স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী: বঞ্চিত জাতি ও মানুষের সামগ্রিক মুক্তিতেই এর সার্থকতা

0
967
ছবি ক্রেডিট: prothomalo-english

বাচ্চু চাকমা

বাংলাদেশের ভূখণ্ড আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সচরাচর অনেক আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনও ঠিক তেমনই হবে আশা করছি। স্বাধীনতার পর ৭২ এর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে বলে যে অঙ্গীকার করা হয়েছে- সেই অঙ্গীকার আজ আমাদের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ! রাষ্ট্রের চার মূলনীতিও আজ তাঁর নিজস্ব জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কুশিয়ারা ও বুড়িগঙ্গা নদীর অনেক জল প্লাবিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে গেছে। অনেক ঝড়-বৃষ্টি ও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের স্রোত নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকদের ধ্যান-ধারণা যেন এখনও সেকেলের পাকিস্তানি শাসক ও আমলাদের মতই রয়ে গেছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। মনে হয়, অতীতের অনেক ব্যর্থতার স্মৃতি আমাদের হৃদয়ের গহীনে ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার অনেক সফলতার স্মৃতিও আমাদের দরজায় একেকটা সময়ে কড়া নেড়েছে। এই সফলতা ও ব্যর্থতার স্মৃতিগুলোই যাই হোক না কেন আজ হয়তোবা মানুষের হৃদয়ে রোমাঞ্চ ছড়াবে, সেই স্মৃতি মনে হলে অনেকেরই চোখে জল এসে যাবে, যুদ্ধকালীন সময়ের প্রিয় সহযোদ্ধাদের মনে পড়বে। কেউ চলে যাবে আর কেউ তো আসবে-এটাই তো জগতের নিয়ম! ৫০ বছর আগে ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে প্রায় নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে, কে আমাদের এই স্বাধীনতা দিল? স্বাধীনতা কি কেউ কাউকে দেয়? এই স্বাধীনতা কি বিনিময় করা সম্ভব? স্বাধীনতা এমনিতেই আসে না! কারণ, অধিকার কিংবা স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না, লড়াই করে-সংগ্রাম করে এবং সর্বশেষ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনতাকে আদায় করে নিতে হয়! এই মহান স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে অনেক মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও ইজ্জতের হোলিখেলা, ত্রিশ লক্ষ শহীদদের ত্যাগ, ঘাম ও রক্ত এবং বীর আত্মত্যাগীদের অদম্য সাহস, ধৈর্য্য ও পাহাড়সম মনোবল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ এসব বীর আত্মত্যাগীদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ করছি।

স্বাধীনতা ৫০ বছরে এসে আজ বাংলাদেশের আপামর জনতাকে সফলতা ও ব্যর্থতার পাল্লা এই দুটির মধ্যে কোনটি অধিক ভারী তা হিসাব করার সময় এসেছে। স্বাধীনতা নাকি একটি ধারণা মাত্র, একটি নির্ধারিত পরিসরে, কিছু বিধিবন্ধন সাপেক্ষে তার অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে! স্বাধীনতা আসলে ঠিক কি তাই! এক একজন স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসক তৈরি করার নামই কি স্বাধীনতা? স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই কি স্বাধীনতা? বাংলাদেশের এক দশমাংশ জায়গা জুড়ে পাহাড়ের প্রান্তিক জুম্ম জনগোষ্ঠীকে পায়ের তলায় পিষ্ট করে রাখার নামই কি স্বাধীনতা? পাহাড়ের বুকে অর্ধশতাব্দী ধরে নির্দয় সেনাশাসনের যাঁতাকলের নিবাসে বন্দী থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করে দুমড়ে-দুমড়ে অসহায় মানুষের কান্নার আহাজারি বন্ধ না করে বরং আক্রমণ করতে আরও প্ররোচিত করার নামই কি স্বাধীনতা? প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায় তা কি আমরা ভোগ করতে পেরেছি? এধরনের শত-হাজারো প্রশ্নের জবাব আজ কে দেবে?

বাংলাদেশের নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষেরা উপরোক্ত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজেছে প্রায় ৫০ বছর ধরে, কিন্তু এর উত্তর আজও মেলেনি! একটা বিষয় হচ্ছে, কোন প্রতিষ্ঠান যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার পশ্চাতে থাকে কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীগত ইচ্ছার প্রকাশ! তা যেমন নির্বাধ হতে পারে না, তেমনই ব্যক্তির আত্মঘাতের মতো স্বেচ্ছাসিদ্ধান্তকেও আমরা স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে মেনে নিতে পারি না। সুতরাং ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাই হোক, স্বাধীনতাকে একটা খোলা মাঠের সঙ্গেও তুলনা করা যায়, যার সীমা আছে এবং পরিসরও আছে। যে যার মত করে সেই খোলা মাঠে নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিবেশ থাকবে, যে যার মত করে কাজ করার স্বাধীনতা থাকবে, যে যার মত করে নিরাপদে-নিশ্চিন্তে এদিক, ওদিক চলতে-ফিরতে পারবে, যে যার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী অধিকার ভোগ করতে পারবে, যে যার মত করে কথা বলার স্বাধীনতা পাবে এবং মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা থাকবে-এটাই তো সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা। বাংলাদেশের আপামর খেটে-খাওয়া মানুষ এই স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার কি লাভ করতে পেরেছে? ত্রিশ লক্ষ শহীদদের রক্ত ও আত্মত্যাগ আজ বৃথাই মনে হচ্ছে! স্বাধীনতার সত্যিকারের সুফল আজও আমরা প্রাণভরে উপভোগ করতে পাইনি এবং আজও এই বাংলার মাটিতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি! যারা বাস্তববাদী, বিজ্ঞানভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ করেন এবং সত্যিকার অর্থে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে তারাই বলুক বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুফল কি আজও ঘরে ঘরে পৌঁছেছে? আমার অভিমত এই, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এখনও বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত! আজ বাংলাদেশের অধিকাংশই মানুষ গরীব হতে আরও গরীবে পরিণত হচ্ছে, আর বাকি কয়েক পারসেন্ট মানুষই ধনী হতে আরও অধিক পরিমাণে ধনীতে পরিণত হচ্ছে। এটাই তো বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতা, যার পরিণতি প্রতিটি সরকারই তৈরি করে দিয়ে চলে গেছে।

২৬ মার্চের ফলে আমরা কী পেয়েছি? সে দিনের সেই স্বাধীনতার নাম আসলে কি শুধুমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তর, নাকি প্রকৃত অর্থে লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছি। আমরা তো লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা। এক রাষ্ট্রের জন্ম, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডজাত মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই- এরই নাম সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা। এখানে দেশসংক্রান্ত এবং রাষ্ট্রীয় ধারণা একাকার। তারপরও কিন্তু কথা থেকে যায়, সে দিনের ‘স্বাধীনতা’ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি? রাজনীতির জটিল গোলকধাঁধায় কুটিল প্রয়োগ কি সেদিন দেশ সম্পর্কে ধারণাটি ছিন্নভিন্ন করে দেয়নি? শাসনক্ষমতার হস্তান্তর এবং স্বাধীনতার অর্থ যে এক নয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় বাংলার নিপীড়িত মানুষ ঠিকই বুঝতে সক্ষম হয়েছে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় শাসনক্ষমতা হস্তগত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, জন্মভূমি পুরো ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান এবং বৃহত্তর হিন্দু জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য সকল জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত হয় ভারত। সেই থেকে আজও এই ভারতবর্ষের মানুষ দ্বিখণ্ডিত হতে হতে খন্ড-বিখন্ড হয়ে আসছে। এই নির্মম বাস্তবতা যে কেউ অস্বীকার করুক, প্রকৃত ইতিহাসবিদরা কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি এবং অন্যায়ের সাথে লড়াই করে ন্যায়ের পক্ষে তাদের কলম চলেছে নিরন্তর গতিতে! কাজেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে অনেকেই বাস্তব সত্যটাই লিখে যাবেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটির প্রতিটি কোণায় গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে যখন পতাকা উড়ছিল তখন পরাজিত দেশের এক প্রান্ত থেকে পৃথকীকৃত ভূখণ্ডের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ উৎপাটিত হয়ে অসহায় ও নিঃসম্বল অবস্থায়, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে, চূড়ান্ত অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে এক রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিল। আর সেখানে ‘স্বাধীনতা’-র বোধ এবং আবেগ থাকা যথার্থই যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবসম্মত। স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে যেসব মানুষকে বাংলার ভূখণ্ডের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল পাকিস্তানীদের, এই মাটিতেই আমাদের জন্ম হয়েছিল, এখানেই রয়েছে আমাদের পিতৃপুরুষ ও মাতৃকুলের চিহ্ন, এই বাংলার জমি, ফসল, রোদ, বায়ু এবং অন্যান্য সবকিছু নিয়ে বংশ পরম্পরায় আমাদের জীবন জড়িয়ে আছে সেটাই হল আমাদের ‘বাংলাদেশ’। ‘স্বাধীন দেশ’ সম্পর্কিত গর্ব ও অহংকারের কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির বাস্তবতা আজও আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়নি। আমরা নিশ্চয়ই পাকিস্তানিদের অধীনতা চাইনি, দেশাত্মবোধের চেতনাকে লালন করে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এই প্রসঙ্গ নতুন নয়, আবার আলোচনার উর্ধ্বেও নয়। বরং প্রতিবারের মতোই স্বাধীনতা দিবস আসলে স্বাধীনতার আগেরকার যন্ত্রণার কথা স্মরণ করা উচিত। স্বাধীনতার নানাবিধ সংজ্ঞা এবং প্রকৃতি ওই ঘটনার মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছিল। আমাদের মনে হয়েছিল রাষ্ট্রই একমাত্র নাগরিকের সার্বিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কিন্তু আজ আমাদের সামনে মর্মান্তিক করুণ পরিণতিসমূহ দেখিয়ে দেয়, স্বাধীনতার চেতনা রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিমানসে সর্বত্র এক বিন্দুতে মেলেনি।

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নাগরিকের জীবন এবং ভূখণ্ড রক্ষা করে। সেই দেশের মধ্যে আছে সমাজ, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি। আছে নিয়ত বিবর্তনশীল মানবিক সত্তা। যা সমাজের প্রতিটি দিক, প্রতিটি ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মানুষের নৈতিকতা ও আচরণবিধির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায়। এখানে দেশ সম্পর্কে ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র সর্বত্র প্রবেশাধিকার পায় না। কারণ, রাষ্ট্র নিজেই সম্যক বা উত্তমরূপে বিধি ও নিয়মকানুন তৈরি করে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে। তবে একজন ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে একক সত্তা। তারপর সে সামাজিক সত্তা। কিন্তু সেই ব্যক্তি ছবি আঁকবে কিনা, গান গাইবে কিনা, সাহিত্য চর্চা করবে কিনা, রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয়ে ভিন্ন মতাবলম্বী চর্চা করবে কিনা, ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে কিনা ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজেও তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হ্রস্বতর বা অধিকতর হালকা হয়েছে বলে আমার ধারণা। অপরদিকে দেশের মধ্যে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে উগ্র ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ। এই পরিস্থিতি ও বাস্তবতার জন্য দায়ী কেবল দেশের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র ধর্মান্ধ মতাবলম্বীরা নয়, মাত্রাগতভাবে দায়ী আমরা সকলেই। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের গুরুত্ব সমান। দেশবাসীর অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার বিধিবন্ধন তৈরি করে রাষ্ট্র। সমাজের প্রয়োজনে নিয়ম সৃষ্টি করা হয়, সমাজ সৃষ্টি করে তার রক্ষক, শৃঙ্খলার নির্ণায়ক এবং পরিচালক। তাকে আমরা বর্তমান সময়ে বলছি ‘সরকার’ বা গভর্নমেন্ট। যে পরিকাঠামো অবলম্বন করে শাসনপ্রক্রিয়া চালায় ‘সরকার’ সেই হল রাষ্ট্র। প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের অধীন, এবং রাষ্ট্রের অংশ, আবার রাষ্ট্রের মালিকও বটে। রাষ্ট্র নাগরিকবৃন্দের স্বাধীনতা, জীবন, অধিকার এবং নিরাপত্তার রক্ষক। অর্থাৎ দেশ ও দেশবাসীর জীবনের ও স্বাধীনতা রক্ষার একটি প্রতিষ্ঠানই হল রাষ্ট্র।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমরা দেখতে পাই যে, অনেক সময় রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো নাগরিক অধিকার হরণ করে। এই দেশেরই কতিপয় নাগরিক, যারা শাসনপ্রণালীর পরিচালক, তাদেরকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করি। সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর স্বাধীন থাকতে পারে না। মনে রাখা দরকার রাষ্ট্রীয় নীতি, সর্বজনস্বীকৃত সংবিধান ও আইন একটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তা হল মানবিক সততা। যে মুহূর্তে কোনও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়, সে মুর্হুতে রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তার বা ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটতে থাকে, তখন নাগরিকবৃন্দও আর স্বাধীন থাকেন না। এই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে একজন ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সহজেই লোপ পেয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা মানে কেবল শাসন প্রক্রিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, স্বাধীনতা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যা সচেতন নাগরিককে প্রতিটি মুহূর্তে তা অর্জন করে চলতে হয়। এই জায়গা থেকে আমাদের বাংলাদেশের মানুষকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে এবং মানুষকে সচেতন করার প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে আছে।

হ্যাঁ আমি স্বীকার করি, স্বাধীন দেশে আমরা ভোটাধিকার পাই এবং শাসনকার্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করি। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশচালনার যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু আমাদের আরও মনে রাখা দরকার এই যে, শুধুমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয় না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নজরদারিও তার নিজের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এই চেতনা যত বেশি উন্নত হবে, তত সমাজের ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক! রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সীমা কতদূর, আজকে দেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও সংগঠন, জাতীয় সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং নাগরিক সমাজকেও ভুলে গেলে চলবে না। কর্তব্যের অঙ্গীকারে স্বাধীনতা প্রতি মুহূর্তে অর্জন করতে হয়, এর চেয়ে সত্য আর কিবা আছে। বাংলাদেশের প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ময়লা জমেছে। আমরা জানি, শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লবেই একমাত্র মুক্তি! এই মুক্তির পথকে সম্পূর্ণভাবে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে! স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এটাই আমার ব্যক্তিগত উপলদ্ধি ও বিশ্লেষণ!

মানবসমাজের হাজার, লক্ষ-কোটি বছরের পথ চলাতে ৫০টি বছর খুব বড় সময় নয়। তবে এমন সময়ের ব্যবধানে কোনো কোনো জাতির অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে। আজ আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের দেশ কতটা এগিয়েছে, কী ছিল আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা, এরই মধ্যে পূরণ হয়েছে কতটা? কোথায় আমাদের ব্যর্থতা, এই ব্যর্থতার কারণ কী কী? স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য যদি হয় ভৌগোলিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বা ভূখণ্ডের অধিকারী হওয়া, সেটি তো ৭০ দশকের শুরুতেই অর্জিত হয়েছে। তবে শুধুমাত্র এটুকুই বাংলার নিপীড়িত মানুষের প্রত্যাশা ছিল না। পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে- এধরনের প্রত্যাশাও ছিল আমাদের সামনে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি এর ধারাবাহিকতা। ফলে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি এদেশের গণতন্ত্র। রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতাও এর বড় কারণ। অন্তত জাতীয় ইস্যুগুলোতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন। বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসের পথচলাতে কোনো সরকারের শাসনামলেই তা দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থই হয়ে উঠেছে প্রধান। অপরদিকে দেশের মধ্যে বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনধারা উন্নয়নে সরকারগুলোর ভূমিকাও হতাশাব্যাঞ্জক বলা যায়। বৃহত্তর বাঙালি জাতির মূল স্রোতধারার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলার গতিকে রোধ করার জন্য দেশের মৌলবাদী শক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহলের চেষ্টার কমতি দেখা যায়নি। এরই ফলে দেশের জাতীয় অগ্রগতি অনেক সময় মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি।

এবারের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এসেছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব বর্তমানে ভয়াবহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়ে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এমনতর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যতটা উৎসবমুখর ও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপনের কথা ছিল, ততটাই হচ্ছে না বলে ধারণা। তা সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের অংশগ্রহণ এ উৎসবের মহিমা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিদেশের অতিথিদের আগমণ বাংলাদেশের মানুষকে আরও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে বলে আমার মত। এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষকে মুক্তির দিশা জাগাবে, মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখার শক্তি আরও বাড়িয়ে দেবে এটাই কাম্য! স্বাধীনতার ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তীতে সকল শ্রেণি, পেশার মানুষকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা!