কুকি-চিনের দৌরাত্ম্য, কাদের ইশারায় চলছে এসব!

0
2133
ছবি: সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে কেএনএফের নেতা নাথান বম

মিতুল চাকমা বিশাল

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি এবং রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন বড়থলিতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে কুকি-চিন নামধারী একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য। ফেইসবুকে হুমকিমূলক বিভিন্ন পোস্ট করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষ খুন করছে এই গোষ্ঠীটি। রেইংখ্যং-এর পার্শ্ববর্তী সমস্ত প্রত্যন্ত গ্রাম এখন জনশূন্য। নিরাপত্তার অভাবে সাধারণ মানুষ এখন দিক-বিদিক হয়ে ছোটাছুটি করছে নিজের প্রাণ বাঁচাতে। রুমা উপজেলার রেমাক্রি প্রাংসা ইউপি এবং বিলাইছড়ির বরথলি ইউপি অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলকে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি একপ্রকার সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তারা প্রকাশ্যে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে উক্ত এলাকাতে ড্রোন উড়ানো এবং পর্যটক যাওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে (দেখুন: Kuki-Chin National Front-KNF এর ১৭ জানুয়ারি এবং ২৯ এপ্রিল ২০২২-এরফেইসবুক পোস্ট)। একইভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার অভ্যন্তরে রেইংখ্যং খালের পূর্বপাশের ‘রেংৎলাং’-এ তাদের ক্যাম্প এবং একইসাথে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কথাও তারা স্বীকার করেছে (দেখুন: Kuki-Chin National Front-KNF এর ৮ জুন ২০২২-এর ফেইসবুক পোস্ট)।

অথচ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর এহেন অবস্থান (তাও আবার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ) সম্পর্কে নিরাপত্তা বাহিনী কোনোপ্রকারেই ওয়াকিবহাল নয়, এমন উদ্ভট ধারণা পোষণ করার কোন যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না।

এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা একই বছরে পরপর কয়েকটি ঘটনা এবং হত্যাযজ্ঞ সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কারা এই কুকি-চিন নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী? কাদের ইশারায় এবং কাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলছে এসব? কিসের জন্যেই বা এদের সৃষ্টি? কারা তাদের সৃষ্টি করলো? কিভাবে হলো?সময়ের পরিক্রমায় এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা এখন খুবই জরুরি।

দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান, এমনকি অধুনা বাংলাদেশে সময়ে এসেই সেই ষড়যন্ত্রের বিভৎসতা আর ভয়াবহতা আরো বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যতার প্রাণ এতদঞ্চলের ১৪টি জাতিগোষ্ঠী,যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংস্কৃতি এবং প্রথা চর্চা করে ঐতিহাসিকভাবে পাহাড়ের কোলে কোলে বসবাস করে আসছে। বিজাতীয় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা প্রেক্ষিতে নানাভাবে গর্জে উঠেছে তারা। শাসকগোষ্ঠী বরাবরই এই প্রতিরোধকে ভাঙতে প্রচেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতিটিকে মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরে সামনে এগোচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেও পাহাড়ের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনকে। দেশের ৬১টি জেলায় সাধারণ প্রশাসন ব্যবস্থা চালু থাকলেও,পাহাড়ে এই জলপাই রঙা উর্দি পড়া লোকেরাই সমস্ত প্রশাসন যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের অঙ্গুলি হেলনে কর্ণফুলির জল এক ইঞ্চিও গড়ানোর সাহস করে না,এই রকম এক বাস্তবতা পাহাড়ে এখনও চলমান।

দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নায্য আন্দোলনকে ধূলিস্যাৎ করতে রাষ্ট্রযন্ত্র বরাবরই মরিয়া। রাজনৈতিক দলের নাম করে ধাপ্পাবাজির খেলায় মেতে পাহাড়ের রাজনীতিকে বিভাজিত করে পাহাড়িদের অধিকারের প্রশ্নটিকে অমূলক করে দেওয়ার বৃথাচেষ্টা করা হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে এসমস্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ডিজিএফআই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সরকার উক্ত গোষ্ঠীসমূহ দিয়ে পাহাড়ের রাজনীতির মেরুকরণ ঘটাতে ততটা সফল হয়নি। ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র জাতিগত বৈচিত্র্যতাকে কাজে লাগিয়ে বিভাজনের একের পর একনতুন খেলায় মেতে ওঠে। জাতীয় চেতনার উন্মেষকে কাজে লাগিয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় উস্কে দিয়ে জাতিভিত্তিক বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে দিয়ে পাহাড়কে অশান্ত করা হয়েছে। চুক্তির পূর্বের সময়ও এই বিভেদের বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। চুক্তি-উত্তর সময়েও সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ এএলপির দলচ্যুত কমান্ডার কর্তৃক মগ পার্টি এবং নাথান বমকে দিয়ে বম পার্টি নামে খ্যাত কেএনএফ গঠন করে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলকে অশান্ত করে রাখা হয়েছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, নব্যসৃষ্ট এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি বান্দরবান এবং রাঙামাটি জেলার মোট ৯টি উপজেলাকে নিয়ে স্বতন্ত্র ‘কুকি-চিন রাজ্য’, কখনো বা ‘খ্রীষ্টান রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার কথা বলে জনগণকে বোকা বানাচ্ছে এবং একইসাথে তারা আবার এটাও প্রকাশ্যে স্বীকার করে যে, তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে কোনোপ্রকার সংঘর্ষে যাবে না। এমনকি সেনাবাহিনীকে তাদের ‘এজেন্ডা’ বলেও কেএনএফ তাদের ফেইসবুকে উল্লেখ করে।

অপরদিকে এই গোষ্ঠীটি কথায় কথায় পাহাড়ি-বাঙালি সমঅধিকারের বুলি কপচায় অর্থাৎ বহিরাগত সেটেলারদেকে তারা পাহাড়ে বৈধতা দেয়,এমনকি তাদের অঙ্কিত মানচিত্রে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাকে সম্পূর্ণ ‘রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা’ বলে চিহ্নিত করেছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে সেখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীচাক, মারমা, রাখাইন এবং ম্রোদের বসবাস। রেমাক্রি প্রাংসা ইউপির সৌলপি পাড়াতে তারা ইসলামিক জঙ্গীদের সাথে একইসাথে অবস্থান করে এবং নানাভাবে ইসলামিক জঙ্গীদের থেকে সহায়তা পেয়ে যাচ্ছে। উক্ত এলাকাতে বাইরের কোনো লোক প্রবেশ করাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে তারা, যাতে ইসলামিক জঙ্গীদের কেউ দেখতে না পায়।

এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি বম, লুসাই, খিয়াং, খুমি, পাংখো ও ম্রো জনগোষ্ঠীগুলোকে কুকি-চিন জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত তাদের উন্নয়ন ও অধিকারের কথা তথা স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বললেও সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্র মদদপুষ্ট বিভিন্ন কোম্পানী ও ভূমিদস্যূ কর্তৃক ক্যাম্প স্থাপন, পর্যটন, ইজারা, হর্টিকালচার ইত্যাদি নামে এসব জনগোষ্ঠীর চিরায়ত জুম ভূমি ও গ্রামীন বন কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে একেবারেই নীরবতা পালন করে চলেছে।

অপরদিকে প্রতিষ্ঠার পরপরই তারা জনসংহতি সমিতিকে নিজেদের শত্রু বলে চিহ্নিত করলো এবং ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিকে ‘চাকমা চুক্তি’ ও চুক্তির ধারাবলে গঠিত আঞ্চলিক পরিষদকে ‘চাকমা পরিষদ’, এমনকি জনসংহতি সমিতিকে ‘চাকমা দল’ নামে অভিহিত করে জাতিবিদ্বেষী নানা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে পাহাড়ের সংখ্যাগুরু আদিবাসী জনগোষ্ঠী (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা) এবং সংখ্যাল্প আদিবাসী জনগোষ্ঠীর (বম, পাংখো, খুমি, লুসাই, ম্রো, খিয়াং) মধ্যে বিভেদের দেওয়াল তুলে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই তারা নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা করে যাচ্ছে।

তাহলে উপরোক্ত বিষয়গুলো থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে যায়,তথাকথিত এই গোষ্ঠীটির দাবিগুলো কার কাছে? যদি রাষ্ট্র তথা সরকারের কাছেই হয়ে থাকে তবে সেখানে অবশ্যই রাষ্ট্রের সাথে সংঘর্ষ হওয়াটা আবশ্যক। কেননা যেখানে রাষ্ট্র ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত একটি চুক্তিকেই বাস্তবায়ন করছে না, সেখানে রাষ্ট্রের সাথে বিনাযুদ্ধে বা বিনাসংঘর্ষে স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা অলীক স্বপ্নমাত্র নয় কি?।

বাস্তবিকপক্ষে এটাই চরম সত্য এবং বাস্তব যে, সেনাবাহিনীর ইন্ধনে এবং ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠীর সহযোগিতাতেই এই কুকি-চিন নামধারী সশস্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব। ২০০৮ সালে কেএনডিও প্রতিষ্ঠার পরে ২০১৩ সালের ১০ই নভেম্বর রুমাতে এর অফিস উদ্ধোধন করা হয়, এতে সেনাবাহিনীর তৎকালীন বান্দরবান ব্রিগেড কমান্ডার সায়েদ সিদ্দিকী, পিএসসি প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, এছাড়াও তৎকালীন রুমা সেনা জোন কমান্ডার আরিফুল বারী,পিএসসি এবং ক্যাপ্টেন নাহিদ উপস্থিত ছিলেন। তৎপরবর্তী ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সাব্বির আহমেদ কেএনডিও-এর অফিস পরিদর্শনে যান। উক্ত বিষয়গুলো দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে, শুরু থেকেই কেএনডিও’র সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং তারাই সমস্ত কিছুর হর্তাকর্তা।

ঐ সময়েই রাষ্ট্রীয় বাহিনী থেকে কেএনডিও-কে সশস্ত্র করার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তৎপরবর্তী ২০১৬ সালের শেষের দিকে এর সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু হয়। প্রাথমিক অবস্থায় কেএনডিও-এর সামরিক শাখা কেএনভিএ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার আর্মি) রাখা হয়। পরে ২০১৯ সালে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) রাখা হয় এবং তার সশস্ত্র শাখা হিসেবে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)-এর যাত্রা শুরু হয়।

সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি শুরু থেকেই কুকি-চিন জাতীয়তাবাদের ধোঁয়া তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মাঝে বিভাজনের নতুন বীজ রোপণ করে। তাদের তথাকথিত জাতীয়তাবাদে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে প্রধান শত্রুরূপে গণ্য করে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে মিত্র বলে মনে করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ এপ্রিল ২০২২ থেকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি রেইংখ্যং ভ্যালি ও রোয়াংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন তঞ্চঙ্গ্যা এবং ত্রিপুরা অধ্যুষিত পাড়াসমূহে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে হয়রানি করতে শুরু করে। কখনও চাল,কখনও সোলার প্যানেল,কখনও গবাদি পশু জোরপূর্বক গ্রামবাসীদের থেকে নিয়ে একপ্রকারে জনগণকে প্রায় সর্বশান্ত করেছে। এসবের প্রতিবাদ যারাই করেছে বা একটু কথা বলতে চেয়েছে তাদেরকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। তারমধ্যে সাইজাম পাড়ার খিয়াং কার্বারী মুন খিয়াং এবং হেইঙ্গোছড়ার কার্বারী নোয়া তঞ্চঙ্গ্যা মারধরের শিকার হয়ে অনেক আগে থেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তৎপরবর্তী ১৭ এপ্রিল ২০২২,তারা বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়াতে এক চুক্তি সমর্থককে গুলি করে হত্যা এবং ৩ জনকে গুরুতর আহত করে। অপরদিকে গত ২১ জুন কোনোপ্রকার কারণ ছাড়াই একেবারে ঠান্ডা মাথায় এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সাইজাম পাড়াতে ৫টি ত্রিপুরা পরিবারের উপর গুলিবর্ষণ করে এবং এতে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের ২ জন সহ মোট ৩ জন নিহত হন এবং ২টি শিশু গুরুতর গুলিবিদ্ধ হন। এমনকি এই ঘটনার দায়ও ফেইসবুক পোষ্টের মাধ্যমে প্রকাশ্য স্বীকার করে নিয়েছে কেএনএফ। অথচ এই ঘটনাকেই ধামাচাপা দিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নানাভাবে ছক কষে চলেছে। ঘটনার ১৩ দিন অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর অসহযোগিতার কারণে সেখানে পুলিশ এবং কোনো জনপ্রতিনিধিই যেতে পারেনি। এমনকি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা রুমা সেনা জোনে সম্পূর্ণ ঘটনাটি খুলে বলার পরেও সেনাবাহিনী সেটিকে ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, ‘কেএনএফ এমন কাজ করতেই পারে না।’

অপরদিকে আহত ২ শিশুর মা রাংদুতি ত্রিপুরা স্বয়ং ঘটনা সম্পর্কে কেএনএফ-কে দায়ী করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সাধারণ জনগণ সাক্ষ্য দেওয়া সত্ত্বেও কেন সেনাবাহিনী সেটিকে ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে? কেন সেনাবাহিনী এই কেএনএফ-কে ধোয়া তুলসীপাতা বলে মনে করে? ঘটনার এতদিন পরেও কেন এখনও সাধারণ ডায়েরিও করা হলো না?

এছাড়া উল্লেখ্য যে,প্রথমদিকে উক্ত ঘটনা নিয়ে কোন প্রকার সভা-সমাবেশ না করতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয় এবং বান্দরবানের সমস্ত প্রিন্টিং দোকানগুলোতে এবিষয়ে কোনোপ্রকার ব্যানার, ফেস্টুন,প্ল্যাকার্ড ইত্যাদি না ছাপানোর জন্য জানিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি যদি কেউ এসম্পর্কিত কোন ব্যানার, ফেস্টুন,প্ল্যাকার্ড ছাপাতে আসে,তাহলে দ্রুত যেন সেনাবাহিনীকে সেটি অবহিত করা হয়। পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া শিশুটির ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় এবং টিএসএফ-এর পক্ষ থেকে উক্ত ভিডিওগুলো বান্দরবান ব্রিগেডিয়ারকে দেখানোর পরে এবং নানা চাপের মুখে সেনাবাহিনী নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।

অপরদিকে গত ৩০ জুন কেএনএফ-এর রেশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বান্দরবান থেকে রনিনপাড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময় দূর্নিবার বম পাড়া ও পাইনখ্যং বম পাড়াতে ৫০-৬০ জনের একটি সেনাদল নিরাপত্তা বিধানের জন্য মোতায়েন করা হয়।

বাস্তবিকপক্ষে সেনাবাহিনী গত ২১ জুনের ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিয়ে অন্যদিকে মোড় ঘোরানোর প্রচেষ্টা করছে। অতি সম্প্রতি এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রেইংখ্যং ভ্যালি এবং রোয়াংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা অধ্যুষিত গ্রামে একের পর এক হুমকিমূলক বার্তা দিয়ে চলেছে এবং গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে উক্ত পাড়াসমুহের লোকজন এখন গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পূর্বেও তারা এই ধরনের হুমকি প্রদান করেছিল এবং গ্রাম পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তখনও অনেকটা সাহস করে গ্রামবাসীরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজেদের জুমচাষ কার্য পরিচালনা করে গেছে। অতি সম্প্রতি সাইজাম পাড়ায় ত্রিপুরাদের উপর কেএনএফ আক্রমণ করায় সমস্ত পাড়াগুলোতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রামবাসীরা দিক-বিদিক পালিয়ে যাচ্ছে।

বিলাইছড়ি এবং রোয়াংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাদের প্রায় ১০০-১৫০টি পরিবার এখন নিরাপত্তার শঙ্কায় গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়াও বম, খুমি, খিয়াং, ম্রো, লুসাই, পাংখোয়া জনগোষ্ঠী থেকে যারাই জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পৃক্ত এবং সমর্থক হিসেবে কাজ করে তাদেরকেও ফোনে এবং ফেইসবুকে পোস্ট করে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে চলেছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামবন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান শাখার সভাপতি জুমলিয়ান আমলাই বম,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য লয়েল ডেভিড বম এবং পিসিপির সাবেক সহ-সভাপতি পাসেন বমকে নানাভাবে হুমকিমূলক বার্তা ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

এমনকি তাদেরকে জনসংহতি সমিতি থেকে সরে না আসলে মৃত্যুর জন্য তৈরি থাকতেও বলা হচ্ছে।তাহলে স্বাভাবতই বোঝা যায়, এই কেএনএফ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি কেবল রাষ্ট্রীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্ররোচনাতেই কেএনএফ গত ২১ জুনের পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীই কেএনএফ-কে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা পাড়াগুলোতে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদান করে গ্রাম খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। জাতিগত বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়ার লক্ষ্যেই সেনাবাহিনী কেএনএফ-কে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে। উপরোক্ত ঘটনাসমূহ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক তঞ্চঙ্গ্যা এবং ত্রিপুরাদেরকে বম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পরোক্ষ উস্কানি। অর্থাৎ ত্রিপুরা এবং তঞ্চঙ্গ্যারা যাতে অতিষ্ঠ হয়ে বমদেরকে নিজেদের শত্রুরূপে পরিগণিত করে এবং তারাও যাতে সশস্ত্র হয়ে প্রতিরোধ শুরু করে, এটাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মূল টার্গেট।

এই পরিকল্পনাতে সফল হলে তারা এটাই প্রতীয়মান করবে যে, ‘পাহাড়ে এখনও জাতিগত সংঘাত চলমান, অস্ত্রের ঝনঝনানি চলমান, সুতরাং পাহাড়ে সেনাবাহিনী থাকতেই হবে’। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল রেখে, সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া এবং পাহাড়ে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে বৈধতা দেওয়াটাই এসমস্ত কিছুর প্রধান উদ্দেশ্য।

অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেনা মদদপুষ্ট এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি পাহাড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। কুকি-চিন নাম দিয়ে পাহাড়ে জাতিগত বৈষম্য এবং বিভেদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে এবং সেনাবাহিনী তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে চলেছে। পাহাড়ের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা,সুতরাং এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। তদুপুরি রাষ্ট্রযন্ত্র বরাবরই পাহাড়ের এই রাজনৈতিক সমস্যাকে অনুধাবন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে এবং পূর্বের ন্যায় একের পর এক সামরিকায়ন আর বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ে একের পর এক সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি করে পাহাড়কে উত্তপ্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারকামী সকলের উচিত রাষ্ট্রের এই ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করা এবং এই কেএনএফ সহ রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সকল সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা।