দুর্দশাগ্রস্ত জুম্ম শ্রমজীবীদের উপর পুলিশী হামলা: বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির উপর নিপীড়নের আরেক অধ্যায়

0
1207

বাচ্চু চাকমা

ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের নানান কলকারখানা থেকে হাজার হাজার জুম্ম শ্রমজীবী মানুষেরা তিন পার্বত্য জেলাখাগড়াছড়ি, রাঙ্গমাটি ও বান্দরবানে নিজের বাড়িতে ফিরছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে একদিন পাড়ি জমিয়েছিলেন এসব শহরে।কিন্তু আজ জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রিয় মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরছেন। কেন ফিরছেন হাজার হাজার পাহাড়িশ্রমজীবী মানুষ? উত্তর হল গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে, এবং সরকার ও গার্মেন্টস মালিকেরা তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না।মালিকপক্ষ বকেয়া বেতন নিয়ে টালবাহানা করছে বলে তাদের অভিযোগ।

গত ১৫ এপ্রিল ২০২০ থেকে খাগড়াছড়ি জেলা মানিকছড়ি নোয়াপাড়া আটকে পড়া শ্রমিকদের অবস্থা দেখে খুবই খারাপ লেগেছিল।শ্রমিকদের কি দোষ? চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা সবখানেই আজ মুনাফা লোভী গার্মেন্টস মালিকেরা তাদের কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে।সরকার এবং গার্মেন্টস মালিকেরা তাদের কি দায়িত্ব নেবে না? শহরে থাকলে বাড়ি ভাড়া দিয়ে তাদের থাকতে হয়, কিন্তু সেই বাড়ি ভাড়াআর খাদ্যের অর্থ পাবে কোথায়। যে শ্রমশক্তি বিক্রয় করে শ্রমিকের জীবন চলতো, সেই শ্রমশক্তি কেনার মতো কলকারখানার গার্মেন্টসমালিকদের করোনা মহামারী সময়ে কোন হদিস নেই। হাজার হাজার শ্রমিক কিভাবে বেঁচে থাকবে, যদি কারখানা মালিক তাদের বেতননা দেয়। বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারীর ভয়ংকর ছোবলে মুনাফা লোভী গার্মেন্টস মালিকদের পুঁজি আর বিনিয়োগ করতে পারবে না।কিন্তু এই সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য শ্রমিকদের পাশে কে থাকবে? ওরা শ্রমিক বলে কি তারা না-খেয়ে মারা যাবে।

এই সংকট যখন কেটে যাবে, তখন গার্মেন্টস মালিকদের কলকারখানা কে চালু করবে? শিল্প কারখানার মালিক তো আর মেশিনচালাতে পারেনা, শ্রমিকশ্রেণিকে তার পাশে থাকতে হবে। তাহলে কারখানা চালু রাখতে হলে মালিক আর শ্রমিকের পরস্পরেরবোঝাপড়ার ভিত্তিতে একসাথে পথ চলতে হবে। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে জীবন বিনাশী করোনা মহামারীর কারণে একটা সংকট তৈরি হয়েছে।এই সংকটের সময় শ্রমিকদের পাশে যদি সরকার এবং মালিকশ্রেণি না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে পুঁজিবাদের পতনের যুগ শুরু হয়েগেছে। সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সংঘাত অনিবার্য পরিণতি লাভ করবেই। তাই বলে এই নয় যে, শ্রমিক ছাড়ামালিক চলতে পারবে অথবা মালিক ছাড়া শ্রমিক চলতে পারবে। শ্রমিকদের এই দূর্দশার জন্য সরকার কখনো দায় এড়াতে পারে না।যথাসময়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে না পেরে হাজার হাজার শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে।

এই বাংলাদেশে এখন হাজার হাজার শ্রমিক বেকার ও কর্মহীন। যে শ্রমশক্তি বিক্রয় করে শ্রমিক বেঁচে থাকতো, সেই শ্রমশক্তি বিক্রয়করার জায়গাটিও আজ শ্রমিক হারিয়েছে। তাহলে কিভাবে চলবে শ্রমিকদের জীবন মান? সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে আজশ্রমিকশ্রেণির এই করুণ দশা। গার্মেন্টস মালিকদের অদূরদর্শী চিন্তার কারণে আজ শ্রমিকদের জীবন যায় যায় অবস্থা। সম্প্রতি সরকারগার্মেন্টস কারখানা চালু রাখতে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তাতে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার শর্ত থাকলেও এধরনের সরাকরি প্রণোদনা অর্থ বরাদ্দে আখেরে লাভ হয় কারখানা মালিকদেরই। অনেকটা তেলে মাথায় তেল দেয়ার মতো। অর্থনৈতিক প্যাকেজে শ্রমিকদের কথা থাকলেও শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ থাকে কেবল নামমাত্র। সরকার কারখানা মালিকদের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েশ্রমিকদের উপর দায়িত্ব শেষ করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শ্রমিকরাও বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষাও চিকিৎসা লাভের অধিকার আছে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য এই পাঁচটি মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব হল রাষ্ট্রের বাসরকারের। তারপরও এই অসহায়, বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের জীবন নিয়ে কেন ছিনিমিনি খেলা?

ভাবতেও খারাপ লাগে, নিজের ঘরে ফিরতে চাওয়া কর্মজীবী জুম্মদের দিনভর রৌদ্রে থাকতে হচ্ছে, দিনব্যাপী না খেয়ে উপবাস থাকতেহচ্ছে, তারপরও প্রশাসনের কোন পদক্ষেপ নেই। উল্টো অসহায় শ্রমজীবী মানুষদের উপর প্রশাসন হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো।এরপর রাত ১০ ঘটিকার সময় পর্যন্ত এসবের কোন সুস্থ সমাধান মিলে না, রাতভর খোলা আকাশের নিচে থাকার প্রস্তুতি চলছে।অনিশ্চিত আর নিরাপত্তাহীন জীবন নিয়ে রাতব্যাপী রাস্তায় খোলা আকাশে আজ থাকতে হবে। যার কারণে আজ বাংলাদেশেরশ্রমজীবী মানুষের এই বেহাল অবস্থা। জানিনা আজ তোমাদের রাতভর খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে কিনা। আমি যদিও ঘরেবসে রয়েছি, কিন্তু তোমাদের চিন্তায় আমার চোখে ঘুম আসছে না। পরে রাত আনুমানিক ১০.৩০ ঘটিকায় বিশেষ সূত্রে জানতেপারলাম, এইমাত্র খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য মিস শতরুপা চাকমার মাধ্যমে ফোনে নিশ্চিত হয়েছিল যে মানিকছড়িতে আটকেপরা জুম্ম শ্রমিকজীবী ভাই-বোনদের খাগড়াছড়িতে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরসহযোগিতায় স্ব স্ব জায়গায় তাদেরকে পৌছে দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে এবং তাদের স্ব স্ব এলাকার স্কুলে ১৪ দিন পর্যন্ত হোমকোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। তারপরও দেরিতে হলেও অনেক অনেক ধন্যবাদ খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনকে। এবার একটুখানিস্বস্তিবোধ করলাম, পরে দেখলাম আকাশের অবস্থা ভাল নেই। বৃষ্টি শুরু হয়েছে গেছে এবং সেই সাথে বাতাসও তীব্র বেগে বয়ছে। এইমুর্হুতে বাইরে থাকা জুম্ম শ্রমজীবী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথায় মনে পড়ল। এই সংকটের সময় ওরা কেমন আছে? ফেসবুকের অনেক ছবিতে দেখলাম, কালবৈশাখীর ঝর ও বৃষ্টির কবলে পড়ে তাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ।

১৬ এপ্রিল প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে শিরোনাম বলছে “শ্রমিকের মজুরি দেয়নি দুই হাজার কারখানা”। তাই বকেয়াবেতনের দাবিতে আশুলিয়া খেজুরবাগান এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন পোশাক শ্রমিকরা। কারখানা মালিকপক্ষ বেতন নিয়ে টালবাহানাকরছে বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। করোনার এই সংকটে মাসের অর্ধেক শেষ হয়ে গেলেও সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও খুলনার প্রায় দুই হাজার কারখানা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করেনি। এসবএলাকায় তৈরি পোশাক, বস্ত্র, সিরামিক, জুতা, পাটকলসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা রয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। তৈরিপোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ ১৬ এপ্রিলের মধ্যে মজুরি পরিশোধ করতে তাদের সদস্যদের প্রতিঅনুরোধ করেছিল। তবে অনেক কারখানার মালিকই নির্ধারিত সময়ে মজুরি দিতে পারেননি। মজুরি না পেয়ে রাজধানীর পাশাপাশিসাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহে ৫০টির বেশি পোশাক ও বস্ত্র কারখানার শ্রমিকেরাওবৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেন। বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধানতাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পাদক জুলহাস নাইন বাবু ও সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম এক যৌথ বিবৃতিতেবৃহস্পতিবার বলেছেন, একদিকে করোনার আতঙ্ক আর অন্যদিকে মজুরির অর্থ না পাওয়ার আতঙ্কে শ্রমিকেরা হিমশিম খাচ্ছেন।আজকের বিপদের দিনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব সরকার, মালিক ও ক্রেতাদের।

এবার দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত সংবাদে একটু ফিরে তাকানোর চেষ্টা করি, করোনার প্রভাবে চট্টগ্রামের দুটি রফতানি প্রক্রিয়াকরণঅঞ্চলের (ইপিজেড) ১৫টি তৈরি পোশাক কারখানা ৩০ থেকে ৪৫ দিনের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ ঘোষণার জন্য আবেদনকরেছে আরও অর্ধশতাধিক কারখানা। চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডের তথ্য মতে, সোমবার পর্যন্ত এ দুটি ইপিজেডের ৭০টিরমতো তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধের জন্য আবেদন করেছে। এসব কারখানায় প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ১৫টিকারখানাকে বন্ধের জন্য অনুমোদন দিয়েছেন বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।

কারখানাটিতে কাজ করেন আলমগীর হোসেন নামে এক শ্রমিক দ্য ডেইলি স্টার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘হঠাৎ করে কারখানা বন্ধকরায় আমাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। পরিবার নিয়ে এখন কীভাবে দিনযাপন করব তা বুঝতে পারছি না। এখন আগের চেয়ে প্রায়অর্ধেক বেতন দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। কী করবো বুঝে উঠতেও পারছি না। তিনি আরও বলেন, ‘বন্ধের পরও কারখানাচালু হবে কিনা তা নিশ্চিত না। এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি। বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইনের ভিত্তিতেই এসব কারখানা বন্ধেরঅনুমোদন দিয়েছে বলে দাবি করেছে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজেএমইএ’র সহ-সভাপতি এ এমচৌধুরী সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ‘এখন কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ খোলানেই। ক্রমেই আমাদের অর্ডার বাতিল হচ্ছে। আবার যারা অর্ডার স্থগিত করছেন তারা কখন পণ্য নিবেন তারও কোনো ঠিক ঠিকানানেই। কারখানা বন্ধ ঘোষণা করবেন তা নিয়ম মেনে, কিন্তু শ্রমিকদের জীবন মান কিভাবে চলবে তার জন্যও মালিক পক্ষের চিন্তা করাপ্রয়োজন।

গত ১৬ এপ্রিল সকাল ১১.৩০ ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি নোয়াপাড়ায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি জন্মদিয়েছে প্রশাসন। স্বল্প বেতনের এসব শ্রমিকেরা এদেশের নাগরিক হলেও প্রতিনিয়ত তাদের উপর চলছে এই ধরনের বর্বরোচিত হামলাআর অমানবিক নির্যাতন। এই দেশ এখনো জানেনা, পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির গণআন্দোলনের ফলে সরকারকে পালাতেহয়েছিল। এই অবহেলিত শ্রমিকশ্রেণিরাই একদিন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলো। শ্রমিকরা চাইলে জন্মশত্রু এই সরকারের পতনঅনিবার্য করে তুলতে পারে। মনে আছে কিনা জানিনা, গোটা ইউরোপ জুড়ে শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। ইংল্যান্ডের চার্টিস্ট আন্দোলনেরকথা এবং লুডাইট আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম রুপটি হল মেশিন ভাঙার আন্দোলন। নেডলুড নামে একজন তাঁতী শ্রমিক প্রথম মেশিন ভেঙে ক্ষোভের প্রকাশ ও অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তার নাম অনুসারে মেশিনভাঙার আন্দোলনকে বলা হয় লুডাইট আন্দোলন। এই আন্দোলন যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এরপর বিভিন্ন কারখানায় মেশিন ভাঙাশুরু হয়। সেই সময়ের ভীত ব্রিটিশ সরকার কারখানায় কারখানায় সৈন্য মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। এই লুডাইট আন্দোলনকেদমানোর জন্য প্রথমে ১৭৮২ সালে মেশিন ভাঙার অপরাধে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড এবং পরে ১৮১২ সালে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে আইনকরা হয়।

১৮৩৪-৩৫ সালে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্ট ছিল, কিন্তু ভোটাধিকার খুবই সীমিত পর্যায়ে ছিল। অভিজাত শ্রেণিরাই পার্লামেন্টে যেতে পারত, কিন্তু শিল্পপতিদের সে সুযোগ ছিল না। শ্রমজীবীদের ভোটাধিকার তো প্রশ্নই ওঠে না। বুর্জোয়ারা ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন শুরুকরে। শ্রমিকশ্রেণি তাদের সমর্থন দিয়েছিল। শ্রমিকশ্রেণির ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের ফলে ১৮৩২ সালে রিফর্ম এ্যাক্ট পাস হয়। এরপরভোটাধিকারের ক্ষেত্র প্রসারিত হল, বুর্জোয়ারা পার্লামেন্টে যাবার সুযোগ পেল। কিন্তু বঞ্চিত হল শ্রমিকরা। বুর্জোয়ারা নিজেদেরঅধিকারটুকু পাবার পর এই আন্দোলন থেকে সরে গেল। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে মাতা ঘামাবেই বা কেন? এই অভিজ্ঞতা থেকেশ্রমিকরা বড় ধরনের শিক্ষালাভ করল। এরপর ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের অর্থনৈতিক দাবি ও ভোটাধিকারের দাবি নিয়েসংঘবদ্ধ হয়েছিল। এবার বুর্জোয়াদের বাদ দিয়ে শ্রমিকরা এককভাবে দাঁড়াতে শিখেছেন। শ্রমিকরা সংগ্রামের উন্নততর ফর্মও আবিষ্কারকরেছেন। তা হল ধর্মঘট। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে শ্রমিকদের সংখ্যাও যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের চেতনা, সংঘবদ্ধশক্তি, সংগঠন এবং আন্দোলনের উন্নততর রণকৌশল।

১৮৩৫ সালে লন্ডন ওয়ার্কিং মেনস অ্যাসোসিয়েশন এর উদ্যোগে শুরু হয় মহান চার্টিস্ট আন্দোলন। এই আন্দোলনের রুপ ছিলদাবিনামা তৈরি করে শ্রমিকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে পার্লামেন্টে পেশ করা। এই দাবিনামাকে তারা বলতেন Peoples Charter. এইথেকেই আন্দোলন চার্টিস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। এই আন্দোলনটি শ্রমিকশ্রেণির দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলেছিল। চার্টিস্টআন্দোলনের সাধারণ রুপ হচ্ছে -১। দাবিনামা রচনা, ২। স্বাক্ষর সংগ্রহ, ৩। পার্লামেন্টে দলবদ্ধভাবে দাবিনামা পেশ, ৪। দাবিনামারসমর্থনে শ্রমিক সভা ও ৫। এই দাবির সমর্থনে ধর্মঘটের উদ্যোগ কখনও কখনও নেয়া হয়েছিল। এই দাবিনামার মধ্যে অর্থনৈতিকদাবিও ছিল আবার ভোটাধিকারের দাবিও ছিল। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের স্বাক্ষর সম্বলিত দাবিনামা পার্লামেন্টে পেশ করা হত, কিন্তুপার্লামেন্ট কখনো শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়নি। শ্রমিক আন্দোলনের একটা সাধারণ রুপ ছিল শ্রমিক সভা। দুই লক্ষ এবং চার লক্ষশ্রমিক সমাবেশে যোগ দিয়েছিল, শ্রমিক সমাবেশের এত বিশাল আকার দেখে সরকার ভীত হয়ে উঠেছিল। সরকার শ্রমিক সভার উপরওনিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। চার্টিস্ট আন্দোলন যদিও সফলতার মুখ দেখেনি তারপরও এই আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার শ্রমিকদের১৮ ঘন্টা শ্রম দিবস হতে ১০ ঘন্টা শ্রম দিবস মেনে নিত বাধ্য হয়। লেলিনের ভাষায় চার্টিস্ট আন্দোলন ছিল “প্রথম ব্যাপক, সত্যিকারঅর্থে গণভিত্তিক এবং রাজনৈতিকভাবে স্বচ্ছ শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলন”।

ফ্রান্সের শ্রমিক আন্দোলন দমন পীড়ন করার জন্য সরকার একদিকে বুর্জোয়াদের বিশেষ সুবিধা ও সরকারি ঋণ দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকেকৃষকের উপর প্রত্যক্ষ করের ভারও বাড়িয়ে দিয়েছিল। সরকার কৃষকদের কাছে বলে যে, শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবার জন্যকৃষককে এই বোঝা নিতে হচ্ছে। এইভাবে শাসকগোষ্ঠী শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ১৮৪৮ সালে ২২ জুন, সরকার জাতীয় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করল। এক লক্ষ তের হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ল। এরপর শ্রমিকরা বিদ্রোহে ফেটে পড়ল।এবার শুরু হল সশস্ত্র শ্রমিক অভ্যুত্থান। চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা ছাড়াও প্যারিসের অন্য শ্রমিকরা এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানে যোগ দেন। শ্রমিকপরিবারের নারী ও শিশুরাও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা বুলেট বানায়, যুদ্ধরত শ্রমিকদের পানি ও খাবার সরবরাহ করে এবং আহতশ্রমিকদের সেবাদান করে। প্যারিস শহরে শ্রমিকরা চারশতেরও অধিক ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন। এটা ছিল শ্রমিকশ্রেণির সত্যিই একঐতিহাসিক লড়াই। পরাজয় সত্ত্বেও এই অভ্যুত্থানে শ্রমিকরা যে সাংগঠনিক দক্ষতা ও সামরিক পারদর্শিতা দেখিয়েছিল, তা গর্ব করারমতো।

অপরদিকে এই দেশের যাবতীয় উন্নতির পেছনে শ্রমিকশ্রেণির অবদান কোন সরকারই শোধ করতে পারবে না। ঘাম আর রক্তেরবিনিময়ে গড়ে তুলেছে দেশে দেশে মানুষের সভ্যতা। এই সভ্যতা তৈরি হওয়ার পেছনে শ্রমিকদের রাত দিন শ্রম দিতে হয়েছে। কখনো শ্রমদিয়েছে ২৪ ঘন্টা, কখনো দিয়েছে ১৮ ঘন্টা আবার কখনো দিতে হয়েছে ১২ ঘন্টা শ্রম। বিরতিহীনভাবে শ্রম দিতে হয় শ্রমিকশ্রেণিকে।বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সংগঠন এবং আন্দোলন  সবচেয়ে বেশি আলোচিত৷ রানা প্লাজা ধসের পর থেকেশ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে দেয়ার আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে৷ কিন্তু সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো পোশাক কারখানা থাকলেও মাত্র ৬শ`রমতো কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন আছে৷ ২০০৬ সালের জুন মাসে পোশাক শ্রমিকরা বড় ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম তাঁদেরঅধিকার নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়৷ মাসিক মাত্র ১,৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা মজুরি নির্ধারণের বিরুদ্ধে তাঁরাপ্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷ কোনো শ্রমিক সংগঠন ওই মজুরি মানেনি৷ তখন তাঁরা তিন হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনকরেন৷ সরকার রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

স্বাধীনতার পর দেশের শ্রম আন্দোলনে তৈরি হয় নানা বিভাজন৷ ১৯৭৩ সালে কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়৷ এইশ্রমিক অসন্তোষে বহু শ্রমিক আহত হয়৷ ওই সময়ে টঙ্গী শিল্প এলাকায় শ্রমিক লীগ এবং শ্রমিক ফেডারেশনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখাদেয়৷ শ্রমিক সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ ১৯৭৩ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকে৷ এইসংঘাতের জের ধরে চট্টগ্রামের বারবকুন্ড শিল্প এলাকায় অনেক শ্রমিক নিহত হয়৷ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বিশ্বট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সদস্য পদ লাভ করে৷ ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর সারাদেশে একটি শ্রমিক সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবেপ্রতিষ্ঠিত হয়৷ ওটাই ছিল একক জাতীয় শ্রমিক সংগঠন৷ তার নামকরণ হয় জাতীয় শ্রমিক লীগ৷

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনগুলো বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম৷ হয়৷ এরপর শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের বাইরেওআশির দশকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ স্বৈরাচার এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়৷ শ্রমিকরা রাজনৈতিক দলেরসমান্তরাল কর্মসূচি দেয়৷ কারণ, তারা তখন মনে করেছিল দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে শ্রমিকদের অধিকার আদায় করা সম্ভবনয়, সম্ভব নয় শ্রমিক আন্দোলন৷ কিন্তু এরশাদ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক সরকার শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিক নেতাদেরদলীয় নেতায় পরিণত করে৷ ফলে শ্রমিক আন্দোলন বিভ্রান্ত হয়ে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হয়৷ শ্রমিক নেতারা নানাসুযোগ-সুবিধা নিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থে কাজ করে৷ সরকারের স্বার্থে কাজ করে৷ একই সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনকিছু বামপন্থি নেতাদের হাতে চলে যায়৷ স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন অস্তিত্ব হারায়৷ সরকার ও শিল্পপতিরা মনে করেন, এতেই শিল্পের লাভ।

সর্বশেষ বলতে চাই, ইতিমধ্যে শ্রমজীবী ভাই বোনেরা স্ব স্ব ঠিকানায় আশা করি পৌঁছে গেছে। কয়েকটি রাত, কয়েকটি দিন চরম দুঃসহসময় কেটেছে। সচেতন মহল ফেইসবুক মেডিয়ায় আন্তরিকভাবে সহমর্মিতা ও প্রশাসনের হামলার বিষয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদজানিয়েছিল। তবে মনে রাখবেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক ও ভয়ংকর মহাসংকট আমাদের কাছে।মানবজাতি এখন চরম হুমকির মধ্যে পড়ে আছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পরিণতি কি হবে, তা আমাদের সবাইকে অনুমান করাদরকার। কিন্তু এর শেষ কখন হবে তা কেউ জানে না। সারাবিশ্বে এই পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজারের অধিক মানুষের প্রাণ চলে গেছে, আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ। আমাদের প্রিয় দেশ বাংলাদেশেও করোণা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাটাদিনদিন বেড়ে চলেছে। তাই প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকুন, সবাইকে নিরাপদ রাখুন। ঘরমুখো পাহাড়িশ্রমজীবী মানুষের আটকে পড়া ও স্থানীয় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে আজ মুক্ত হয়েছো শতশত শ্রমিক ভাইবোনেরা। সরকার এবং গার্মেন্টস মালিকদের ভুলের কারণেই শ্রমজীবী মানুষের এই বেহাল অবস্থা তা কখনো ভুলে যাবে না। নিপীড়িতমানুষের জয় হোক।