মঙ্গল কুমার চাকমা
সম্প্রতি ১৭-২৮ এপ্রিল ২০২৩, নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদরদপ্তরে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের ২২তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। উক্ত অধিবেশন শেষে পার্মানেন্ট ফোরাম ২২তম অধিবেশন রিপোর্ট ও সুপারিশ গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। তবে এখনো সুপারিশ সম্বলিত সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
উক্ত রিপোর্টে জাতিসংঘের পার্মানেন্ট ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে অধিকতর জোরালো প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতিকেও স্বাগত জানিয়েছে পার্মানেন্ট ফোরাম।
নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি ষ্টার গতকাল রবিবার (৩০ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত এক সংবাদ প্রকাশ করেছে। এ প্রেক্ষিতে নিখিল কুমার চাকমা তাঁর ফেসবুকে “নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আদিবাসী সংক্রান্ত জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতিকে স্বাগত জানানো হয়েছে (শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৩)” মর্মে খন্ডিত তথ্য প্রকাশ করেন।
কিন্তু তিনি অত্যন্ত সচতুরভাবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে অধিকতর জোরালো প্রচেষ্টা চালানোর জন্য’ বাংলাদেশের প্রতি পার্মানেন্ট ফোরামের আহ্বানকে এড়িয়ে যান। অথচ পার্মানেন্ট ফোরামের এই সুপারিশটি হচ্ছে ২২তম অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এ থেকে একটা প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে পার্মানেন্ট ফোরামের আহ্বানে বাংলাদেশ সরকার কি যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
পার্মানেন্ট ফোরামের গৃহীত সুপারিশের উপর নিখিল কুমার চাকমার খন্ডিত তথ্য উপস্থাপন এবং চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বানকে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল তথা সরকারের প্রতিনিধি আবারো তাদের প্রবঞ্চনাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। নিখিল কুমার চাকমার এই অপপ্রয়াস নি:সন্দেহে জনমতকে বিভ্রান্ত করার হীনলক্ষ্যে চালিত হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। পার্মানেন্ট ফোরামের গৃহীত রিপোর্টের এই খন্ডিত অংশ প্রচারনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে জাতিসংঘও বাংলাদেশ সরকারের উপর সন্তুষ্ট- এই বার্তা দিতে তিনি চেষ্টা করেছেন বৈকি।
তিনি পার্মানেন্ট ফোরামেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকারের দেয়া বুলি টোটা পাখির মতো আওড়িয়েছিলেন। এবছর পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে ৪০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ১৫৫৫টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে যে উন্নয়নের ফিরিস্তি তিনি তুলে ধরেছিলেন, সেই উন্নয়ন কার্যক্রম আদিবাসী জুম্মদের জন্য কতটুকু টেকসই হবে যদি জুম্মরা তাদের জায়গা-জমি হারিয়ে ফেলে, তাদের চিরায়ত ভূমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে, যদি পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক তাদের স্বশাসন তথা নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে, যদি এলাকায় জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলাশয়ের উৎসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, যদি জুম্মরা তাদের প্রথাগত চাষাবাদ ও জীবনজীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়?
সরকারের বুলি আওড়িয়ে “চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে” বলে তিনি জাতিসংঘের মতো বিশ্ব ফোরামে গিয়ে যে মিথ্যাচার করেছেন, সেই মিথ্যাচারের ফলে পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর যে সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তার দায়ভার কি তিনি নিতে রাজী আছেন? তার কথা মতো যদি ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়, ৩টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয় এবং বাকি মাত্র ৪টি ধারা অবাস্তবায়িত থাকে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক ও সার্বিক পরিস্থিতি কেন এখনো চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো? গত বছর (২০২২) ২রা ডিসেম্বরে সরকার যেখানে ৪৮ ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেছিল, সেখানে বিগত ৫ মাসে আরো ১৭টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকারি প্রতিনিধিদের দাবি করায় সরকারের হাতে আলাদীনের চেরাগ দেখছেন আপামর মানুষ। অথচ বিগত ২০১৪ সাল থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেও চুক্তি বাস্তবায়ন করা যায়- এমনতর ভেলকিবাজিতে সাধারণ মানুষ হতবাক না হয়ে থাকতে পারে না।
৩টি ধারা আংশিক বাস্তবায়নসহ চুক্তির মাত্র ৪টি ধারা যদি অবাস্তবায়িত থেকে যায়, তাহলে চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১নং ধারায় স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য কেন ধীরে ধীরে ক্ষুন্ন হচ্ছে? উক্ত খন্ডের ২নং ধারা মোতাবেক কেন পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইন, বিধি ও প্রবিধান ইত্যাদি সংশোধিত হয়নি কেন? পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে রুজুকৃত হাইকোর্টের মামলা নিষ্পত্তির কাজকে এত বছর ধরে কেন সরকার ঝুলে রেখেছে?
চুক্তির ‘খ’ খন্ডের বিধান অনুসারে বিগত ২৬ বছরেও কেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি? এই খন্ডে স্বীকৃত বিধান অনুসারে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা কেন করা হয়নি? তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনের জন্য কেন ভোটার তালিকা বিধিমালা ও নির্বাচন প্রণীত হয়নি? কেন ২৬ বছরেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো হস্তান্তর করা হয়নি? কেন এখনো পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়নি? চুক্তি লঙ্ঘন করে জেলা প্রশাসকদের নিকট প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের এখতিয়ার কেন বাতিল করা হয়নি?
চুক্তির ‘গ’ খন্ডে সন্নিবেশিত বিধান অনুযায়ী কেন তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধানের প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হচ্ছে না? আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় সাধন করাসহ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন ও ইহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদির উপর সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করার প্রক্রিয়া প্রবর্তিত হয়নি কেন? আঞ্চলিক পরিষদের সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কেন দায়িত্ব পালন করছে না?
চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের সন্নিবেশিত বিধান অনুসারে কেন এখনো ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীরা তাদের জায়গা-জমি ফেরত পায়নি? কেন স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করা হয়নি আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদেরকে? পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম মূল সমস্যা ভূমি সমস্যা কেন ২৬ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি? জুম্ম জনগণ কেন প্রতিনিয়ত তাদের জায়গা-জমি হারাচ্ছে ও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে? অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি লীজ বাতিল হয়নি কেন? ভূমিহীন পাহাড়ি পরিবারগুলোকে কেন দুই একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়নি? কেন এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প ও ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন বলবৎ রয়েছে? নিরীহ জুম্ম জনগণ কেন প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর ধর-পাকড়, জেল-জুলুম, ঘরবাড়ি তল্লাসী, বিচার-বহির্ভুত হত্যার শিকার হচ্ছে?
নিখিল বাবু কিংবা মোসাম্মৎ হামিদা বেগম কি এসব প্রশ্নাবলীর উত্তর দিতে পারবেন? হয়তো দিলেও দিতে পারেন তাদের মনগড়া যুক্তি ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে।
কিন্তু এখানে মূল প্রশ্ন হলো, পার্মানেন্ট ফোরামের আহ্বানে কি সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে? ইতিমধ্যেই ২০১১ সালে ১০ম অধিবেশনেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সুপারিশ ছিল। ২০২২ সালে আগষ্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারও চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীন পক্ষগুলোকে অবাধে প্রবেশাধিকার দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান করেছিলেন। গত ২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোটিয়রও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জোরালো আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এত আহ্বান সত্ত্বেও সরকার তো অন্ধ-বধির সেজে রয়েছে।
আরো পড়ুন
জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামে সরকারি প্রতিনিধিদের আবারো মিথ্যাচার
কিন্তু মনে রাখা উচিৎ হবে যে, সরকারের অন্ধ-বধির সাজলে যে প্রলয় বন্ধ হবে তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। প্রলয় তার নিজস্ব গতিতেই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাবেই। সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, এনএসআই দিয়ে জুম্ম জনগণের উপর দেশে তো নিপীড়ন-নির্যাতন চলছেই, জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক মানবাধিকার ফোরামেও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও এনএসআই-এর নজরদারী ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে জুম্ম আদিবাসী অধিকার কর্মীদের কন্ঠরোধ করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
যারা লড়াই করতে একবার শিখেছে, তাদেরকে শত দমন-পীড়ন করেও তাদের লড়াই নস্যাৎ করা যায় না। তাই সরকার সামরিকায়নের মাধ্যমে দমন-পীড়ন করে এবং দেশে-বিদেশে মিথ্যাচার করে পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে জুম্ম জনগণ আরো বেশি জ্বলে উঠবেই উঠবে। তার সমাধানে একমাত্র পথ হচ্ছে কোনরূপ ষড়যন্ত্র ও ছলচাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করা। এতে করে পার্বত্য চুক্তির প্রস্তাবনা মোতাবেক বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা আরো বেশি মজবুত ও শক্তিশালী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।