হিল ভয়েস, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, চট্টগ্রাম: আজ ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার “জুম পাহাড়ের আহ্বান, গাও নবীন মুক্তির গান” স্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে “নবীন বরণ ও বিদায় সংবর্ধনা ২০২৩” অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের নবীন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বরণ এবং ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সকালের পর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়া আদিবাসী নবীন শিক্ষার্থীদের পরিচয় ও অনুভূতি প্রকাশ এবং ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন বিভাগের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পরিচিতি ও স্মৃতিচারণ পর্ব সম্পন্ন হয়। এই পর্বে সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পহেলা চাকমা ও ফুংপ্রে ম্রো।
মূল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা। এছাড়াও সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বসুমিত্র চাকমা, ফার্মেসী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমে ছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক শাংথুই প্রু, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।
সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগ্রামী সভাপতি নরেশ চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমা। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সুখী কুমার তঞ্চঙ্গ্যা।
অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বরণমাল্য পাঠ করেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মনিষা তঞ্চঙ্গ্যা এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী তিথি তির্কী। নবীন শিক্ষার্থীদের মানপত্র ও ফুল দিয়ে বরণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বসুমিত্র চাকমা এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মানপত্র, ফুল ও উপহার সামগ্রী দিয়ে সংবর্ধিত করেন সহযোগী অধ্যাপক উমে ছেন।এসময় আলোচনা সভায় নবীন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন পালি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রিয়জ্যোতি চাকমা এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুইটি দেওয়ান।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, “নিজেকে গঠন করার জন্য যে যেখানেই থাকি না কেন আমাদের পাহাড়ে অস্তিত্ব ও শেকড়ের ডাকে ফিরে যেতে হবে, কারণ আমাদের শেকড় হচ্ছে পাহাড়। নবীনরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই নিজেকে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নেতৃত্বগুণ এবং সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ পায়। আমাদের কঠিন পরিস্থিতিতে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকলকে একে অপরের পাশে এগিয়ে আসতে হবে।“ এছাড়াও তিনি ছাত্র সমাজকে সুশৃঙ্খলতার সহিত নিজেকে গঠন করে সমাজের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানান।
সহকারী অধ্যাপক বসুমিত্র চাকমা বলেন, “মানুষকে প্রকৃতির রাজ্য থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি, একাগ্রতা ও ঐক্যবদ্ধতার মধ্যে। আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্যকে বিকশিত করে দর্শন ও প্রগতিশীলতার চর্চা করতে হবে এবং অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার জন্য নবীনদের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে।”
ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষক উমে ছেন বলেন, “শিক্ষার্থীরা যদি কখনো ব্যর্থ হয় তাদের উচিত সেই ব্যর্থতাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নেয়া। এভাবে দেশ, সমাজ, জাতি ও পরিবারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।”
প্রভাষক শাংথুই প্রু বলেন, “শিক্ষার্থীদের উচিত নিজেকে দক্ষ, যোগ্য, খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা, আত্মসচেতনতা এবং শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজ গঠনে কাজ করা।”
ছাত্রনেতা নিপন ত্রিপুরা তার বক্তব্যে বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শিক্ষা ব্যবস্থা যা প্রতিবাদবিমুখ শ্রেণির মানুষ তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত চিন্তা চর্চার স্থান হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা দেখা যায় না। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের সেসব বাধাকে অতিক্রম করে প্রগতিশীলতা চর্চার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের মতো অধিকারহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও ঐক্যবদ্ধ সামাজিকতা অত্যন্ত প্রয়োজন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ পরিসরের শিক্ষার্থীদের দায়বদ্ধতা বেশি। তারাই পারবে তাদের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে জাতি ও সমাজকে এগিয়ে নিতে।”
তিনি আরও বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ছাত্র-সমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে। এই চুক্তিতে একজন মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার সব ধরনের অধিকার রয়েছে। এই চুক্তি আমাদের অধিকারের সনদ। লারমার দেখিয়ে দেয়া পথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে ছাত্র-যুব সমাজকে এগিয়ে আসবে হবে। এই চুক্তিতে ২৫ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। এটা আমাদের এই প্রজন্মের ছাত্র-যুব সমাজকে জানতে হবে।”
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা তার বক্তব্যে বলেন, “ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় বিশ্বে বিভিন্ন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের সংগ্রামে তরুণ সমাজ সামনের সারিতে ছিল। তেমনি আমাদের জুম্ম সমাজের অস্তিত্ব রক্ষায়ও তরুণদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও নারীরাও নানা অনিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিদ্যাপীঠে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসা সময়ের দাবি।
সভাপতির বক্তব্যে নরেশ চাকমা বলেন,”বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়রনত আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সমাজের অগ্রগণ্য তরুণ হিসেবে তার নিজের শিকড়-অস্তিত্ব রক্ষায় সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় নামক জায়গা থেকে জ্ঞান অর্জন করে সমাজের জন্য কাজে লাগানো প্রয়োজন। মহান নেতা এম এন লারমা শিক্ষাবিপ্লবের মাধ্যমে জুম্মজনগণের অধিকারের আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান প্রজন্ম সমাজ পরিবর্তনের জন্য নিজের শিকড়ের কাছে ফিরে গিয়ে কাজ করতে হবে।”