রুমা থেকে মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করতে গিয়ে দুর্গম পথে একজন পাদ্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু

0
357

হিল ভয়েস, ১০ জানুয়ারি ২০২২, বান্দরবান: সম্প্রতি কেএনএফ ও সেনাবাহিনীর চাপের মুখে বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা থেকে মিজোরামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার সময় বম জনগোষ্ঠীর ৮১ বছর বয়স্ক একজন খ্রীষ্টান পাদ্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার পাদ্রীর নাম সমখুপ বম (৮১)। তিনি রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের চৈইক্ষ্যং বম পাড়ার নিবাসী জলেইকুয়ালা বমের পুত্র বলে জানা গেছে। তিনি ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ট্রাইবাল ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ বাংলাদেশ-এর পাস্টর হিসেবে ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে রুমার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা থেকে সমখুপ বমসহ বম জনগোষ্ঠীর একদল গ্রামবাসী মিজোরামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণের জন্য মিজোরাম-বাংলাদেশ সীমান্তে যান। কিন্তু মিজোরামে প্রবেশ করতে না পারায় তারা পুনরায় স্ব স্ব গ্রামে ফিরে আসার উদ্যোগ নিয়ে থাকে।

স্ব স্ব গ্রামে ফেরার পথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার ভেতরে পৌঁছলে দুর্গম এলাকায় পাদ্রী সমখুপ বমের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি দুর্গম পাহাড়ি পথে হাঁটার সময় ২/৩ বার আছাড় খেয়েছিলেন। এতে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। অন্য একটি সূত্র জানান যে, তিনি নাকি বার্ধক্যজনিত সমস্যার ভুগছিলেন। অধিকন্তু দুর্গম পাহাড়ি পথে হাঁটতে গিয়ে খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ায় ২/৩ দিন নাকি তিনি খেতে পাননি। ফলে অধিকতর দুর্বল হয়ে তিনি ৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়েন। পরে তাঁর মরদেহ সিলৌপি পাড়ায় নিয়ে এসে কবর দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনী মদদপুষ্ট কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), যারা বম পার্টি নামে সমধিক পরিচিত, তাদের আস্তানায় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার’ নামে আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠনকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের খবর ফাঁস হওয়ার পর ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গীদের আশ্রয়প্রদানকারী কেএনএফের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও এসএসএফ যৌথ অভিযান শুরু করে।

এতে নিরাপত্তা বাহিনী ও কেএনএফের হুমকি ও চাপের ফলে রুমা উপজেলা রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়ন এবং রোয়াংছড়ি উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বম জনগোষ্ঠীর নিরীহ গ্রামবাসী উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। অনেকে দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে মিজোরামের লংতালাই জেলার চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে।

অভিযোগ রয়েছে যে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারের কুকি-চিন জনগোষ্ঠীসহ আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের হীনউদ্দেশ্যে এবং ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেয়ার হঠকারী কর্মকান্ডকে ধামাচাপা দিয়ে পরিস্থিতিতে অন্যদিকে প্রবাহিত করার হীনলক্ষ্যে কেএনএফ রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলাধীন প্রত্যন্ত গ্রামের বম জনগোষ্ঠীকে উদ্বাস্তু হয়ে মিজোরাম সীমান্তে আশ্রয় নিতে হুমকি দিয়ে আসছিল।

এর ফলে গত ২৯ নভেম্বর ২০২২ প্রথমে নারী ও শিশু সহ ৬৯ পরিবারের ২৭৪ জন বম গ্রামবাসী মিজোরাম প্রদেশের লংতড়াই জেলার চংতে মহকুমার সিমেনাছড়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। এর অব্যবহিত পরে ২১ জনের আরেকদল বম গ্রামবাসী আশ্রয় নিয়েছিল।

এরপ ১১৭ জনের আরেক দল বম গ্রামবাসী মিজোরাম সীমান্তে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। তার মধ্যে ১০ জন মিজোরামে প্রবশে করতে পারলেও, বাকীরা প্রবেশ করতে না পারায় রুমার রেমাক্রী প্রাংসা এলাকার স্ব স্ব গ্রামে ফিরে এসেছিল বলে জানা যায়।

সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি ২০২৩ শরণার্থীরা আবারো প্রবেশ করতে চাইলে ১৭ জন প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এ নিয়ে বর্তমানে মিজোরামে আশ্রিত বম শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২৭ জনে।

কেএনএফের হঠকারী কর্মকান্ডের ফলে এভাবে বম জনগোষ্ঠীর নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ গ্রামবাসীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে বলে বম জনগোষ্ঠীর অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। সেনাবাহিনীর আল্টিমেডাম অনুসারে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার’ নামে আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী জঙ্গীদেরকে সেনাবাহিনীর নিকট হ্স্তগত করলে বম জনগোষ্ঠীর এধরনের দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হতো না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বম জনগোষ্ঠীর মুরুব্বীরা।

এধরনের একজন পবিত্র বৃদ্ধ লোকের এভাবে মৃত্যুবরণের ঘটনা নি:সন্দেহে অত্যন্ত মর্মান্তিক বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনসংহতি সমিতির সমর্থিত স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি। তিনি প্রশ্ন ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গীদের আশ্রয় প্রদানকারী কেএনএফের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান না হয় চলছে, কিন্তু তাই বলে নিরীহ নিরপরাধ বম গ্রামবাসীর উপর হয়রানি ও নির্যাতন হবে কেন?

নিরপরাধ ও নিরীহ বম গ্রামবাসীর উপর সেনাবাহিনীর হয়রানি অচিরেই বন্ধ করা দরকার বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন এবং জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে এবং উপযুক্ত পুনর্বাসন ঘোষণা করে মিজোরামে আশ্রিত বম শরনার্থীদেরকে অচিরেই স্ব স্ব গ্রামে ফিরিয়ে আনারও দাবি জানান উক্ত জনপ্রতিনিধি।