জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

0
415
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সূবর্ণ জয়ন্তী ও ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

১ম অংশ: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠনের পটভূমি
মঙ্গল কুমার চাকমা

আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সুবর্ণ জয়ন্তী অতিক্রম হতে যাচ্ছে। ৫১ বছর পূর্বে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই ঐতিহাসিক দিনে মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের অধিকারকামী দেশপ্রেমিক অংশের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করা হয়। এরপর থেকে বিগত পাঁচ দশকের অধিক সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার গৌবরময় সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদান করে আসছে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ছিলেন সামন্ত রাজার অধীন স্বাধীন সার্বভৌমত্বের অধিকারী। স্বাধীন সামন্ত শাসনামলে জুম্ম সমাজে অভিজাত ও প্রজা শ্রেণিই ছিল সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি। অভিজাত শ্রেণিই হলো শাসক আর এই অভিজাত সম্প্রদায় শাসনের নামে প্রজা শ্রেণির উপর চালাতো মধ্যযুগীয় নির্মম শোষণ ও নিপীড়ন।সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পদানত হওয়ার পর সামন্তবাদী শাসন-শোষণের সাথে আরো চেপে বসে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচয়, স্বকীয় স্বশাসনব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে জুম্ম জনগণের অধিকার সচেতন ও দেশপ্রেমিক অংশ সুপ্ত বাসনা পোষণ করতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ঔপনিবেশিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে জুম্ম জনগণের শিক্ষিত ও সচেতন যুব সমাজ সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে এবং জুম্ম জনগণের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে কিছু রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম প্রয়াস হিসেবে ১৯১৫ সালে রাজমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে চাকমা যুবক সমিতি (১৯১৫) গঠন করা হয়। এই সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ জুম্ম জনগণের মধ্যে শিক্ষা প্রসার ও জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিশ ও ত্রিশ দশকে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তম্মধ্যে বিশিষ্ট সমাজসেবী, শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত ও ঘুঁণেধরা সামন্ত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কৃষ্ণ কিশোর চাকমার অবদান ছিল সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।

এরপর ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কামিনী মোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে সীমিত ছিল। অন্যদিকে চাকমা যুবক সংঘ নামে ১৯২৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে একটি সংগঠন গঠিত হয়। এই সংঘের কার্যকাল অল্প হলেও জুম্ম জাতির জাতীয় চেতনা উন্মেষের ক্ষেত্রে একটা মাইলস্টোন হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ১৯৩৯ সালে যামিনীরঞ্জন দেওয়ান ও স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। এভাবেই জুম্ম সমাজে জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম যুব সমাজই সর্বপ্রথম স্বৈরাচারী সামন্ত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গণে যুগান্তকারী উত্থান ঘটে চল্লিশ দশকে যখন স্নেহ কুমার চাকমা ও ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির রাজনৈতিক কার্যক্রম জোরালো আকার ধারণ করে। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে শক্তিশালী জাতীয় চেতনাবোধ উন্মেষ হতে না পারায় জুম্ম জাতির স্বার্থ সংরক্ষণে ব্রিটিশ সরকার কোন সুব্যবস্থা তো করে দেয়ইনি, বরং কোন এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে জড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে যায়।

ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে ভারতপন্থী আখ্যায়িত করে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে এবং জুম্ম জনগণের প্রতি চরম বৈষম্য ও বঞ্চনার আশ্রয় নেয়। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পদক্ষেপ হিসেবে গোড়া থেকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভারতপন্থী অজুহাতে ধরপাকড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন চালাতে থাকে জুম্ম জনগণের উপর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই ১৯৪৮ সালের চিটাগং হিল ট্রাক্টস ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন বাতিল করা হয়। পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তান সরকার এতদঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার হরণের প্রক্রিয়া তলে তলে শুরু করে দেয়। একদিকে উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তানের শাসন, অন্যদিকে সেই শাসনেরই আজ্ঞাবহ সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব এই দুই শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে জুম্ম জনগণের সার্বিক অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে উঠে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি মেনে চলার জন্য যদিও পাকিস্তান সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু তা নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেআইনী অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে। পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে লঙ্ঘন করে ভারতের বিহার থেকে আসা হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান করা হয়।

এরপর জুম্ম জনগণের কোনরূপ মতামত না নিয়ে জুম্ম জনগণের জায়গা-জমি পাইকারীভাবে হুকুমদখলের উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম (ভূমি অধিগ্রহণ) প্রবিধান নামক কালো আইন জারি, ১৯৬০ সালে জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ও লক্ষাধিক মানুষকে উচ্ছেদ, ১৯৬১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংশোধন করে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার খর্ব করা, ১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন-বহির্ভুত মর্যাদা তুলে দিয়ে ট্রাইবাল এরিয়ায় রূপান্তর এবং ১৯৬৩ সালে সেই ট্রাইবাল এরিয়ার মর্যাদাও বাতিল করার ষড়যন্ত্র, কাপ্তাই বাঁধের পর বহিরাগত মুসলমানদের অবাধ অনুপ্রবেশের দ্বার খুলে দেয়া, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ স¤প্রদায়ের সংরক্ষিত আসন বাতিল করা ইত্যাদি একের পর এক হীনকার্যক্রম বাস্তবায়ন করে পাকিস্তান সরকার, যা সচেতন ও দেশপ্রেমিক জুম্ম জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে প্রবলভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

বস্তুত জুম্ম জনগণের জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে জুম্ম ছাত্র সমাজ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেনি। পাকিস্তান সরকারের হীনকার্যক্রম খুবই গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তার উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এই উপলব্ধির উপর ভিত্তি ১৯৫৬ সালে দেশপ্রেমিক ও অধিকার সচেতন ছাত্র সমাজ সম্মিলিত হয়ে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি পুনরুজ্জীবিত করে এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়া তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নিকট পেশ করে। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ায় এক ঐতিহাসিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎপরবর্তী সময়ে বিশেষত ১৯৬০ সাল থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ১৯৬২ সালের ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম বান্ডেল রোডস্থ পাহাড়ি ছাত্রাবাসে জুম্ম ছাত্রদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে এম এন লারমা জুম্ম ছাত্র সমাজকে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে জুম্ম সমাজের শিক্ষা বিস্তারসহ জাতীয় জাগরণের সূত্রপাত করার আহ্বান জানান। সম্মেলনে শ্লোগান উঠে গ্রামে ফিরে যাও, জুম্ম জনতাকে অধিকার সচেতন করে তোলো, ঘুঁণেধরা প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত নেতৃত্বের উপর আঘাত হানো। এম এন লারমার ডাকে শুরু হলো নতুন পদযাত্রা। এম এন লারমার এই আহ্বান জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে সুদূর প্রসারী ভূমিকা পালন করে থাকে। এভাবে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের লক্ষ্যে শুরু হলো জাতীয় উন্মেষ সাধনের অব্যাহত প্রচেষ্টা।

এম এন লারমা ১৯৬০ সালে জুম্ম জনগণের বুকের উপর নির্মিত কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের হীন মুখোশ উন্মোচন করে ১৯৬২ সালের আগস্টে এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে কাপ্তাই বাঁধের ফলে জুম্ম জনগণের ৫৪ হাজার একর জমি হ্রদের পানিতে তলিয়ে যাওয়া, লক্ষাধিক লোকের উদ্বাস্তু ও ভিটেমাটি হারানো, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন না দেয়া ইত্যাদি অন্যায়-অবিচার তুলে ধরা হয়েছিল। বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছিল উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসনের। এই বিবৃতি প্রচারের ফলে পাকিস্তান সরকার এম এন লারমাকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত করে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করে। এ্যাডভোকেট লুৎফুল হক মজুমদারসহ বাঙালি হিতাকাঙ্খী দেশ্রপ্রেমিক বিপ্লবী বন্ধুদের অকান্ত প্রচেষ্টায় প্রায় দুই বছর জেল খাটার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ এম এন লারমা জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

অপরদিকে বিশিষ্ট সংস্কৃতি কর্মী সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে ‘ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ’ নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয়, যেখানে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা। বিশেষ করে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই সংগঠন কাজ করে থাকে, যা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।

বস্তুত ষাট দশকের প্রথম থেকে এম এন লারমার নেতৃত্বে অধিকারকামী ও দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুব সামজ সংঘবদ্ধ হয়ে জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েছিলেন। তখন থেকেই গোপনে গোপনে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হতে থাকে। সেসময় শাসনতান্ত্রিক বাধা-নিষেধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশ্য রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। তবুও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সচেতন বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-যুব সমাজ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নের কার্যকলাপের আড়ালে ব্যাপক জুম্ম জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করে অধিকার সচেতন করে তুলতে থাকে।

১৯৬৫ সালে রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম একটি বেসরকারি কলেজ স্থাপিত হয়। এতে সমগ্র শিক্ষাঙ্গণ তথা জাতীয় জীবনে নবদিগন্তের সূত্রপাত ঘটে। পরের বছর ১৯৬৬ সালে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করা হয়। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নতুন করে রাঙ্গামাটি কলেজ ভবনে উদ্বোধন করা হয়। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎসময়ে ছাত্র-যুব নেতা ও শিক্ষাবিদ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে জুম্ম ছাত্র সমাজকে দেশ গঠনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯৬৬ সাল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত হওয়ার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও কিছু সংখ্যক দেশপ্রেমিক তরুণের নেতৃত্বে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি গঠিত হয়। এই সংগঠন পরবর্তীতে জুম্ম জনগণের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল। সেই সময় রাজনৈতিক দল গঠন করা কঠিন ছিল। তাই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নামে উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি গঠন করে প্রকারান্তরে রাজনৈতিক কাজ চালানো হতো। এই সমিতি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল জুম্ম জনগণের মধ্যে ঐক্য-সংহতি জোরদার করা এবং প্রগতিশীল জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো।

এই সময়েই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষক সমিতি’। এসব সংগঠন প্রতিষ্ঠায় পাহাড়ি ছাত্র সমিতির ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এভাবে শুরু হলো জাতীয় উন্মেষ সাধন ও জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলার মহান কর্মকান্ড। এসব সংগঠনের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি ও পাহাড়ি ছাত্র সমিতি একযোগে দেশ ও জাতি গঠনের কাজ করে যেতে থাকে। এই দু’টি সংগঠনসমূহের মাধ্যমে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার মহান কর্মযজ্ঞ। তারই অংশ হিসেবে উপজাতীয় কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে ১৯৭০ সালে ৩১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানখিয়া পাড়াস্থ বৌদ্ধ বিহারে জুম্মদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

তখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছয়দফা আন্দোলনের জোয়ার। এই জোয়ারে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজও সিক্ত না হয়ে থাকতে পারেনি। জুম্ম ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী সমাজও জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক সচেতন করার পাশাপাশি ছয়দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ছয়দফার দাবিতে জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী সমাজ বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল, ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি পালন করতে থাকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের পাশাপাশি প্রগতিশীল জুম্ম তরুণ সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরে।

১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের যথাক্রমে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল আসন থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি কল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে জুম্ম তরুণ সমাজের দেশপ্রেমিক অংশকে নিয়ে গঠিত হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’। এই সংগঠনের ইসতেহারে নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্তশাসনসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকারের দাবি উত্থাপন করা হয়। ব্যাপক সাংগঠনিক উদ্যোগের ফলে জুম্ম জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে সাদরে বরণ করে নেয়। ফলে ’৭০ সালের এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থীসহ অন্যান্য সকল প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে এম এন লারমা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে জয়যুক্ত হন। এম এন লারমার নেতৃত্বে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে শুরু হলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

ছয়দফা দাবিতে সারাদেশের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলও আন্দোলিত হয়েছিল। সে সময় জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও দোকানপাট রাস্তা-ঘাট অচল করে দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম-বাঙালি জনগণ সম্মিলিতভাবে। ১৯৭১ সালে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এই সময়ে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি তথা জুম্ম জনগণ চুপ করে বসে থাকতে চায়নি। এম এন লারমার নেতৃত্বে জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে।

এম এন লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির ছাত্র, পাহাড়ি যুবক ও স্থানীয় বাঙালি যুবকরা মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণের জন্য রাঙ্গামাটিস্থ পশু সম্পদ অফিস সংলগ্ন স্টেশন ক্লাবে তিনদিন ব্যাপী লাঠি নিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন ডেপুটি কমিশনার এইচ টি ইমাম ও আওয়ামীলীগের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা কমিটির সাইদুর রহমান জুম্মদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাঙালি যুবকদের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠিয়ে দেন। জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত রাখতে তারা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হয়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকেন। তাদেরই প্ররোচনায় জুম্ম ও বাঙালি ছাত্র-যুবকদের মধ্যে কৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়। অতি সুকৌশলে শত শত জুম্ম ছাত্র-যুবকদেরকে এই মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। তা সত্তে ও বিভিন্ন উপায়ে অনেক জুম্ম ছাত্র-যুবক এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকে। জুম্ম জনগণ এই আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জ্ঞাপন করে থাকে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহু ত্যাগ তিক্ষিতার, বহু মা-বোনের ইজ্জত ও বহু মানুষের তাজা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে অভ্যূদয় ঘটে। জাতিগত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটেছে সেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় তাদের উপর চলমান জাতিগত শোষণ-বঞ্চনার অবসান হবে এবং হৃত অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠিত হবে এমনটাই আশা করেছিল আদিবাসী জুম্ম জনগণ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে প্রবেশ করে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অজুহাতে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পানছড়িতে সমবেত হওয়া জুম্মদের মধ্যে ১৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। এছাড়া সেদিন প্রায় দুই শতাধিক জুম্মদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা দলটি। এরপর পানছড়ি-খাগড়াছড়ি-কুকিছড়া-দীঘিনালা-বড়মেরুং এলাকায় অনেক পাহাড়িকে হত্যা করা হয়। অপরদিকে শত শত নিরপরাধ জুম্মদেরকে বিভিন্ন অভিযোগে নানা প্রকারের সাজা দেয়া হতে লাগলো। ধরপাকড়, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, ডাকাতি, রাহাজানি নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা হয়ে পড়ে। ফেনী উপত্যকায় বহিরাগত বাঙালি মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জুম্মদের জায়গা-জমি বেদখল করতে থাকে। পাকিস্তান সরকার যা করতে সাহস করেনি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশ সরকার তা করতে মোটেও দ্বিধাবোধ করেনি।

(চলবে)……………………..