আদিবাসীদের অকৃত্রিম বন্ধু বর্ষীয়ান জননেতা পংকজ ভট্টাচার্য আর বেঁচে নেই

0
334
ছবি: শ্রী পংকজ ভট্টাচার্য

হিল ভয়েস, ২৪ এপ্রিল ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ দেশের আদিবাসীদের অকৃত্রিম বন্ধু, আমৃত্যু আপোষহীন সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি জননেতা পংকজ ভট্টাচার্য আর বেঁচে নেই।

আজ (২৪ এপ্রিল ২০২৩) সোমবার ভোররাত ১২:২৮ টায় নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণে ঢাকার হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর ৬ মাস।

শ্রী পংকজ ভট্টাচার্য ছিলেন ছাত্রজীবন থেকে জুম্ম জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নির্ভরযোগ্য ও পরীক্ষিত এক বন্ধুও বটে। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের কর্মসূচিতে বারবার তিনি সামিল হয়েছেন।

তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের মহান বিপ্লবী ও অবিসংবাদিত নেতা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম জাতীয় সংসদের অন্যতম সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ঘনিষ্ট বন্ধু ও সংগ্রামী সহযোদ্ধা এবং বহু সংগ্রামী ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে ‘জুম্ম জাতির স্থপতি’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘অল্পদিনের চেনা-জানার সুবাদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে যেভাবে দেখেছি ও জেনেছি তা আমার জন্যে এক পরম পাওয়া, এক দূর্লভ সৌভাগ্য। ১৯৫৮ হতে ১৯৬০ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে সতীর্থ হিসেবে এম এন লারমাকে পেয়েছি। সহপাঠীদের মধ্যে মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত এই তরুণ ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শানিত যুক্তি সহযোগে তিনি বক্তব্য রাখতেন, মূল্যবোধ ও নীতির প্রতি ছিল অবিচল নিষ্ঠা।..আমরা উভয়ে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম, রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল সাধারণভাবে অভিন্ন।’

তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ নয়, যুগপৎভাবে সমতলের আদিবাসী জাতিসমূহের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরও এক পরম বন্ধু এবং বলিষ্ট কন্ঠস্বর ছিলেন। পাহাড়ে কিংবা সমতলে যেখানেই আদিবাসীরা তাদের প্রয়োজনে ডেকেছেন সেখানেই তিনি তাঁর বাধ্যক্যকে উপেক্ষা করে পরম মমতায় ও উৎসাহে ছুটে গিয়েছেন। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী নারী নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থ নিজেও ছিলেন পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অন্যতম পরম বন্ধু ও বিভিন্ন সময়ের সংগ্রামের সাথী।

অপরদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল বর্ণাঢ্য সংগ্রামী জীবন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান আমলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৬২ সালে তৎকালীন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এক পর্যায়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন সময়ে সামরিক শাসন বিরোধী ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার কারণে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সরকার ১৯৬৭ সালে তাঁকে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’ জড়িত করে কারারুদ্ধ করে। একই বছর তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিভিন্ন বাম দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে তরুণ বয়সে তিনি তৎকালীন সময়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরশাদের পতনের পরও দেশে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের রাজনীতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি অক্লান্তভাবে নানা উদ্যোগ ও ভূমিকা গ্রহণ করেন। এসময়ে তিনি ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’, গণফোরাম, গণঐক্য গঠন করে দেশে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। জরুরি অবস্থার পরবর্তীকালে ২০১৩ তিনি ঐক্য ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

পংকজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৩৯ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে এক শিক্ষিত, প্রগতিশীল, সংগ্রামী ও মধ্যবিত্ত পরিবারে। এই নোয়াপাড়া গ্রাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনসহ বহু সংগ্রামীর ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। তাঁর পিতা প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও প্রগতিমনা স্কুলশিক্ষক, আর মা মনিকুন্তলা দেবীও ছিলেন তৎকালীন সমাজে মহিয়সী এক নারী। তাঁর পিতামহ রমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন চট্টগ্রামের একজন প্রসিদ্ধ আইনজীবী ও সমাজ সংস্কারক।

শ্রী পংকজ ভট্টাচার্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ দেশের আদিবাসীদের হৃদয়ে ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাসে যেমনি, তেমনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনেও চির ভাস্বর ও চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর বর্ণাঢ্য ও সৃজনশীল সংগ্রামী ভূমিকা ও অবদানের মধ্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।