত হয়ে উঠে। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য স্থানীয় ও উচ্চ পর্যায়ে অনেক বার বৈঠক হয়েছে। সমঝোতা চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু পরষ্পরের প্রতি আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাবের কারণে, সর্বোপরি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের কারণে বারে বারে সমঝোতা চুক্তি ভেঙ্গে যেতে থাকে।

জরুরী অবস্থার দুর্দিনে দলের মধ্যে ঐক্য-সংহতি বজায় রাখার পরিবর্তে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর মদদে জেএসএসের কতিপয় নেতা-কর্মী দলের মধ্যকার অনিয়ম ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার নামে উপদলীয় চক্রান্তে মেতে উঠে।

২০০৭-২০০৮ জরুরী অবস্থা চলাকালে দেশের সামরিক বাহিনী জরুরী অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত ‘সংস্কার’-এর আওয়াজ তুলে যেভাবে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দমন-পীড়ন চালিয়েছিল ও রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে ভাঙ্গন ধরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতির উপরও দমন-পীড়ন চালিয়েছিল এবং সমিতির নেতৃত্বের মধ্যকার বিভাজনকে উস্কে দিয়েছিল। সেই জরুরী অবস্থার দুর্দিনে দলের মধ্যে ঐক্য-সংহতি বজায় রাখার পরিবর্তে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর মদদে জেএসএসের কতিপয় নেতা-কর্মী দলের মধ্যকার অনিয়ম ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার নামে উপদলীয় চক্রান্তে মেতে উঠে। ফলে জেএসএস ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সম্মেলনে সেসব সংস্কারপন্থী নেতা-কর্মীদের বহিস্কার করে। পক্ষান্তরে পাল্টা হিসেবে একই বছরে সংস্কারপন্থীরা এক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে সুধাসিন্ধু খীসা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমার নেতৃত্বে ‘জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)’ নামে পৃথক রাজনৈতিক দল ঘোষণা করে। সেই সময় ইউপিডিএফও সেই সংস্কারপন্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে জেএসএসের মধ্যেকার বিভাজনকে উস্কে দিয়েছিল।

এভাবে জেএসএস-ইউপিডিএফের মধ্যকার তথা পার্বত্য চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যকার দ্বিমুখী সংঘাতের সাথে আরেক পক্ষ হিসেবে সংস্কারপন্থী গোষ্ঠী যুক্ত হয়ে পড়ে। সংঘাতের মেরুকরণ হয়ে দাঁড়ায় এক পক্ষে জেএসএস ও অন্যপক্ষে ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থী। এক পর্যায়ে বিদ্যমান বাস্তবতা ও তিন পক্ষের আগ্রহের ফলে জেএসএসের সাথে ইউপিডিএফের এবং জেএসএসের সাথে সংস্কারপন্থীদের পৃথক দু’টি সমঝোতা সংলাপ শুরু হয়। এর ফলে তিন পক্ষের মধ্যে সংঘাত ও হানাহানি অনেকটা বন্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ২০১৫ সাল থেকে হানাহানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়। হানাহানি বন্ধ হতে দেখে ষড়যন্ত্রকারী সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে ঘুম হারাম হয়ে যায়। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে কিভাবে আবার সংঘাত বাঁধিয়ে দেয়া যায় তা নিয়ে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। সেনাবাহিনীর সাহায্যপুষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন হলুদ নিউজপোর্টাল থেকে অনবরত অপপ্রচার হতে থাকে, বাঙালিদের বিরুদ্ধে হলে কিভাবে আঞ্চলিক দলগুলো ভেদাভেদ ভুলে একাত্ম হতে পারে। বাইরে তারা চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ হলেও কার্যত তারা ‘এ’ টিম ও ‘বি’ টিম ইত্যাদি।

এমনি এক অবস্থায় ইউপিডিএফের কিছু হঠকারী কর্মসূচির ফলে সেনাবাহিনী ইউপিডিএফের উপর তাদের আশির্বাদ থেকে তুলে নিতে থাকে। বিশেষ করে এসব হঠকারী কর্মসূচির মধ্যে ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রাক্কালে খাগড়াছড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রচারসভায় যোগদানে লোকজনকে বাধা প্রদান, শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বর্জন ইত্যাদি অন্যতম ছিল। ফলে সেনাবাহিনী ইউপিডিএফ’কে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সংস্কারপন্থীদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিতে থাকে।

তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে সেনাবাহিনীর মদদে সংস্কারপন্থীদের উদ্যোগে ইউপিডিএফ থেকে বহিস্কৃত ও নিষ্ক্রীয় সদস্যদের নিয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নাম দিয়ে তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা ও শ্যামল কান্তি চাকমা জোলেইয়ের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্রগোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠিত হওয়ার সাথে সাথে সেনাবাহিনী ও সংস্কারপন্থীদের মদদে প্রসিত-রবি শংকরের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সদস্যদের উপর সশস্ত্র হামলা শুরু করে। ফলে থেমে যাওয়া সংঘাত ও হানাহানি আবার শুরু হয়। তার মধ্যে ২০১৮ সালের মে মাসে এক সশস্ত্র হামলায় নান্যাচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে খুন, তার পরের দিন আরেক হামলায় তপন জ্যোতি চাকমাসহ ছয় জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকিথত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আবার গতিশীল হয়ে উঠে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জেএসএস প্রার্থীর বিপক্ষে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে সংস্কারপন্থীরা সশস্ত্রভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে ভোট চুরিতে সহায়তা করলে সেই সংঘাত চার পক্ষের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। বর্তমানে সংস্কারপন্থীরা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘বি’ টিমে পরিণত হয়েছে। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-মুজাহিদ বাহিনী যে ভূমিকা নিয়েছিল, সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপগুলোও সেই রাজাকার-মুজাহিদের ভূমিকা গ্রহণ করে। বস্তুত এই দুটি গোষ্ঠী এখন সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব বিদেশী সশস্ত্র সংগঠন ‘আরাকান লিবারেশন পার্টি’ (এএলপি) সদস্যদেরকে রাঙ্গাামাটি জেলার রাজস্থালী ও কাপ্তাই এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা ও সদর উপজেলায় নিয়ে আসে। সেই সাথে জেএসএসের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীও এএলপিকে মদদ দিতে থাকে। সম্প্রতি এএলপির স্থানীয় মারমা সদস্যরা এএলপি থেকে বের হয়ে তথাকথিত ‘মগ পার্টি’ নাম দিয়ে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটায়।

শুধু তাই নয়, নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানোর জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব বিদেশী সশস্ত্র সংগঠন ‘আরাকান লিবারেশন পার্টি’ (এএলপি) সদস্যদেরকে রাঙ্গাামাটি জেলার রাজস্থালী ও কাপ্তাই এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা ও সদর উপজেলায় নিয়ে আসে। সেই সাথে জেএসএসের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীও এএলপিকে মদদ দিতে থাকে। সম্প্রতি এএলপির স্থানীয় মারমা সদস্যরা এএলপি থেকে বের হয়ে তথাকথিত ‘মগ পার্টি’ নাম দিয়ে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটায়। সেই মগ পার্টিকেও নিজেদের কায়েমী স্বার্থে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। মগ পার্টির সাথে সংস্কারপন্থীদের সংযোগ সৃষ্টিতে মদদ দিয়ে চলছে সেনাবাহিনী। “স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এই সংগঠনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন” বলে ১৩ জুলাই ২০২০ সমকাল পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এমনকি তাদের সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোকে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে অস্ত্র ও গোলাবারুদও সরবরাহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০০৭-২০০৮ সালে দেশে জরুরী অবস্থার সময় যেভাবে ইউপিডিএফ’কে সমর্থন দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলীতে এবং বান্দরবান জেলার বালাঘাটায় ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যদের নেয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি সেনাবাহিনী এসকর্ট দিয়ে বর্তমানেও সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপগুলোকে খাগড়াছড়ি থেকে বরকলের সুবলঙে, রাঙ্গামাটির জীবতলীতে, দীঘিনালার বাবুছড়ায়, বান্দরবানের বাঘমারায় নিয়ে আসে। তারই আলোকে “প্রভাবশালী একটি পক্ষ সংস্কারপন্থী গ্রুপটিকে বান্দরবানে তাদের তৎপরতা চালাতে সহায়তা করে” বলে ৯ জুলাই ২০২০ দৈনিক পূর্বকোণের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সেসব জায়গায় নিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাদেরকে অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে সুযোগ করে দেয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দেখিয়ে দেয়া টার্গেটে হামলা করে তারা প্রতিপক্ষ সদস্যদের হত্যা করে চলেছে। ফলে প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলোও সুযোগ পেলে এর প্রতিশোধ নিতে ভুল করছে না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে কোন রাজনৈতিক সংগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র থাকবেই, তাই বলে সেই ষড়যন্ত্রে আঞ্চলিক দলগুলো পা দেবে কেন? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে কোন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যেমনি আত্মবলিদানে উৎসর্গিত দেশপ্রেমিক লোক থাকে, তেমনি থাকে মীরজাফর বা রাজাকারের দলও। শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে আঞ্চলিক দল নামধারী অনেকেই সেই মীরজাফর বা রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তপাত বন্ধ না হয়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আশার দিক যে, পার্বত্য চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ মূল গ্রুপগুলোর মধ্যে এখনো সংঘাত বন্ধ রয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে তারা আবার সংঘাত জড়িয়ে না পড়ুক সেটাই সকলেই কামনা করছেন।

এভাবেই আজ সেনাবাহিনী তথা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত ও হানাহানি জিইয়ে রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অত্রাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে কেন সেনাবাহিনী তথা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত ও হানাহানি উস্কে দিচ্ছে? সাদামাদাভাবে দেখলে এটা বিশ্বাসই করা যায় না কেন সেনাবাহিনী তথা সরকার পার্বত্যাঞ্চলে হানাহানিতে উস্কে দেবে। কিন্তু বিষয়টি গভীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, সরকার তথা সেনাবাহিনী কখনোই চায় না পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক জুম্ম জনগণ স্বশাসনের অধিকার ফিরে পাক। তারা চায় না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অটুট থাকুক। চুক্তির মৌলিক ধারা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সেটেলার বাঙালিরা বেদখলকৃত জুম্মদের জায়গা-জমি ফেরত দিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যেতে বাধ্য হোক।

তাই পার্বত্য চুক্তিকে ভন্ডুল করতেই শাসকমহল পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত ও হানাহানিতে মদদ দিয়ে চলেছে। মদদ দেয়ার পেছনে সেনাবাহিনী তথা শাসকমহলের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা; জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে ধ্বংস করা, সর্বোপরি অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে নির্বিঘ্নে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা। এর পেছনে সেনাবাহিনীর বিশেষ স্বার্থ হচ্ছে সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি দেখিয়ে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অজুহাতে পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে বৈধতা প্রদান করা, তথাকথিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারী গ্রেফতারের মাধ্যমে পদোন্নতি লাভ করা, সর্বোপরি তাদের মদদপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর চাঁদাবাজির একটা মোটা অংশ লাভ করা। সংস্কারপস্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র গ্রুপের চাঁদাবাজির অংশ সেনাবাহিনীর স্থানীয় ক্যাম্প কম্যান্ডার থেকে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির নিকট নিয়মিত পৌঁছে যায় বলে কথিত রয়েছে। নিজেদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে তাই সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও সেনাবাহিনীর তরফ থেকে ঠনকো অজুহাত তুলে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক দলগুলোর অবৈধ অস্ত্র, হানাহানি ও সংঘাত। বস্তুত হানাহানিতে আঞ্চলিক দলগুলো যতই লিপ্ত থাকুক না কেন, কিন্তু তারা তো আর চুক্তি মোতাবেক স্বশাসন প্রতিষ্ঠা, বেহাত হওয়া জমি পুনরুদ্ধার, পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণসহ চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে না।

ভয়ে সেনাবাহিনীর কথা উল্লেখ করা না হলেও ১৩ জুলাই ২০২০ সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে তার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে। উক্ত সংবাদে বলা হয় যে, “ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের পেছনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ইন্ধন রয়েছে। অন্তর্কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি বিষয়টি মিডিয়ার সামনে এনে ঘটনার প্রকৃত কারণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না করার যুক্তি তৈরির জন্যই এসব সংঘাতের সৃষ্টি করা হয়।”

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের পেছনে চাঁদাবাজি বড় বিষয় নয়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সেনাবাহিনী তথা শাসকগোষ্ঠীর সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কিন্তু সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের ভয়ে দেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেউই এই বাস্তব সত্যকে তুলে ধরতে পারে না।

এখানে ড. রাহমান নাসির উদ্দিন মহোদয় যথার্থই বলেছেন যে, যখনই এধরনের হত্যাকান্ড ঘটবে, তখনই এটিকে ‘চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং আধিপত্য বিস্তারের’ বয়ান দিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সংঘাত ও হানাহানির পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি যে মোটেই নেই তা নয়। যে কোন সংগ্রামে অর্থ শক্তি একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিপ্লবী দল হোক কিংবা সশস্ত্র দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী হোক অর্থ ছাড়া তাদের কোন কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই যে কোন সশস্ত্র গোষ্ঠী চাঁদা তুলবেই। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বনজ সম্পদ আহরণ ও পরিবহনে সেনাবাহিনী ও বন বিভাগসহ প্রশাসনের ঘাটে ঘাটে যে চাঁদা দিতে হয় তার তুলনায় আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদা আদায়ের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর ক্ষমতাসীনদের টেন্ডারবাজি, লুটপাট ও উন্নয়ন কার্যক্রমের উপর অফিস-আদালতে যে নিদিষ্ট হারে পারসেন্টিজ দিতে হয় তার তুলনায় আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজির পরিমাণ তো আদার বেপারীর জাহাজের খবর নেয়ার মতো। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের পেছনে চাঁদাবাজি বড় বিষয় নয়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সেনাবাহিনী তথা শাসকগোষ্ঠীর সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কিন্তু সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের ভয়ে দেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেউই এই বাস্তব সত্যকে তুলে ধরতে পারে না। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যতই দমন-পীড়ন ও ষড়যন্ত্র হোক না কেন প্রত্যেকে সুকৌশলে দেখেও না দেখার ভান করে কিংবা বুঝেও না বুঝার ভান করে এড়িয়ে গিয়ে থাকেন।

শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলো যে হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে তার দায় অবশ্যই আঞ্চলিক দল নামধারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও এড়িয়ে যেতে পারে না। তবে তার জন্য যত না আঞ্চলিক দলগুলো দায়ী, তার থেকে বেশি দায়ী সেনাবাহিনী তথা সরকার। কারণ শাসকগোষ্ঠীর ইন্ধনের কারণে থেমে যাওয়া সংঘাত ও হানাহানি বারে বারে ঘুরে ফিরে জীবন্ত হয়েছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানি বন্ধ করতে হলে শাসকগোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্রকে গুড়িয়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ষড়যন্ত্রের এই দুষ্টচক্র বন্ধ করতে না পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তপাত কখনোই বন্ধ হবে না। শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ষড়যন্ত্রকে নির্মূল করার মাধ্যমে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করার মধ্য দিয়েই কেবল পার্বত্যাঞ্চলে সংঘাত ও রক্তপাত বন্ধ হতে পারে বলে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।