মিতুল চাকমা বিশাল
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালে। তৎপরবর্তী জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে সামরিক জান্তা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তৎসময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অনেকটা তাল-মাতাল অবস্থায়। অধিকারকামী জুম্ম জনগণ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে মহান নেতা এম এন লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সমবেত হচ্ছিল। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের দাবিটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকারের দাবি, সুতরাং সেই দাবি অর্জনের জন্য জুম্ম জনগণ রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান চেয়েছিল এবং ঠিক সেভাবেই তারা অগ্রসর হচ্ছিল।
শুরু থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে এবং দেশের বিভিন্ন মহল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। মোটকথায় সমস্যাটি যে রাজনৈতিক, এটি স্বীকার করতে জাতীয় পর্যায়ে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল বলা যায়। তদুপরি এই অঞ্চলের মানুষদের সম্পর্কে শাসকগোষ্ঠী এবং অনেক জাতীয় নেতৃবৃন্দের মনেও একটা ভুল ধারণা জেগে বসেছিল। পার্বত্য চটগ্রামের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়াকে তাই অনেকেই তখন অবজ্ঞার চোখে দেখেন। উগ্র জাত্যভিমান আর ধর্মান্ধতা তাদের চিন্তা-চেতনায় এতটাই চেপে বসেছিল যে, তারা এক পর্যায়ে জুম্ম জনগণকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেও পিছপা হয় নি। অথচ জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে কোথাও বিচ্ছিন্নতার কিংবা স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করা হয় নি। বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি করা হয়েছিল।
এমতাবস্তায়, জিয়া সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যাটিকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে না নিয়ে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবেই বিবেচনা করেন এবং এর সমাধান অর্থনৈতিকভাবে করার জন্য ১৯৭৬ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬’ নামে এক অধ্যাদেশ জারী করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি যে একটি রাজনৈতিক সমস্যা, সেটিকে পাশ কাটিয়ে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে এবং সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সমন্বয়ে এই বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং বিশেষভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে জুম্ম জনগণের অসন্তোষকে উন্নয়নের প্রলেপ দিয়ে প্রতিহত করা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি পদাধিকারবলে এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হতেন এবং সাধারণ প্রশাসনের ন্যায় সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড (রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষাবৃত্তি, কনস্ট্রাকশন, স্কুল নির্মাণ ইত্যাদি) এই বোর্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালনা করা হতো।
ঐতিহাসিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ শাসনব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেও আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের সমন্বয়ে এই বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে পুনপ্রবর্তন হয়েছে। যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি জুম্ম (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং এতদঞ্চলের প্রশাসনিকসহ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে জুম্মদের অগ্রাধিকার থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
এছাড়াও উন্নয়ন বোর্ডকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আওতায় আনা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে পার্বত্য চুক্তির ‘গ’ খন্ডের ১০নং ধারা মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক আঞ্চলিক পরিষদের সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে অর্পিত দায়িত্ব পালন করা এবং উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার যোগ্য উপজাতীয় প্রার্থীকে অগ্রাধিকার প্রদান করার বিধান রয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১) একজন জুম্ম এমপিকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে(২০০১-২০০৬) চুক্তির উপরোল্লিখিত বিধানকে লঙ্ঘন করে খাগড়াছড়ির তৎকালীন এমপি আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে(যিনি একজন সেটেলার) উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তৎপরবর্তী জরুরী অবস্থার সময়ে ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারও একই কায়দায় চুক্তির উক্ত ধারাকে লঙ্ঘন করে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ২০০৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিসনের জিওসিকে নিয়োগ প্রদান করে। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসলে আবারও একজন জুম্ম এমপিকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করা হয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই সুদীর্ঘ সময়ে উন্নয়ন বোর্ড আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ ব্যতিরেকেই নিজের ইচ্ছামাফিক তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যা প্রতি পদে পদে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ন করেছে।
অন্যদিকে উন্নয়ন বোর্ডকে চুক্তির আওতায় আনা হলেও ২০১৪ সালে এসে আওয়ামীলীগ সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা, পরামর্শ ব্যতিরেকে এবং প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতা সত্ত্বেও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪’ প্রণয়ন করে। যার ফলে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে একটি স্বতন্ত্র সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় রূপান্তর করা হয়েছে এবং এর দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। উক্ত আইনের বিভিন্ন ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক ও বিরোধাত্মক অনেক ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরো জটিল করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত উন্নয়ন কর্মকান্ড আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহে ন্যস্ত করার কথা রয়েছে, সুতরাং এর জন্য বিকল্প কোন প্রতিষ্ঠানেরই আর আবশ্যকতা থাকার কথা নয়। যার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে এই আইন বিলুপ্ত করার জন্য বরাবর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় নি। ফলশ্রুতিতে উন্নয়ন বোর্ড আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরুপ সমন্বয় না করে স্বাধীনভাবেই তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
তাছাড়া, উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালনা কমিটিতে আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের প্রতিনিধিত্বের বিধান থাকলেও বোর্ডের চেয়ারম্যান সরকার কর্তৃকই নিযুক্ত হন। যার ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকার ইচ্ছামত দলীয় সদস্যদের উক্ত পদে নিয়োগ দিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে উক্ত উন্নয়ন বোর্ড আইনের ‘ভাইস-চেয়ারম্যান’ পদে সরকার বরাবরই অ-স্থানীয় এবং অ-উপজাতীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে চলেছে। আইনানুসারে চেয়ারম্যানের মেয়াদ পূর্ণ হলে কিংবা চেয়ারম্যান কোন কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, তার জায়গায় ভাইস চেয়ারম্যানই বোর্ডের সমস্ত কার্যভার গ্রহণ করবেন এবং নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করে যাবেন। অনুরূপভাবে সম্প্রতি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার মেয়াদ শেষ হওয়ায়, বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল আলম নিজামীকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু উন্নয়ন বোর্ডের সকল কর্মকান্ডের তত্ত্বাবধান করার অধিকার আঞ্চলিক পরিষদের, কিন্তু উন্নয়ন বোর্ড আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে, সুতরাং এখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট বোর্ডের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে। একে তো বিশেষ শাসনব্যবস্থার উপর বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, অন্যদিকে দলীয় সদস্যের নিয়োগদান এবং অস্থানীয়দের নিয়োগ প্রদান এই বোর্ডকে একটি দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করার সুযোগকে প্রশস্ত করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের সুষম উন্নয়নের জন্য এতদাঞ্চলের বিশেষ শাসনকাঠামো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন অর্থই হয় না। যেহেতু এই অঞ্চলটি একটি বিশেষ অঞ্চল, সুতরাং এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য এখানকার বিশেষ প্রতিষ্ঠান, প্রথা, রীতি-নীতি সমস্ত কিছুকেই আমলে নিয়েই উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা অতীব জরুরী।
আইএলও কনভেনশন নং-১০৭ অনুসারে, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তাদের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংরক্ষণ এবং তারা উৎসাহিত হয় এমন উন্নয়ন গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাদ দিয়ে কোনক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়।
 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
             
             
                             
                             
                             
                                                     
                                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        