হিল ভয়েস, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ঢাকা: আজ ১৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, ঢাকায় মেহনতি ও গণমানুষের নেতা তথা জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত, সাবেক সংসদ সদস্য ও বিপ্লবী মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা)’র ৮৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে “লারমা তোমার জীবনাদর্শ, চিরভাস্বর হয়ে প্রেরণা ছড়াক তারুণ্যের চেতনায়” শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন যৌথভাবে ঢাকার বাংলামটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বিকাল ৩:৩০ টায় এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনা সভায় সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন, লেখক ও সাংবাদিক নজরুল কবীর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এবং পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি অতুলন দাস, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা প্রমুখ। এছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চ্যং ইয়ং ম্রো।
আলোচনা সভায় মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র জীবন সংগ্রাম নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সভাপতি ছাত্রনেতা সুলভ চাকমা। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যদিও একটি অনুচ্চারিত নাম। কিন্তু তার লড়াই সংগ্রাম ও জীবনাদর্শ বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব তিনি সকল শোষিত, নিপীড়িত ও মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেছিলেন। এমনকি উনার পিতা, পিতামহ ও পরিবারের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন, আত্মত্যাগ করেছিলেন। একজন প্রাজ্ঞ সংসদ সদস্য হিসেবে সংবিধান রচনার সময় তিনি তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কিংবা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সংবিধানকে আরো বেশি গণমুখী ও জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা দীপায়ন খীসা বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন মাত্র ৪৩ বছরের, এত সংক্ষিপ্ত পরিসরের একটা জীবন এতটা বর্ণাঢ্য হতে পারে সেটা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন ব্যতীত খুব একটা দেখা যায় না। তিনি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। সমাজ বদলের জন্য মানুষকে সংগঠিত করেছেন। গণপরিষদে লড়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ফণীভূষণ প্রমুখ ব্যক্তিদের সাথে সাথে লারমা সংসদে উজ্জ্বল হয়ে নিজস্বতার ছাপ রেখেছিলেন। লারমা নারীদের কথা চিন্তা করেছেন কিংবা এই আদর্শ লালন করে বলেই জুম পাহাড়ে নারী গেরিলা বাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।”
লেখক ও সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সমগ্র নিপীড়িত মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি সকল মানুষের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যারা এই মুক্তির লড়াইকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলো তিনি তাদেরকে চিহ্নিত করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কোনো দয়ার দান ছিলো না। অনেক জুম্ম জনগণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই চুক্তি। আর এই আন্দোলন তথা জুম্ম জাতির লড়াই শুরু করেছিলেন এম এন লারমা। চিন্তা ও দর্শনে অনেক এগিয়ে ছিলেন এম এন লারমা। তিনি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য রাজনীতি করেছিলেন। ভোগবাদী সমাজের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছিলেন। আদিবাসী ছাত্র-যুবদেরকে এম এন লারমা’র এই জীবনাদর্শ নিয়ে অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে। তিনি একজন সাংসদ হিসেবে বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সংসদে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ডঃ জোবাইদা নাসরিন কণা বলেন, “তিনি কেবল জুম্ম জনগণের সংগ্রামের প্রতীকই নয়, তিনি এই ভূ-খণ্ডের অধিকার বঞ্চিত সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। এম এন লারমা কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছিলেন। সাধারণ জনগণের নিকট আন্দোলনের বীজ রোপণ করেছিলেন।”
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা খুবই মৌলিক একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন। যদিও তাঁর জন্ম হয়েছিলো আদিবাসী অঞ্চলে কিন্তু তিনি সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শকে লালন করার মধ্য দিয়ে আমরা অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাব।”
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে কেবল জুম্ম জনগণের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হলে সেটা প্রকৃতপক্ষে তাঁর অবদানকে খাটো করা হয়। তিনি প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলের একজন বিশ্বমানের নেতা। এম এন লারমার জীবনদর্শনকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।”
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র সভাপতি অতুলন দাস বলেন, “সাধারণভাবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে কেবল জুম্ম জনগণের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রকৃতপক্ষে একজন জাতীয় নেতা ছিলেন। যে ক’জন ব্যক্তির চিন্তাধারা ও জীবন ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেক বেশী অনুপ্রাণিত করে তাঁর মধ্যে এম এন লারমা একজন। এম এন লারমা সাম্যের পক্ষে লড়াই করেছেন। সকলের জন্য সংগ্রাম করেছেন।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রাম ছিল প্রগতির পক্ষে। তিনি সামন্তীয় নেতৃত্বের অধীন অথর্ব হয়ে থাকা সমাজকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সমগ্র জীবনটাই আত্মত্যাগের যা থেকে অধিকারকামী তরুণরা আজো প্রেরণা নেয়।”
হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা বলেন, “মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একটি আলোক-প্রদীপ। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন। তিনি জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংসদে কথা বলেছিলেন। তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন।”
আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দপ্তর সম্পাদক নিটোল চাকমা, আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি চিরান, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরা ও বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।