আলিকদম-পোয়ামুহুরী সড়ক নির্মাণে সেনাবাহিনী, ৬০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত

0
1319

হিল ভয়েস, ২৯ মে ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবানের আলিকদম উপজেলা হতে আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক নির্মাণ কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ নির্মাণ প্রকৌশলী ব্যাটালিয়ন (১৬ ইসিবি)।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে নির্মাণাধীন ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের ফলে আলিকদম উপজেলার কুরুকপাড়া ইউনিয়নের ১৩টি আদিবাসী জুম্ম গ্রামের ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা জনগোষ্ঠীর ৬০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিশেষ সূত্রে জানা যায় যে, ২০১৭ সালের মে মাসে সড়কটি নির্মাণের জন্য ৩ শত ৭৪ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় একনেক। কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীর নির্মান প্রকৌশলী ব্যাটালিয়ানকে (১৬ ইসিবি)। এছাড়াও প্রকল্পে ২০ হাজার ৬ শতটি বৃক্ষরোপন এবং গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নখাত বরাদ্দ রয়েছে এই প্রকল্পে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে ৮ লাখ ৭৬ হাজার ঘনমিটার মাটি কাটা, ১২ টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, ১১টি কালভার্ট, ১শ মিটার ওয়ার্টার ডেম (২/৩টি), ৯ শত ১৯ মিটার (১২টি) আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ, ৭২ মিটার (১১টি) আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ৪৮ দশমিক৩ কিলোমিটার সাইড ড্রেন নির্মাণ, ১ শত ৩১ দশমিক ৮৪ মিটার ৫৫টি ক্রস ড্রেন নির্মাণ, ১ হাজার ৮ শত ৫৪ মিটার রিটেইনিং ওয়াল ও ব্রেস্ট ওয়াল নির্মাণ, ৯৫ মিটার বল্টা প্যালাসাইডিং প্রভৃতি।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকার নিরাপত্তা জোরদার হবে। পাশাপাশি আলিকদম উপজেলায় কুরুক পাতা ইউনিয়নের সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগ স্থাপন ও স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের উৎপাদিত কৃষি ও জুমজাত পণ্য বিপননে ভূমিকা রাখবে বলে প্রকল্পের নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়।

এই সড়ক নির্মাণের ফলে কুরুকপাতা ইউনিয়নের অধীন ১৩টি গ্রামের ৬০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের মধ্যে ৩৯ পরিবারের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ হবে, ২৬ পরিবারের বাগান-বাগিচা ও ৩ পরিবারের জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানা গেছে।

এমনকি ঘরবাড়ি উচ্ছেদ হয়ে ৩৯ পরিবারকে নিজ বাস্তভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। ৬০ পরিবারের মধ্যে ৪৫ পরিবার ম্রো জনগোষ্ঠী, ২৩ পরিবার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ও ২ পরিবার মারমা জনগোষ্ঠীর বলে জানা গেছে।

৬০ পরিবারের মধ্যে ক্রাতপুং ম্রো চেয়ারম্যান কুরুকপাড়া ৪ পরিবার (২ ত্রিপুরা ও ২ মারমা পরিবার)-এর বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; করুকপাড়া বাজারের মেনপাত পাড়ার ৬টি ম্রো পরিবারের ঘর উচ্ছেদ; বুচিছড়া মেত্তলা পাড়ার ১ ম্রো পরিবারের বাগান ও ২ ম্রো পবিারের জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত; ছোট বেটি খরচং পাড়ার ১ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; দুঃখা পাড়ার ১ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; বড় বেটি ইয়াংরি পাড়ার ৯ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; দরিঅলেং পাড়ার ৩ ম্রো পরিবারের জুমভূমি ক্ষতিড়্রস্ত; জানালী পাড়ার ৪ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; মেরিংচর কেংক পাড়ার ৬ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; সাথিরাম ত্রিপুরা পাড়ার ১ পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্তসহ ৩ ত্রিপুরা পরিবারের ঘর উচ্ছেদ; জিরা পাড়ায় ২ পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্তসহ ১৮ ত্রিপুরা পরিবার উচ্ছেদ ও অন্যত্র স্থানান্তর; মেননিক ম্রো পাড়ায় ৮ পরিবারের ঘর উচ্ছেদ; এবং মেনদন পাড়ায় ২ পরিবারের ঘর উচ্ছেদসহ ৪ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতির শিকার হবে।

স্থানীয় সূত্র আরো জানান যে, ইতিপূর্বে আলিকদমে বিভিন্ন ইউনিয়নে আদিবাসী জুম্মদের রেকর্ডী‍য় জায়গা-জমিসহ কয়েক হাজার জুমভূমি ও মৌজাভূমি অস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীর নিকট ইজারা দেয়া হয়েছে।

ফলে ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা আদিবাসীদের শত শত পরিবার নিজ বাস্তুভিটা ও জায়গা-জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। ইজারাদারদের অব্যাহত হয়রানি ও হামলার ফলে আদিবাসীরা তাদের অনেক গ্রাম পরিত্যাগ করতে হয়েছে। ফলে তাদের জীবনজীবিকা হুমকির মধ্যে পড়েছে। আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক নির্মাণের ফলে তাদের আরো ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে নাম প্রকাশ অনিচ্ছ্যুক এক ম্রো গ্রামবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জানালীপাড়া, কুরুকপাতা ও পোয়ামুহুরী এলাকায় তিনটি বাজারসহ, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, কেয়াং ও স্কুলসহ নানা সামাজিক স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ না থাকায় এসব এলাকার লোকজনের যাতায়াত, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ওকৃষিজাত পণ্য পরিবহনসহ যোগাযোগের একমাত্র মধ্যম ছিল মাতামুহুরী নদী। কিন্ত নদীর নাব্যতা হারানোর কারণে যোগাযোগের এইমাধ্যমটি দিন দিন হুমকির মুখে পড়ে।

বিশেষ সূত্রে জানা যায় যে, ইতিমধ্যে সড়কের ২৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাহাড়ির রাস্তা হওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে কাজ করা সম্ভব হয় না। যার কারণে প্রকল্পের কাজ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় নির্মাণসামগ্রী পরিবহন খাতে খরচ পড়ছে অনেক বেশি।