জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামে সরকারি প্রতিনিধিদের আবারো মিথ্যাচার

0
347

মিতুল চাকমা বিশাল

প্রবাদ আছে, একটি মিথ্যাকে যদি আপনি বার বার, হাজার বার বলেন, তাহলে সেটিও একসময় সত্যে পরিণত হয়। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে অনেকটা সেটিই মনে হলো। মিথ্যাকে সত্য বানানোর এক মহাযজ্ঞ যেন সরকার শুরু করেছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের চুক্তি সম্পর্কিত জগাখিচুরী বক্তব্য ও অপপ্রচার নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক ও ষড়যন্ত্রমূলক।

অতি সম্প্রতি গত ১৭ এপ্রিল ২০২৩ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২২তম অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বাংলাদেশের আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে যে বক্তব্য প্রদান করেছে, তা আমাদেরকে হতবাক না করে পারেনি।

এই অধিবেশনে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মাৎ হামিদা বেগম বলেন যে, ‘বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশন নং ১০৭’কে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ জনগণ বাঙালি এবং এই বাঙালিরাই বাংলাদেশের বৃহত্তম নৃ-গোষ্ঠী ও বাংলাদোশের আদিবাসী।’ এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, ইংরেজী Indigenous, যার বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘দেশীয় বা স্বদেশজাত’। তবে এখানে (বাংলাদেশে) ‘আদিবাসী’ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে কেবল শব্দগত অর্থই মূল নয়, এখানে এর সাথে যুক্ত রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি একটি রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা। ‘বাঙালিরাই এদেশের আদিবাসী’-এর পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন স্যার বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় রাষ্ট্র মূলত ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’- এ দুয়ের মধ্যকার তফাৎ কোথায়, সেটা অনুধাবন করতে পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছে। আদিবাসী আর আদি বাসিন্দা যে এক নয়, এটা নিয়ে এত কোনো সিরিয়াস রাজনৈতিক বিতর্ক আমরা এ পর্যন্ত লক্ষ্য করিনি।

এখানে মনে রাখা জরুরী যে, ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অর্থ আদিবাসী, যেটা একটা সাংস্কৃতিক ক্যাটেগরি আর ‘আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস’ অর্থ হচ্ছে ‘আদি বাসিন্দা’ যা একটি ডেমোগ্রাফিক ক্যাটেগরি যা বসতিস্থাপনের সাথে সম্পৃক্ত। হাজার বছরের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বলে এতদঞ্চলের আদি বাসিন্দারা কোনো কালেই বাঙালি ছিলেন না। এমনকি বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাও বাঙালি ছিলেন না। তথাপি যদিও ধরেও নিই যে, আদিবাসীদের এদেশে আগমনের পূর্বেই বাঙালিদের এদেশে বসতি ছিল অর্থাৎ বাঙালিরাই এতদঞ্চলের আদি বাসিন্দা। তাতে এটা প্রমাণিত হয় যে, বাঙালিরা এতদঞ্চলের আদি বাসিন্দা, কিন্তু আদিবাসী নয়।’

এছাড়াও আদিবাসীদের সংজ্ঞা নির্ধারণে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রভৃতি সংগঠন বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেসব সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে, ‘তারাই আদিবাসী, যারা রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে পিছিয়ে পড়া। যাদের সাংস্কৃতিক, অথনৈতিক বৈশিষ্ট্য দেশের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। যারা যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিকভাবে শোষিত এবং নিপীড়িত। যারা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের চেয়ে তাদের প্রথাগত রীতি-নীতি ও পদ্ধতির উপরেই তাদের জীবনচর্চা করে, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় তারা প্রান্তিক এবং প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতায় পৌঁছে যাচ্ছে তারাই আদিবাসী।

আরো

সেনাশাসন প্রত্যাহার করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করুন

এখানে বাঙালিরা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শাসন্যবস্থায় প্রান্তিক নয়, বরং তারা শাসনব্যবস্থার শাসক ও রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠী। বাঙালি তাদের সামাজিক ও পারিবারিক বিরোধগুলো প্রথাগত আইন দিয়ে নিরসন করে না, করে রাষ্ট্রীয় আইন দিয়ে। অতএব, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট তথা বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা অর্থাৎ মোসাম্মাৎ হামিদা বেগম-রা কোনোভাবেই বাংলাদেশের আদিবাসী নয়। বরং রাষ্ট্রীয় শাসন-শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাঙালি ভিন্ন আলাদা সংস্কৃতি ও ভিন্ন অর্থনৈতিক জীবনধারার বৈচিত্র্যপূর্ণ সংখ্যালঘিষ্ট জাতি ও সম্প্রদায়রাই বাংলাদেশের আদিবাসী।

অপরদিকে বাংলাদেশ ১৯৫৭ সালের আইএলও কনভেনশন নং-১০৭ এ অনুস্বাক্ষর এবং স্বীকৃতি দিলেও কার্যত এই কনভেনশনের কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। আইএলও কনভেনশন নং-১০৭ এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ‘স্বাধীন দেশের আদিবাসী এবং ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বেলায়, যাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা জাতীয় জনসমষ্টির অন্যান্য অংশের চেয়ে কম অগ্রসর এবং যাদের মর্যাদা সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব প্রথা কিংবা রীতি-নীতি অথবা বিশেষ আইন বা প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।’ তাহলে কনভেনশন অনুসারে স্বাভাবতই বাংলাদেশের বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোই কম অগ্রসর, পিছিয়ে পড়া এবং প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের উপরই বেশি নির্ভরশীল। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালি জনগণ কোনভাবেই আদিবাসী নয়।

একইসাথে এই কনভেনশনের দ্বিতীয় অংশের ১১, ১২ ও ১৩ নং অনুচ্ছেদে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির উপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে এবং আদিবাসীদের পূর্ব সম্মতি ব্যতিরেকে নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না মর্মেও উল্লেখ আছে (পার্বত্য চুক্তিতেও এরূপ আইন ও বিধান করা আছে), যা এখনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি। যদি বিশেষ বাস্তবতায় তাদেরকে সরানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে তাদের পূর্ব অধিকৃত ভূমির সমান ভালো মানের জমি প্রদান করতে হবে, যা তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের উপযোগী। এছাড়া সংশ্লিষ্ট আদিবাসীদের যে কোন ক্ষতি বা জখমের জন্য সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে।

একইভাবে এই কনভেনশনের ২৩নং অনুচ্ছেদে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে (পার্বত্য চুক্তিতেও এ বিষয়ে উল্লেখ আছে) এবং যদি স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর মধ্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষাতে শিক্ষা প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বোপরি এই কনভেনশনের মাধ্যমে আদিবাসীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করা এবং তাদের জীবনধারাকে উন্নত করার বিধান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাই যে, বাংলাদেশ সরকার আইএল কনভেনশন নং-১০৭ অনুস্বাক্ষর এবং স্বীকৃতি দিলেও কার্যত এই কনভেনশনের কোন কিছুই তারা বাস্তবায়ন করেনি এবং সে সম্পর্কিত কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সমতলে প্রতিনিয়তই পর্যটন, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণ ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তার কারণ দেখিয়ে আদিবাসীদেরকে স্ব-ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

মোসাম্মৎ হামিদা বেগম দাবি করেন, চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আদিবাসীদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত। এটি মাত্র আংশিকভাবে সঠিক। কেননা সরকার ২০১৮ সালে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আদিবাসী কোটা সহ সমস্ত কোটা বাতিল করেছে। আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখনও কোটার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সচিব মহোদয় সেই বিষয়টি অনুল্লেখ রেখে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।

মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৬টি ভাষাতে বই ছাপানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে, সেটিও কার্যত অকার্যকর অবস্থায় পড়ে রয়েছে। উপরন্তু, অবশিষ্ট ৪৪টি আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের বিষয়টি এখনো সুদূর পরাহত অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে দেশের ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিলুপ্তির পথে বলে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। দেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসীদের ভাষাই রয়েছে হুমকির মুখে, বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু জনবল, তহবিল ও পারিসম্পদের অভাবে এ প্রকল্প চলছে ধুঁকে ধুঁকে। এভাবেই আজ পৃষ্টপোষকতার অভাবে এবং বাংলাভাষার আধিপত্যের শিকার হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশের আদিবাসীদের ভাষা।

হামিদা বেগম আরো বলেছেন যে, ‘আমাদের আরো স্মল এথনিক মাইনিরিটি গ্রুপ আছে, যারা আমাদের সংবিধানে নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও সুযোগ নিয়ে যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়েছে।’

হামিদা বেগমের এই বক্তব্যও সঠিক নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অপরাপর জাতিগোষ্ঠীগুলোকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সংবিধানের ৬(১)-তে ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে’ এবং ৬(২)-তে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া গণ্য হইবেন’ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে বসবাসকারী সকলকেই এক কলমের খোঁচাতে জাতিগতভাবে বাঙালি বানানো হয়েছে।

একইভাবে সংবিধানের ২৩(ক)-তে কেবলমাত্র উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জাতিগতভাবে তাদের ভূমি, অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর তাদের প্রথাগত অধিকার, শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক অংগ্রহণ, উন্নয়ন কার্যক্রমে সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা, স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতির অধিকারের কথা সংবিধানে উল্লেখ নেই। তাহলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে কেমন করে সমান অধিকার ও সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশের অপরাপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার স্বীকৃত হয়েছে সেকথা আমার বোধগম্যতার বাইরে।

একইভাবে, চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কেও হামিদা বেগম উদ্ভট ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পার্বত্য চুক্তির ৬৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে’। ১৮ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমাও এতই বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। এই বক্তব্য শুনে যে কারোরই ‘আক্কেল গুড়ুম’ হবে। এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে, এমনকি গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বলা হতো চুক্তির ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু এই ৪ মাসের ভেতরেই রাতারাতি ১৭টি ধারা আরো বাস্তবায়ন হয়ে গেল, অথচ আমরা টেরই পেলাম না!

জনসংহতি সমিতির সমীক্ষা অনুসারে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ ধারা, বিশেষ করে চুক্তি মৌলিক বিষয়সমূহ সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রাখা হয়েছে, যার চিত্র বিভিন্ন স্বাধীন গবেষক, শিক্ষাবিদ ও প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে। কাজেই এটা সরকারের প্রতিনিধি পার্বত্য সচিবের এটা জলজ্যান্ত মিথ্যাচার বৈকি কিছু নয়। চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দুই পক্ষের এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য সমাধানের জন্য দুই পক্ষেরই এগিয়ে আসা দরকার। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির মাধ্যমে যাচাই ও পরীক্ষা করে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রকৃত অবস্থা নির্ধারণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।

চুক্তি স্বাক্ষরকারী এই আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর ও তৎপরবর্তী ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৪ বছরসহ সর্বমোট ১৯ বছর ক্ষমতায় রয়েছে এবং ২০১৪ সাল থেকে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশের ক্ষমতায় রয়েছে। তথাপি এই সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ বা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেনি। এমনকি চুক্তিকে একটি সাংবিধানিক আইন হিসেবে পরিণত করার জন্য সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তারা এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নি।

আরো

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পার্বত্যচুক্তি বিরোধী কার্যক্রম ও তার প্রতিক্রিয়া

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্যে স্থানীয়দের জন্য আলাদা ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সাধারণ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বিষয়গুলো জেলা পরিষদে হস্তান্তর, স্থানীয় পর্যটন, ভূমি ও ভূমি সমস্যা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়ার মত মৌলিক বিষয়গুলো সম্পূণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাছাড়াও, চুক্তি মোতাবেক প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে সংশোধন, সংযোজন ও পরিবর্তন করার বিধান থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে এসম্পর্কিত কোন উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না।

অপরদিকে নিখিল কুমার চাকমা বলেছেন যে, “পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে’ চলতি বছরে ৬০টি প্রকল্প এবং সর্বোপরি ১৫৫৫টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।” কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে জুম্ম জনগণ নির্বিচারে নির্যাতিত ও অপরাধী হচ্ছে, তাতে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। আদিবাসীদের যত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হোক না কেন, যদি আদিবাসীরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে, তাদের ভূমি হাতছাড়া হয়ে পড়ে, তাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলের উৎস ধ্বংস করা হলে সেই উন্নয়ন কখনো উপকারে আসবে না। বরং চরম ক্ষতি সাধিত করবে। লামা সরই ইউনিয়নে লামা রাবার কোম্পানী কর্তৃক ম্রো ও ত্রিপুরাদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের উদ্যোগে ঘরবাড়ি ও জুম ভূমিতে অগ্নিসংযোগ ও হামলা তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ। ম্রোদের ভূমি জবরদখল ও জীবনজীবিকাকে বিপন্ন করে চিম্বুকে সেনাবাহিনী কর্তৃক পাঁচ তারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ তার মধ্যে আরেকটি জাজ্জ্বল্য উদাহরণ।

নিখিল কুমার চাকমা পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়নের কথা বলেছিলেন, কিন্তু চুক্তিতে উন্নয়ন বোর্ড সংক্রান্ত যে ধারা রয়েছে সেই ধারা তিনি নিজেই পালন করছেন কিনা বলুক। পার্বত্য চুক্তিতে বিধান করা হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আঞ্চলিক পরিষদের সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু তিনি উন্নয়ন বোর্ডকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে বোর্ডের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন? নিঃসন্দেহে উত্তরটা হবে ‘না’।

আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে পাশ কাটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ন করে চলেছে এবং প্রশাসন ও উন্নয়নে জটিলতা সৃষ্টি করছে। পার্বত্য চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইনে পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা এবং জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার বিধান করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, যা পার্বত্য জেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী অধিকার তথা স্বশাসনের এখতিয়ারকে খর্ব করছে।

পার্বত্য সচিব বলেছেন, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আদিবাসীদের উন্নয়ন কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে চলমান ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্যন্ত সরকার কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সরকার আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করবে এবং আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু এগুলো মাত্র এভাবে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিশ্ববাসীর তুলে ধরার জন্য, বাস্তবায়নের জন্য নয়। কারণ সত্যিকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার আন্তরিকতা থাকলে আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯ অনুস্বাক্ষর না করে এবং আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন না করে পড়ে থাকতো না।

পার্বত্য সচিব আরো বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দশক ব্যাপী সংঘাত শেষ হয়েছে। পার্বত্য সচিবের এটাও চরম মিথ্যার বেসাতি। চুক্তি মোতাবেক অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ও ‘অপারেশন দাবানল’ নামে সেনাশাসন প্রত্যাহারের পরিবর্তে সরকার একের পর এক ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে। যা সংঘাতকে আবারো নতুন করে উস্কে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী নামে খ্যাত জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি, বমপার্টি নামে খ্যাত কুকি-চিন পার্টি প্রভৃতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি খ্যাত সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক সংগঠন গঠন করে দিয়ে, আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে লিপ্ত জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

জাতিসংঘের মত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অধিবেশনে সরকারের প্রতিনিধিদের এহেন বক্তব্য কার্যত বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতা এবং আদিবাসীদের প্রতি সরকারের বৈরিতার মনোভাবকেই প্রমাণ করে। এসবের দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কতটা আন্তরিক এবং দেশের আদিবাসীদের বিষয়ে কতটা সংবেদনশীল। সত্যি বলতে সরকারের উচিত এই পার্বত্য চুক্তি নিয়ে এবং আদিবাসীদের নিয়ে আরো দায়িত্বশীল ও আন্তরিকতার সহিত নিজেদের বক্তব্য পেশ করা এবং সমন্বয় করা। কিন্তু সরকার সেটি করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

অতএব, আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে তথা দেশের আদিবাসীদের নিয়ে সরকার নিজেদের বিপরীত অবস্থানকে সরিয়ে আনুক। বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যমন্ডিত বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির দেশ। বিশ্বের কোনো দেশ বা কোনো রাষ্ট্রই একক জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না। অতএব, আমাদের প্রত্যাশা এই রাষ্ট্র তথা সরকার আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসুক। অপরদিকে দেশের এক দশমাংশ অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে যদি এই রাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে, সেটাও ভুল হবে। ঐতিহাসিকভাবে কোনোপ্রকার তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তিকে নিয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থান কোনভাবেই কাম্য নয়। এই অবস্থান সরকারের ভাবমূর্তিকে কোনভাবেই উজ্জ্বল করবে না, বরং ক্ষুণ্ন করবে।

আরো পড়ুন

পাহাড়ে রাজনৈতিক সমস্যার তিনটি দিক: সেনা, সেটেলার ও ভূমি

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান বাস্তবতা: সমস্যা ও করণীয়