ছয় মাসে পার্বত্যাঞ্চলে দমন-পীড়ন ও সামরিকায়ন জোরদার হয়েছে- জনসংহতি সমিতি

0
1563

হিল ভয়েস, জুলাই ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রামপূর্বের সরকারগুলোর মতো শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারও জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি একেবারে বিলুপ্ত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সামরিকায়ন জোরদার করেছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদনেবলেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক ৬ জুলাই ২০২০ সোমবার প্রকাশিত “জানুয়ারি-জুন ২০২০ পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদন” শীর্ষক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, বিগত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন২০২০) পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের তৎপরতা জোরদার করেছে। ফলে ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ একপ্রকার রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। পূর্বের সরকারগুলোর মতো বর্তমান সরকারও জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি একেবারে বিলুপ্ত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সামরিকায়ন জোরদার করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আন্দোলনরত জুম্মদেরকে ক্রিমিলাইজেশনের অংশ হিসেবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিগত ছয় মাসে সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক ৭২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই ৭২টি ঘটনায় ২ জনকে বিচার বহির্ভূত হত্যা, ২৭ জনকে অবৈধ গ্রেফতার, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ২২ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও হয়রানি, ৫৩টি বাড়ি তল্লাসী, ৩টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন, সেনাবাহিনীর উন্নয়নে ১৬৭ পরিবার ক্ষতির মুখে ও ২টি জায়গায় ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে জানুয়ারি-জুন ২০২০-এর মধ্যে সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির কর্মকান্ড বিস্তারে প্রত্যক্ষ ও উলঙ্গভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। বিগত ছয় মাসে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), এএলপি ও তথাকথিত মগ পার্টি কর্তৃক ৫৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই ৫৯টি ঘটনায় ১৩ জনকে হত্যা, ২৭ জনকে অপহরণ ও তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়, ১০ জনকে মারধর ও হয়রানি, ৬ জনকে হুমকি প্রদান, এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির জন্য ৩টি জায়গায় ফাঁকা গুলি বর্ষণ, ১৬ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের, এএলপি/মগ পার্টি কর্তৃক ১২টি বাড়ি অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

প্রাণঘাতি কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও বহিরাগত ভূমিদস্যু কর্তৃক ভূমি জবরদখল, জুম্ম গ্রামবাসীদের নানাভাবে হয়রানি ও উচ্ছেদ করে অবাধে চলছে। বিগত ছয় মাসে মুসলিম সেটেলার কর্তৃক ২৩ ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। এই ২৩টি ঘটনায় ৪ জন জুম্ম নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা, জুম্মদের উপর ২টি সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল কিংবা বেদখলের চেষ্টায় ৮১৮ পরিবার ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখী, জুম্ম গ্রামবাসীদের ৩,০২১ একর জায়গা জবরদখল, ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে জুম্মদের বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের ও ২ জনকে গ্রেফতার এবং প্রায় ৫,০০০ একর রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার শরণার্থী ক্যাম্প পালিয়ে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা বান্দবানে অনপ্রবেশ করেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা জঙ্গীগোষ্ঠী অবৈধভাবে ইয়াবাসহ মাদক দ্রব্য ও স্বর্ণ ব্যবসা চালাচ্ছে।

সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর উদ্যোগে গত ৫ ডিসেম্বর ২০১৯ মুসলিম সেটেলার, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সকল সংগঠনগুলোর বিলুপ্ত করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ নামে একক সংগঠন গঠন করে দেয়া হয় এবং তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী তৎপরতা, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা, নারীর উপর সহিংসতা, বহিরাগত মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ও বসতিস্থাপন, গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ইত্যাদি তৎপরতায় উস্কে দেয়া হচ্ছে। গঠিত হওয়ার পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ রাঙ্গামাটিতে এবং গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বান্দরবানে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের সভা ঘেরাও করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌলবাদী ও জুম্ম বিদ্বেষী কিছু ইসলামী গোষ্ঠী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। এধরনের পরিকল্পনা বা কার্যক্রম অনেক আগে থেকে শুরু হলেও সাম্প্রতিককালে এর তৎপরতা অনেক জোরদার হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষত কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরপরই বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলিকদম উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীদের এ ধরনের ধর্মান্তরিতকরণের ব্যাপক কার্যক্রমের খবর পাওয়া গেছে। যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মতি ও সহযোগিতা রয়েছে বলে স্বীকার করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ছাঃলাওয়া পাড়ায় (শীলবান্ধা পাড়া) ৫ মারমা পরিবারের ২৭ জনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া বান্দরবান পৌরসভা, আলিকদম, রোয়াংছড়ি, লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টির অধিক মুসলিম পাড়া বা বসতিতে প্রায় শতাধিক ধর্মান্তরিত উপজাতি পরিবারের বসবাস রয়েছে।

বিগত ছয় মাসে তিন পার্বত্য জেলায় হামের শিকার হয়ে ১০ শিশুর মৃত্যু এবং আরো কমপক্ষে ৩৫০ জন হামে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাপকভাবে হামে আক্রান্তের ঘটনার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের দুর্গম এলাকার আদিবাসী জুম্মদের নাগরিক সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মজীবী হাজার হাজার জুম্ম চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব কর্মজীবী জুম্ম যুবক-যুবতীরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে স্ব স্ব ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় যানবাহনের চরম ভোগান্তি ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলার সাথে তিন পার্বত্য জেলা সীমানায় সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবর্ণনীয় হয়রানি ও নির্যাতনে তাদের পড়তে হয়েছে।

বলাবাহুল্য, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অনেকটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়েছে। বিগত ২২ বছরের অধিক সময়ে পার্বত্য সমস্যার কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া তো দূরের কথা, সমস্যা আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে সরকার পূর্ববর্তী শাসকদের মতো দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্র জুম্মদের অধিকার আদায়ের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে গলাটিপে স্তব্ধ করা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার জুম্ম কণ্ঠস্বরকে চিরতরে রুদ্ধ করা, জুম্মদের চিরায়ত ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদসহ জুম্মদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূল করা এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা ইত্যাদি কার্যক্রম নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করে চলেছে।