হিল ভয়েস, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, বান্দরবান: স্থানীয় জুম্ম অধিবাসীদের উচ্ছেদ ও জীবনজীবিকাকে বিপন্ন করে বান্দরবানের নীলগিরিতে সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তুলছে বিশাল পর্যটন কম্পলেক্স এবং মূল হোটেল বিল্ডিংয়ের সাথে পর্যটকদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের সুবিধার্থে ১২টি পৃথক ভিলা, আধুনিক কেবল গাড়ি থাকবে। বান্দরবানের নীলগিরিতে পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল এবং বিনোদন পার্কের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সিকদার গ্রুপের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ডিভিশন, ৬৯তম ব্রিগেড, সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দৃষ্টিনন্দন নীলগিরির চারদিকে পাহাড় ঘেরা এলাকায় সেনা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেডের মধ্যে ৩৫ বছরের চুক্তির আওতায় এটি নির্মিত হচ্ছে।
এটি চিম্বুক-থানচি রুটে এবং বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। মূল হোটেল বিল্ডিংয়ের সাথে সাথে পর্যটকদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের সুবিধার্থে ১২টি পৃথক ভিলা, আধুনিক কেবল গাড়ি থাকবে। রাইড এবং সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন ধরণের বিনোদনমূলক সুবিধাও থাকবে।
উল্লেখ্য যে, এর আগে দলিল অনুযায়ী নির্ধারিত জায়গার পরিমাণ ১৬ একর জায়গার উপর সেনাবাহিনী কর্তৃক ‘নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাস্তবে এই পর্যটন কেন্দ্রের দখলে রয়েছে অন্তত ৬০ একর ভূমি। আরও অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী কর্তৃক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, শপিং সেন্টার ইত্যাদি স্থাপনের জন্য চিম্বুক পাহাড়ের ডলা ম্রো পাড়া (জীবন নগর), কাপ্রু ম্রো পাড়া (নীলগিরি), চিম্বুক ষোল মাইল, ওয়াই জংশন (১২ মাইল), রুমার কেওক্রাডং পাহাড়ের কেওক্রাডং চূড়া ইত্যাদি এলাকায় বসবাসরত হতদরিদ্র ও সার্বিকভাবে অনগ্রসর জুম্মদের বিপুল পরিমাণ জুমভূমি বেদখল করা হয়। এর ফলে যুগযুগ ধরে এই এলাকার ম্রো ও মারমা জনগোষ্ঠীর ৬টি গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার উচ্ছেদ ও ক্ষতির মুখে রয়েছে।
আরো জানা গেছে, চিম্বুক পাহাড়ের কাপ্রু ম্রো পাড়া এলাকায় বিলাসবহুল নীলগিরি অবকাশ যাপন কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য সেনাক্যাম্পের কর্তৃপক্ষ ও বান্দরবানের ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড কাপ্রু ম্রো পাড়ার নীলগিরি হতে জীবন নগর পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্থানীয়দের কোন প্রকার উদ্যান বাগান ও অন্যান্য কাজ করতে বন্ধ করে দেয়। সেই বিশাল ভূমি (আনুমানিক ৬০০ একর) সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতার জোরে দখল করে নেয়া হয়েছিল। এছাড়া রুমা উপজেলায় আদিবাসী বম জনগণকে উচ্ছেদ করে স্থাপন করা হয়েছে অনিন্দ্য পর্যটন কেন্দ্র। উপরন্তু এই উপজেলার সেপ্রু মৌজাধীন কথিত জীবননগর নামক এলাকায় ৫০০ একর মতো পাহাড়ভূমি সেনাবাহিনী দখলে রেখেছে। এতে তিনটি গ্রামের কমপক্ষে ১২৯ পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সেনাবাহিনী ও বিজিবির উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলার অন্যতম পাহাড়ি ও জুম্ম অধ্যুষিত এলাকা সাজেক পাহাড়ে রুইলুই ভ্যালিতে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র। এই পর্যটন কেন্দ্রের ফলে ইতিমধ্যে পাঁচটি পরিবার উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী তাদের জন্য টিনের বেড়া দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে। পর্যটকদের কাছে চিড়িয়াখানার জীবজন্তুর মতো আদিবাসীদেরকে দেখানোর এ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। এই পর্যটন কেন্দ্রের ফলে সন্নিকটস্থ দু’টি গ্রামের আরো ৬৫টি জুম্ম পরিবার উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে। এই পর্যটন কেন্দ্রের ফলে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও জনসমাগমের প্রেক্ষিতে সাজেকের বনজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী স্থানীয় পর্যটন অর্থাৎ পার্বত্য জেলার পর্যটন বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় বা কার্যাবলী। এই স্থানীয় পর্যটন বিষয়টি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত হলেও তা যথাযথভাবে হস্তান্তরিত হয়নি। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বা অন্য কোন সংস্থার দ্বারা পরিচালিত কোন দপ্তর ও পর্যটন কেন্দ্র পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত হয়নি। কেবল পার্বত্য জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত পর্যটন প্রকল্প ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ার রাখা হয়নি, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সম্পূর্ণভাবে বিরোধাত্মক। পক্ষান্তরে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করে চলেছে।
২০১৪ খ্রিস্টাব্দে যে চুক্তিনামার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যটন কার্যাবলী হস্তান্তর করা হয়েছে উহা বাতিল করে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে উক্ত স্থানীয় পর্যটন বিষয়টির সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহ পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট পূর্ণাঙ্গভাবে হস্তান্তর করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে বৈঠক করে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্বাহী আদেশে হস্তান্তরকল্পে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু আজ অবধি তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।