জনসংহতি সমিতির সুবর্ণজয়ন্তী: লড়াইয়ের উত্থান-পতন ও গৌরবময় সংগ্রাম

0
1036

মিতুল চাকমা বিশাল

ভূমিকা:

১৫ ফেব্রুয়াবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে সামন্তবাদ, আমলা পুঁজিবাদ, উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম এবং শোষণহীন ও বৈষম্যহীন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে মহান পার্টির যাত্রা শুরু। পার্টি আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৫০ বছরে পদার্পন করেছে। পার্টির সুবর্ণজয়ন্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ সহ দেশ-বিদেশের অধিকারহারা, শোষিত-নিপীড়িত ও বঞ্চিত জাতি মানুষদের জানাই সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও বিপ্লবী অভিবাদন। যুগে যুগে সামন্তবাদ, সম্রাজ্যবাদের নগ্ন থাবায় যেসমস্ত জাতি-মানুষেরা আজ নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হয়ে অসহায় হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে, যেসমস্ত সংগ্রামী সহযোদ্ধা বন্ধুগণ আজও সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ আর সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের কৌশলী লড়াই পরিচালনা করছে, তাদের প্রতি রইল ভালোবাসা।

জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, সংগ্রামের উজ্জ্বল দ্বীপশিখা মহান পার্টির লড়াইয়ের এই সূদীর্ঘ সময়ে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, পোড় খেয়ে হয়ে উঠেছে আরো প্রগতিশীল, আরো বিপ্লবী। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি প্রতিবাদের আর প্রতিরোধের দেয়াল তুলে দেয়ার শক্তি তাই জনসংহতি সমিতি এখনো রাখে। রাজনৈতিক লাইনের নির্ভূলতা,সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য (শোষণহীণ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা, জুম্ম জসগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি) এবং তার ভিত্তিতে অকুতোভয় হয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ায় পার্টি আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বনরূপার এক নিভৃত স্থানে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। যার প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে ছিলেন বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা এবং সদস্য-সচিব হিসেবে ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। পেশাগতভাবে তারা সকলেই ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক। পার্টির মনোগ্রাম হিসেবে “প্রদীপ” (চাকমা ভাষায় চাদি) নির্ধারণ করা হয়, কেননা ১৯৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এম এন লারমা এই প্রদীপ প্রতীক নিয়েই জয়লাভ করেছিলেন এবং এই প্রদীপকে জুম্ম জনগণের জীবন ও ঐতিহ্যর প্রতীক হিসেবে মেনে নিয়েই পার্টির মনোগ্রাম হিসেবে নির্বাচন করা হয়। পার্টির পতাকা হচ্ছে লাল-সাদা অংশের উপর স্বর্ণ খচিত তারকা। এখানে লাল অংশ হচ্ছে সংগ্রামের প্রতীক,সাদা অংশ শান্তির প্রতীক এবং উজ্জ্বল স্বর্ণ তারকা সাম্য, ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।

জনসংহতি সমিতির উত্থান ও সংগ্রাম:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে নয়া-গণতান্ত্রিক চীনের উত্থান ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ঢেউ জাগিয়ে তোলে। বিশেষ করে কিউবা (১৯৫৯), লাওস (১৯৭৫), ভিয়েতনাম (১৯৭৬), উত্তর কোরিয়ার (১৯৪৮) মতো প্রভৃতি দেশে মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রগতিশীল ব্যবস্থা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জাতিগত, ধর্মীয়গত ও সংস্কৃতিগত ভিন্ন ভিন্ন নিপীড়িত-নির্যাতিত জাতি মানুষদেরকে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে অনুপ্রাণিত করে তোলে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তুমুল জোয়ারে স্বাধীন হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ওঠে বহু রাষ্ট্র। বলা যায় বিংশ শতাব্দীর পুরো সময়টা, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত এই ধারা ছিল অব্যাহত। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে সেই জোয়ারে কিছুটা ভাটা নেমে আসে এবং উভয় দিক থেকে সংরক্ষণশীলতার নীতি গ্রহণের বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়।

১৯৪০ সালের পাকিস্তানের লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন, তৎপরবর্তী ২৩শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয়। ঐতিহাসিক এই ৬ দফার মূল উদ্দেশ্য ছিল, “পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।” পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। সেই আন্দোলনের ধারায় বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা অধিকার আদায়ের এই সুমহান সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু জাতীয়তাবাদের উগ্র আচরণে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়। অধিকন্তু ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পানছড়ি, ফেনী-রামগড় এলাকায় মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের হাজার হাজার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও জুম্মদের গুলি করে হত্যা করার মত জঘন্য ঘটনা সংঘটিত হয়, যা জুম্মদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরাও এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। তাই তো জাতীয় অস্তিত্ব এবং স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্য নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত ৪ দফা দাবিনামা (স্বায়ত্তশাসন) পেশ করা হয়।

ধারণা করা হয়েছিল, বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে জাতি এক সুমহান যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদরকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে দাঁড় করাতে পারে, তারা অবশ্যই তাদের রাষ্ট্র সীমানার অভ্যন্তরে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্য সংস্কৃতির জাতিসমূহের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, পার্বত্য জুম্ম জনগণের সেই ৪ দফা দাবিনামাকে সেদিন সরাসরি নাখোজ করে দেওয়া হয়েছিল, এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন সেই দাবিনামাকে জুম্ম প্রতিনিধিদের সামনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। সেদিন জুম্ম প্রতিনিধিদেরকে বসতেও পর্যন্ত বলেননি বলে জানা যায়। এমনকি সেইদিন বঙ্গবন্ধু হাতের তুড়ি মেরে মেরে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে জুম্মদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার হুমকি প্রদান করেন। যা পাহাড়ের পরিস্থিতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। একইদিন রাঙমাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরুর প্রাথমিক কয়েকটি বছর (১৯৭২-১৯৭৬) ছিল প্রস্তুতি পর্যায়ের, যে স্তরে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা এবং সংগঠিত করা হয়। এই লক্ষ্যে পার্বত্যঞ্চলের শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। শিক্ষার বার্তা নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনগণকে সচেতন করা এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার এই সুমহান কাজটি তারাই করেছিলেন।

তৎপরবর্তী ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে জুম্ম জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবিতে “বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি”র নিকট ৪ দফা দাবিনামা পেশ করা হয়। কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সেই দাবিটিকে নাখোঁজ করে দিয়ে এক কলমের খোঁচাতে দেশের জনগণকে বাঙালি বানিয়ে দিলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু গণতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায় হচ্ছে না, বরং উল্টোভাবে উগ্র জাতীয়াবাদের থাবায় দেশের সমগ্র জনগণকে বাঙালি বানিয়ে দেওয়া হলো।

অপরদিকে দেশের সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা ও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা, আলিকদম ও দীঘিনালায় স্থাপন করা হয় তিনটি ক্যান্টনমেন্ট। বস্তুতপক্ষে নিরাপত্তা নয়, জুম্মদের নায্য দাবি-দাওয়া এবং তাদের আন্দোলনকে সামরিক উপায়ে দমন-পীড়নের উদ্দেশ্য নিয়েই এই সেনানিবাসগুলো স্থাপন করা হয়। এই সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রণাধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে স্থাপন করা হয় ৫৪৫টি অস্থায়ী সেনা, আনসার, ভিডিপি ও বিপিবিএন ক্যাম্প মোতায়েন করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সামরিক অধ্যূষিত এলাকাতে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জন পাহাড়ির পিছনে ১ জন সৈনিক নিয়োজিত হয়ে পড়ে। অস্থায়ী এই ক্যাম্পগুলোই হয়ে উঠে পাহাড়িদের নির্যাতন-নিপীড়ন, হয়রানি করার অন্যতম একেকটি হাতিয়ার। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি পাহাড়িদের অসন্তোষ আরো চরম আকার ধারণ করতে থাকে।

গণমুক্তি ফৌজ, যা শান্তিবাহিনী নামে সমধিক পরিচিত লাভ করে, প্রতিষ্ঠার পরে পার্টির সাংগঠনিক কাজ আরো দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। এই পর্যায়ে পার্টিকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ, ডাকাত দল ইত্যাদির সাথে লড়াই করতে হয়। বোমাং রাজার সশস্ত্র সংগঠন বামায়াতা, ট্রাইবাল পিপলস পার্টি, পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি (সিরাজ সিকদার) ইত্যাদি গ্রুপের সাথে পার্টিকে সাংগঠনিকভাবে এবং সশস্ত্রভাবে লড়াই পরিচালনা করতে হয়। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডাকাত দলকে গণমুক্তি ফৌজ দৃঢ়হস্তে দমন (১৯৭৩-১৯৭৪) করে, এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিল। বিশেষ করে বন্দুকভাঙায় পরানধন ডাকাত দল, নানিয়াচরে শম্ভুহুলো ডাকাত দল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে ডাকাতদের অত্যাচারে পার্বত্যবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং তাদের কারণে গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছিল। সেই ডাকাত দলগুলোকে নির্মূল করায় পাহাড়ে অনেকটা শান্তি ফিরে এসেছিল, তাই পার্বত্যবাসী এই গণমুক্তি ফৌজকে “শান্তি বাহিনী” হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং পরবর্তীতে এই নামটিই সার্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে, দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়ে যায়। সামরিক জান্তারা দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে সমগ্র দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকেও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ছেড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম বিলাইছড়ির ফারুয়া বিজিবি ক্যাম্প আক্রমণ করে জনসংহতি সমিতি তার সশস্ত্র সংগ্রামের যাত্রা শুরু করে। একই বছরে জিয়াউর রহমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নত করে এতদঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ১৯৭৬ সালে এক অধ্যাদেশ জারী করে উন্নয়ন বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় (১৯৭৮ সালে থেকে কাজ শুরু করে) এবং চট্টগ্রামে অবস্থিতি সেনাবহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসিকে এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। বস্তুতপক্ষে এই বোর্ড পাহাড়ীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বদলে বাইরে থেকে সামরিক কার্যক্রমে সহায়ক উন্নয়ন কর্মকান্ড ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিন্নমূল বাঙালিদের পুনর্বাসনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়ে ওঠে।

একদিকে সেনাশাসন, অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন পাহাড়কে অশান্ত থকে অশান্ততর করে তোলে। সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে পার্বত্য জুম্ম জনগণকে ধ্বংস করার, সমূলে উৎখাত করার হীনযজ্ঞে মেতে ওঠে। ১৯৭৯ সালে ২৬মে খাগড়াছড়ির এক জনসভয় ব্রিগেডিয়ার হান্নান এবং কর্ণেল আব্দুস সালাম প্রকাশ্যে বলেন যে, “We want the land and not the peoples of CHT”।

এমতাবস্তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থতি এক ভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৭০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত সকল পাহাড়ীদের সমতলে বদলী, ৭১ সালে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গুলি করে হত্যা-ধর্ষণ, ৭২ সালে জুম্মদের শাসনতান্ত্রিক অধিকারের দাবীকে শেখ মুজিব কর্তৃক বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং লক্ষ লক্ষ বাঙালি পুনর্বাসন করার হুমকি, ৭৩ সালে শেখ মুজিব কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণ স্বরুপ দীঘিনালা, আলিকদম ও রুমায় সেনানিবাস স্থাপন, ৭৬-এ জিয়াউর রহমান কর্তৃক পাহাড়ের সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন ও ৭৯-৮২ সাল পর্যন্ত ৪ লক্ষাধিক বাঙালিকে সমতল থেকে পাহাড়ে পুনর্বাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম অসন্তোষ জাগিয়ে তোলে এবং এতদঞ্চলের জনমানুষকে লড়াইে ঝাঁপিয়ে পড়তে আরো বেগবান করে।

জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথও খোলা রাখে। তারই ফলশ্রুতিতে প্রথমে জেনারেল জিয়া শান্তিপূর্ণ সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু সামরিক অভ্যূত্থানে তাঁর মৃত্যুতে সেই উদ্যোগ আর এগোতে পারেনি। এরপর প্রবল আন্দোলনের ফলে জেনারেল এরশাদ জনসংহতি সমিতির সাথে সংলাপও বসতে বাধ্য হয়। জেনারেল এরশাদ সরকারের প্রতিনিধিদলের সাথে প্রথম বৈঠকে সরকার পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু জেনারেল এরশাদ সংলাপে অবতীর্ণ হলেও তলে তলে জুম্মদের সুবিধাবাদী দুলা গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করে সংলাপ প্রক্রিয়া থেকে সরে পড়ে। এরপর খালেদা জিয়া সরকারের সাথে ১৩ বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো খালেদা জিয়া সংলাপের নামে কেবল কালক্ষেপণ করেছিল। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ষষ্ঠ বৈঠকে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা পূর্ববর্তী শাসকদের মতো পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের নামে জুম্ম জনগণের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ফলে এখনো পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অর্জিত হয়নি।

লড়াইয়ের উত্থান-পতন ও সংগ্রামের বিভিন্ন রূপ:

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির দীর্ঘ লড়াইয়ে,অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। কখনও আন্দোলনের সুতীব্র জোয়ার অথবা কখনও চরম সংকটময় পরিস্থিতি অথবা কখনও একেবারে ভাটায় পরিণত হয়েছে। পার্টির প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে শুরু করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পার্টির রাজনৈতিক এবং সামরিক কার্যক্রমকে ধ্বংস করতে নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। কিন্তু পার্টি দূরদর্শী এবং সুকৌশলী নেতৃত্বের দ্বারা সেইসমস্ত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও নিজেকে ধরে রেখেছে এক শক্তিশালী অবস্থানে। আমরা দেখতে পেয়েছি প্রতিষ্ঠালগ্নের শুরুতে পার্টি গণতান্ত্রিকভাবে অধিকার আদায়ের জন্য প্রচেষ্টা করেছে। তৎপরবর্তী ১৯৭৫ সালে সেনা অভ্যূত্থানের কারণে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে পার্টিও তার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ছেড়ে সশস্ত্র রুপ পরিগ্রহ করে এবং চলতে থাকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর উপর একের পর এক আঘাত।

১৯৮২ সালে পার্টির ২য় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। পার্টির ভেতরকার লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদী, ক্ষমতালোভী একটি অংশ চেয়েছিল পার্টির সর্বময় ক্ষমতার কর্তৃত্বকে বলপ্রয়োগ করে লুপে নিতে৷ এটি ছিল পার্টির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক চরম সংকট। পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা প্রীতি কুমার চাকমা প্রকাশ, ভবতোষ দেওয়ান গিরি, ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান পশাশ, দেবজ্যোতি চাকমা দেবেন-রা স্বার্থের মোহে অন্ধ হয়ে তথকথিত দ্রূত নিষ্পত্তির আওয়াজ তুলে পার্টিতে বিভেদের সুত্রপাত ঘটায়। বাস্তবিকপক্ষে এটি ছিল পার্টির আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক একটি ষড়যন্ত্র৷ কিন্তু তথাকথিত দ্রূতনিষ্পত্তির আওয়াজ তোলা সেই গিরি-প্রকাশরা শাসকগোষ্ঠীর সেই ষড়যন্ত্রকে গভীরভাবে বুজতে সক্ষম হয় নি এবং শাসকগোষ্ঠীর পাঁতা ফাঁদে পা দিয়ে পার্টিকে এক চরম সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।

সত্য বলতে কি, একটি প্রশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেরিলা বাহিনীর যে অত্যন্ত সুকৌশলে সন্তর্পনে অগ্রসর হতে হয়, গিরি-প্রকাশ গং স্বার্থের লোভে পড়ে সেটাই বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। পার্টি ছিল নীতিগতভাবে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে বিশ্বাসী, সেখানে সেই বিভেদপন্থীরা হঠাৎ করেই দ্রুত নিষ্পত্তির আওয়াজ তুলেছিল।

আর তাদের সেই হঠকারিতার ফলস্বরুপ ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর জুম্ম জাতি হারিয়েছে তাদের প্রাণপুরুষ মহান নেতা মানবেন্দ্র নারয়ণ লারমাকে। যা পার্টির তথা সমগ্র জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অপূরণীয় ক্ষতি। মহান নেতার সেই অভাব কোনদিনই পূরণ হবার নয়।

তদূপুরি বর্তমান সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা’র সুযোগ্য নেতৃত্ব সেই বিভেদপন্থীদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করে। পার্টি থেকে সেইসকল সুবিধাবাদীদের বিতাড়িত করে পার্টি আরো দূর্বার গতিতে তাদের আন্দোলন সংগঠিত করে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়াস চলমান রাখে।

১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার ফলে পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় লড়াই পরিচালনায় মনযোগ দেয়। এটিও একটি পর্যায় এবং রূপও বটে। চুক্তির “ঘ” খন্ডের ১২নং ধারা অনুযায়ী জনসংহতি সমিতি অস্ত্র জমাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এই লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ১০ই জানুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে জা্কজমকপূর্ণভাবে এই অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠিত হয়। পুরো স্টেডিয়াম এবং এর আশেপাশের এলাকা কড়া নিরাপত্তার বলয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছিল,যাতে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা না ঘটে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক এই যে, এত কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও তথাকথিত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের নামধারী পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের একটি বিরোধী অংশ চুক্তিকে কালো চুক্তি বলে অভিহিত করে এবং গ্যালারিতে “এই চুক্তি কালো চুক্তি, কালো চুক্তি মানি না, No full autonomy, No rest” ইত্যাদি লেখা সম্বলিত ব্যানার প্রদর্শন করে। যা পার্বত্যবাসীকে হতবাক না করে পারেনি। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পরে যেখানে রণক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শান্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে শুভেচ্ছা জানানোর কথা, তার বদলে তাদেরকে করা হলো অপমান। ইতিহাসের পাতায় আরো একটি কলম্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হলো এর মধ্যদিয়ে। কিন্তু কারা এই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকামী গোষ্ঠী?

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের কতিপয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সম্মিলন হচ্ছে পিসিপি৷ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান প্রভৃতি এলাকার কলেজ-বিশ্ববিদযালয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনসমুহের মিলনক্ষেত্রই পিসিপি। কিন্তু কতিপয় পিসিপির কর্মীদের অনিয়ম, উচ্ছাকাঙ্ক্ষা আর উচ্চাভিলাষ পিসিপিতে ভাঙন ধরিয়ে দেয়। শুরু থেকেই প্রসিত-সঞ্চয়রা দলের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের ছিদ্রানুসন্ধান করতে থাকে এবং ভেতরে ভেতরে জনসংহতি সমিতির নামে মিথ্যাচার করতে থাকে। নব্বই-দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই প্রসিত-সঞ্চয়রা একটি স্বতন্ত্র পার্টি গঠনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে এবং ৯৫ সালের শেষের দিকে তারা “পাহাড়ি গণপরিষদ” এর নাম পরিবর্তন করে “ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট” নামে একটি পার্টি গঠনের প্রচেষ্টা চালায়।

প্রসিত খীসার একগুয়েমি, একতরফা ও হতকারী সিদ্ধান্তের কারণে খোদ পিসিপির মধ্যেও তার গ্রহণযোগ্যতা লোপ পেতে থাকে এবং একপর্যায়ে উপদলীয় চক্রান্ত শুরু করতে থাকে। ১৯৯৫-৯৬ সালের ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার কাউন্সিলে প্রসিতদের প্যানেল নির্বাচিত হতে না পারায়, ১৯৯৬ সালের ৯ আগস্ট প্রসিত চক্রের নেতৃত্বাধীন ৭ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য একসাথে পদত্যাগ করে, যা অত্যন্ত হাস্যকরও বটে।

ধীরে ধীরে পাহাড়ি ছাত্র সমাজের আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্তি ও অন্তর্দ্বন্দের দিকে ঠেলে দেয় প্রসিতরা। ৯৭ সালের ১০ মার্চ একতরফাভাবে, কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ এর নামে “পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন”-এর নাম করে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। যা এই দ্বন্দ্বকে আরে উচ্চমাত্রায় বিকশিত করে। পরবর্তীতে পিসিপির ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলকে ঘিরে মতপার্থক্য এবং প্রসিত-সঞ্চয়দের উগ্রতা ও একগুয়েমির কারণে পিসিপি দ্বিখন্ডিত হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তকে অমান্য করে বিশেষ করে খাগড়াছড়ি পিসিপির অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্যারালাল একটি কমিটি গঠন করে পিসিপিকে চূড়ান্তরুপে বিভক্ত করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর চুক্তি বিরোধী অপশক্তি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ” ইউপিডিএফ” নাম দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে প্রসিত-সঞ্চয়রা এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসা জনসংহতি সমিতির সদস্যদেরকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করতে শুরু করে।(দেখুন,কেওক্রডং–Voice of PCP, পিসিপির লড়াইয়ে বিভেদপন্থীদের উত্থান, মিতুল চাকমা বিশাল, ২০২০)।

অপরদিকে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে সারাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার আনয়নের ধূঁয়ো তুলতে শুরু করে। সেই সংস্কারের হাওয়া এসে লাগে মাহন পার্টির অভ্যান্তরে নখ লুকিয়ে থাকা কিছু উচ্চাভিলাসী, ক্ষমতালিপ্সু, স্বার্থন্বেষী ব্যক্তির কাছে। পার্টি ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের কোন চিহ্ন না দেখিয়ে তারা প্রকাশ্যে নেতৃত্বের সমালোচনা এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির মত নোংরা প্রলাপ বকতে শুরু করে। অথচ সংস্কারের ধোঁয়া উড়ানো সেই সুধাসিন্ধু, তাতিন্দ্রলাল, শক্তিমান, চন্দ্রশেখর, বিমল কান্তিরাই পার্টির নীতি-আদর্শের কথা এমনভাবে বলত, যেন তত্ত্বকথার কোন গল্পও হার মেনে যায়।

দলীয় শৃঙ্খলা তথা পার্টির শৃঙ্খলা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে বিসর্জন দিয়ে একতরফাভাবে পার্টি সভাপতির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করতে শুরু করে এবং পার্টিতে সংস্কার আনয়নের জোর দাবি তুলে ধরে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তারা পরবর্তীতে জনসংহতি সমিতি (সংস্কার), তারও পরে জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নাম দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।

ইউপিডিএফ এবং সংস্কারপন্থী উভয়েরই সৃষ্টি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে। ইউপিডিএফ নিজেকে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি করলেও তাদের প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ সময় পরেও তারা তাদের মূল স্পিরিট নিয়ে কোন কর্মসূচি দিতে পারেনি। অপরদিকে সংস্কারপন্থী অংশটিও বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্রের তাবেদার হয়ে পড়ে রয়েছে। আলোচনার বদলে নতুন দল সৃষ্টি করে তারা কেবল পাহাড়ের সংঘাতকেই উস্কে দেয়নি,বরং জুম্ম জাতীয় আন্দোলনে বিরাট ক্ষতি করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় মদদে প্রকাশ্যে চুক্তি উত্তর স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসা জনসংহতি সমিতির সদস্যদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে উক্ত সংগঠনগুলো জনসংহতি সমিতির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।

ইউপিডিএফ এবং সংস্কারপন্থীদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে জনসংহতি সমিতি হারিয়েছে অনেক ত্যাগী, সাহসী ও যোগ্য কর্মীকে। এই দুই সংগঠনের আবির্ভাব পার্টিকে কোনঠাসা করতে না পারলেও, সাময়িকভাবে পার্টিকে যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, সেটা অনস্বীকার্য। যার ফলে পার্টির রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনায় নিরাপত্তার চরম অভাব সৃষ্টি হয় এবং চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একধরনের ভাটা নামিয়ে আনে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো সবকটিই রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের ফল৷ ক্ষতালিপ্সু, সুবিধাভোগী আর স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের ধরে ধরে রাষ্ট্র পার্টির বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছে এবং এখনো লাগাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, ১৯৮৩ সালের বিভেদপন্থী কর্তৃক মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার খুন এবং তৎপরবর্তী গৃহযুদ্ধে পার্টি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সরকার সেই সুবিধাকে কাজে লাগায়। তারপরেও পার্টি সেই দূরাবস্থাকে অতিদ্রূত কাটিয়ে ওঠে দূর্বার গতিতে তাদের আন্দোলন সংগঠিত করে। অন্যদিকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বিতর্কিত একটি অংশ কর্তৃক ইউপিডিএফ নামে আত্মপ্রকাশ এবং জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে অবস্থান ও জরুরী অবস্থার সময়ে সুবিধাবাদী পেলে-সুধাসিন্ধু কর্তৃক দলত্যাগ ও নতুন দল গঠন পার্টির তথা জুম্ম জনগণের আন্দোলনে বিরুপ বাধা সৃষ্টি করেছে। সেই সময়ের কঠিন ও অচলাবস্থা থেকেও পার্টি খুব সহজেই সাহসের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায় এবং শাসকগোষ্ঠীকে দেখিয়ে দেয় যে,পার্টি থেকে সুবিধাবাদীদের বিতাড়ন করলে পার্টি দুর্বল হয় না, বরং আরো শক্তিশালী হয়। সেইসাথে শাসকগোষ্ঠীকে এটাও বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয় যে, জেএসএস’কে ধ্বংস করা এত সহজ নয়।

অপরদিকে এরশাদ সরকার কর্তৃক ১৯৮৩ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা এবং তৎপরবর্তী ১৯৮৯ সালে স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠনের ফলে চাকরি ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে বাধা দেয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধ বিদ্ধস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াকু অনেক সহযোদ্ধার আত্মবলিদান এবং দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে রণক্লান্ত হয়ে অনেকেই সরকারের সেই প্রনোদনা গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেষ্টা করে, এই প্রক্রিয়াটিও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির সমিতির চলমান আন্দোলনে কিছুটা হলেও ভাটা তৈরি করে। তবে শত বাধা, শত প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতা স্বত্ত্বেও পার্টি তার আপন লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে চলেছে।

বর্তমান আন্দোলনের উপলব্ধি ও সংগ্রাম:

বর্তমান সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি এক সংকটময় মূহুর্ত অতিক্রান্ত করছে৷ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার ২৫টি বসন্ত পার হতে চললেও সরকার এখনো চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বস্তুতপক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোন সদিচ্ছা বা উদ্যোগ কোনটাই দেখা যাচ্ছে না। বরং চুক্তিকে নানাভাবে, নানা অজুহাতে লঙ্ঘন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সেনাশাসন কায়েক করে চট্টগ্রামস্থ ২৪ পদাতিক ডিভিসনের হাতে পাহাড়ের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক অস্থায়ী সকল সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত পাহাড়ের ৪০০টির অধিক সেনাক্যাম্প রয়েছে এবং প্রত্যাহারকৃত অনেক ক্যাম্প পূনঃস্থাপন করা হয়েছে।

অপরদিকে সমতল অঞ্চল থেকে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়াও চলছে সমান তালে। সেই সাথে ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), আরাকান লিবারেশন পার্টি’র দলচ্যুত অংশ মগ লিবারেশন পার্টি, রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আএসও প্রভৃতি সংগঠন দিয়ে জনসংহতি সমিতিকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। পার্টির নিম্নস্তরের সংগঠন থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত, সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফেরারী করে রাখা হয়েছে এবং পার্টির অধিকাংশ নেতা-কর্মী এখন নিরাপত্তাজনিত কারণে আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

পাহাড়ে যেকোন ঘটনা সংঘটিত হলেই এখন সেটা জেএসএস এর নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা যায় এ এক নব্য সংস্কৃতি চালু হয়েছে পাহাড়ে। যে দলের সাথে রাষ্ট্রের পক্ষ থকে সরকার চুক্তিতে উপনূত হয়েছে,সেই দলকেই এখন সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিনিয়ত ধর-পাকড়ের মধ্যে রাখা হয়েছে। তাছাড়া এটিও একটি বাস্তব সত্য যে, এমতাবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করলে আবারো সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু হবে,তার যথেষ্ট সম্ভাব্যতা রয়েছে। কেননা জুম্ম জনগণ এখন অতিমাত্রায় সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক অনিরাপদ জীবন নির্বাহ করছে।

উপসংহার:

সংগ্রামের এই সুমহান লড়াইয়ে জনসংহতি সমিতি লাভ করেছে কঠিন-কট্টর ও তিক্ত হাজারো অভিজ্ঞতা। এই সুদীর্ঘ সময়ে অনেক ভাঙা গড়ার মধ্যদিয়ে পার্টিকে য়েতে হয়েছে, পার্টি হারিয়েছে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র মত মহান নেতাকে,হারিয়েছে অনেক সাহসী ও অকুতোভয় তরুণ যোদ্ধাকে, যারা নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করে গেছেন স্বর্ণ তারকা খচিত লাল-সাদা অবয়বের উজ্জ্বল পতাকাকে। জাতির বিভেদপস্থী, সুবিধাবাদীদের বিতাড়ন করে পার্টি যেমন আরো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়ে আবির্ভূত হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আগামীকেও শাসকগোষ্ঠির শত বাধা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অত্যান্ত গৌরবের এবং সাহসের সাথে পার্টি তার স্বর্ণ তারকা খসিত লাল-সাদা ঝান্ডাকে উঁচিয়ে রাখবে এবং জুম্ম জনগণের এই সুমহান আন্দোলনকে জারী রাখবে।