আজ লংগদু সাম্প্রদায়িক হামলার তিন বছর, জড়িতদের বিচার হয়নি

0
2223

হিল ভয়েস, জুন ২০২০, রাঙ্গামাটি: আজ লংগদু সাম্প্রদায়িক হামলার তৃতীয় বার্ষিকী। এই দিনে ২০১৭ সালের ২ জুন  রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলা সদরের তিনটিলা এবং পার্শ্ববর্তী মানিকজোড়ছড়া ও বাত্যা পাড়ায় সেনা-পুলিশের ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীন স্থানীয় আওয়ামীলীগ-যুবলীগের নেতৃত্বে মুসলিম সেটেলাররা আদিবাসী জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়।

এ হামলায় প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ও দোকানপাটের মধ্যে লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় জুম্মদের কমপক্ষে ৯৪টি ঘরাবাড়ি ও দোকানপাট; মানিকজোড়ছড়ায় ৮৮টি ঘরবাড়ি এবং বাত্যা পাড়ায় অন্তত ৪২টি ঘরাবাড়ি ছিল।

তিনটিলা এলাকায় গুণমালা চাকমা নামে ৭৫ বছরের এক অশীতিপর বৃদ্ধা পালিয়ে যেতে না পারার কারণে ঘরের মধ্যে জীবন্ত আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। এছাড়া হামলাকারীদের মারধরের শিকার হয়ে আহত হন তিন জুম্ম গ্রামবাসী।

হামলাকালে অগ্নিসংযোগকারী সেটেলারদেরকে জুম্ম গ্রামবাসীরা প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু এ সময় সেটেলারদের সাথে সেনা সদস্যরাও এগিয়ে আসলে এবং জুম্মদেরকে ভয়ভীতি ও গুলি করার হুমকি দিলে জুম্মরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর সেটেলার বাঙালিরা অবাধে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

এ সময় সেনা ও পুলিশ সদস্যরা নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে সেটেলার বাঙালিদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছে। সেটেলার বাঙালিরা ঘরবাড়ি ও দোকানের মূল্যবান জিনিষপত্র ও মালামাল, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী লুট করে নিয়ে যায় এবং শুকরগুলো মেরে ফেলে দিয়ে যায়।

পুড়ে যাওয়া তিনটিলা, মানিকজোড়ছড়া ও বাত্যা পাড়ার প্রায় ২৫০ পরিবার কেউই কোন সহায় সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেনি এবং এক কাপড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে কোন রকমে জীবন রক্ষা করেছে।

খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের চার মাইল নামক স্থানে নুরুল ইসলাম নয়ন নামে ভাড়ায় চালিত একজন মোটর সাইকেল চালক অপহরণের পর ১ জুন ২০১৭ তার লাশ উদ্ধার করা হলে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে জুম্মদেরকে দায়ী করে এই সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়।

সেনা-পুলিশ-সেটেলার-যুবলীগ কর্তৃক এভাবে সমাবেশের পর হামলা চালানো হয়।

লংগদু সেনা জোনের জোন কম্যান্ডার লে: কর্ণেল আবদুল আলিম চৌধুরী পিএসসি, টুআইসি মেজর রফিক ও লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা-পুলিশের সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে আওয়ামী-যুবলীগের নেতৃত্বে সেটেলাররা এই হামলা চালায়।

সেটেলাররা প্রথমে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানগুলো লুটপাট করে। তারপর পেট্রোল ও কেরোসিন ঢেলে দিয়ে একের পর এক অগ্নিসংযোগ করে থাকে। এমনকি এক ধরনের গ্যাসের বোতল থেকে স্প্রে করে ঘরবাড়ির চালে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ১৭৬টি পরিবারের বাড়ি পূনঃনির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তত্বাবধানে ভষ্মিভূত বাড়িগুলোর পূনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে এবং অধিকাংশ পরিবার নিজ নিজ বসতবাড়িতে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।

তবে উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা আজ তিন বৎসর অতিক্রান্ত হলেও এখনও পর্যন্ত হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে কিশোর চাকমা ও লংগদু থানা পুলিশের পক্ষে এস.আই দুলাল হোসেন কর্তৃক দায়েরকৃত দুটি মামলায় ঘটনার পর কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ ও প্রশাসনের উদ্দেশ্য-প্রণোদিত গাফিলতির কারণে বর্তমানে সবাই জামিনে জেল থেকে বের হয়ে এসেছে।

অপরদিকে ঘটনার সাথে জড়িত অধিকাংশ আসামী এখনও গ্রেফতার বা আইনের বাইরে রয়ে গেছে এবং তারা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। অন্যদিকে মোঃ মাহবুব মিয়া এবং মোঃ মারফত আলী নামে দুইজন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত পৃথক ২টি মিথ্যা মামলা এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি।

অশীতিপর বৃদ্ধা গুণেমালা চাকমাকে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগকালে জীবন্ত পুড়ে মারার ঘটনা নিয়ে প্রশাসন এখনো গড়িমসি করে চলেছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গুণেমালা চাকমার পুড়ে যাওয়া হাড়গোড় নিয়ে যাওয়া হলেও প্রশাসন এ বিষয়ে ধামাচাপা দিয়ে চলেছে। তাঁর পরিবারকে এখনো কোন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ১৫টি সাম্প্রদায়িক হামলাসহ ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর সংঘবদ্ধ সেনা-বিজিবি-পুলিশ-সেটেলার কর্তৃক জুম্মদের উপর ২০টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে।

এতে কমপক্ষে ১,৬০০ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। লুটপাট করা হয় ১,৩৩২টি বাড়ি। কমপক্ষে ১২ জন নিহত ও ৩৮৬ জন জুম্ম গ্রামবাসী আহত হয়। ধর্ষণের শিকার হয় ১৬ জন নারী ও শিশু।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত সেটেলার মুসলিম, সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্য ও সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কর্মীরা কাউকেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

সরকার তথা রাষ্ট্র নির্বিচারে তাদের সবাইকে একপ্রকার দায়মুক্তি দিয়েছে। এভাবে বিচারহীনতার কারণে জুম্ম জনগণের উপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।