হিল ভয়েস, ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ঢাকা: ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ৫ম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, রাজনৈতিক দিকদর্শন নিয়ে আদিবাসীদের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আজ ২৮ এপ্রিল ২০২৩ শুক্রবার, ঢাকার আগারগাঁওস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রী সন্তু লারমা। সংগঠনটির ভূমি ও আইন বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম ও কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমিলার পরিচালনায় উক্ত আলোচনা সভায় সংহতি বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওর্য়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, বিশিষ্ট নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামাল, বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ প্রমুখ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
সভাপতির বক্তব্যে শ্রী সন্তু লারমা শুরুতেই সদ্য প্রয়াত প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য্যরে প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এসময় জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের এখন যে বাস্তবতা সেটা হলো আমরা বঞ্চনার মধ্য দিয়েই জীবন অতিবাহিত করছি। আজকে আমরা জীবনের জন্য কার কাছে যাবো, কোথায় যাবো। সে জন্য রাজনৈতিক দিকদর্শন নিয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আদিবাসীরা সংখ্যায় কম হতে পারি, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দর্শন নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে নিতে হবে।
আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসী মানুষেরা এই দেশের বুকে নিজেদের মাতৃভাষা, স্ব স্ব শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। অনেক কঠিন সংকটের মুখেও আমরা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আদিবাসীদেরকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে পিছিয়ে রেখে বাংলাদেশ সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে পারে না। তাই কাউকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তা আমরা বিশ্বাস করি না।
তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি আদিবাসীদের মন খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বিনির্মাণ করতে হবে। আমরা এক সাথে পথ চলতে চাই। কিন্তু আমাদেরকে জায়গা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাঙালি জাতি বড় জাতি। আমি শুনেছি, বাঙালি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম। আমাদের অনেক আদিবাসী জাতির মানুষের সংখ্যা ৮৫ জন, অনেক জাতির ২০০০ জন। এই ছোট ছোট সংখ্যার আদিবাসী মানুষদের জায়গা বাঙালি জাতি দিবে না তা হতে পারে না।
আলোচনা সভায় বাংলাদেশের ওর্য়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, এটা আমাদের জাতীয় জীবনে লজ্জার যে, জাতি রাষ্ট্র গঠনের সময়ে আমরা একটা সুন্দর সংবিধান রচনা করতে পারলেও আমরা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারি নি। বরং তাঁদেরকে আমরা বাঙালি হয়ে যেতে বললাম, আমরা তাঁদের রক্ষা করতে পারছি না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এ লজ্জা নিয়ে চলেছি। কিন্তু আমরা জানি যে, আদিবাসীরাও এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, আমরা পাহাড়ের সমস্যাকে নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখার চেষ্টা করি সবসময়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে পাহাড়ে শান্তিচুক্তি হয়েছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। এই বাস্তবায়নের লড়াই কেবল আদিবাসীদের একার নয়। আদিবাসী-বাঙালির ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম বাইরের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং এদেশে যারা আছি তাদের সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমরা দেখি বাঙালি-আদিবাসী এবং বাঙালিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যেও বিরোধ আছে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভাগ-বিরোধ করাটা যেমন সাম্প্রদায়িক তেমনি বাঙালি-আদিবাসীর মধ্যে ভাগ বিরোধ করাটাও সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িকতা মানবতার শত্রু।
আদিবাসীদের পরিচয় বিভ্রাটের সমাধান করার দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাঝুঝি হয়েছিল। সেটা একেবারেই লাঠালাঠির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সেই ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়েছিল সন্তু লারমা এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এই চুক্তির অনেক অংশ বাস্তবায়ন হলেও অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তি হয়েছিল রাষ্ট্রের সাথে আদিবাসী জনগণের। কাজেই যে সরকারই আসুক তা বাস্তবায়ন করা দরকার। তাছাড়া সংখ্যালঘু জাতি সত্তাসমূহের রক্ষায় সুরক্ষা আইন দরকার এবং একটা কমিশন গঠন করা দরকার।
নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নেই। যা আছে সব লুন্ঠনের রাজনীতি। সেটা হলো সংখ্যালঘুর বাড়ি আক্রমণ করা এবং আদিবাসীদের পল্লি আক্রমণ করা। আর আক্রমণের পর তাড়িয়ে দিয়ে তাদের যা আছে তা লুট করা।
তিনি আরো বলেন, সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় সংস্কৃতিই রাজনীতিকে পথ দেখাত। কিন্তু সংস্কৃতি যখন থেকেই রাজনীতির দাস হয়ে গেছে তখন থেকেই আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। যার জন্য আমাদের সমস্ত ক্ষেত্রেই আজকে রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে যন্ত্রণা যার তাকেই তো লড়াইটা করতে হবে। তবুও আদিবাসী সমস্যা শুধুমাত্র আদিবাসীদের একার নয়। এদেশের সমস্যা পীড়িত মানুষদের মধ্যে আদিবাসী সমস্যাও অন্যতম। কাজেই এই সম্মেলন যেমন আদিবাসী জনগণের ঐক্য কামনা করছে, তেমনি আমরাও নিপীড়িত সকল মানুষের ঐক্য রচনায় কাজ করবো। আদিবাসীদের নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যাদের থেকে আদিবাসীরা প্রত্যাশা করে তাদেরকে পরিষ্কার করতে হবে যে, আদিবাসীদের সমস্যার সমাধানে সেসব রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কী। এটা আদিবাসীদেরকে বুঝে নিতে হবে। উন্নয়নের নামে দুর্বৃত্তায়নের যে ধারা অব্যাহত আছে এটার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশ ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এখনো আদিবাসীদের উপর নানা ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এইসব ঘটনার দায় সরকার এড়াতে পারে না। বরং পাহাড়ে জনগোষ্ঠীর যে সংগ্রাম সে সংগ্রামকে ধুলিংসাৎ করার চক্রান্ত চলমান রয়েছে। এমনকি সমতলেও এই ধারা চলমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, আদিবাসী ফোরামের জন্ম হওয়াতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ হয়েছে। পাহাড় ও সমতলের লড়াই পৃথক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এখন পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের একসাথে গ্রথিত করেছে। যদিও পাহাড়ের আদিবাসীরা সমতলের আদিবাসীদের তুলনায় সংগ্রামের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে আছে। জনসংহতি সমিতি যেমন পাহাড়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরী করার সংগ্রাম করে এসেছে তেমনি আদিবাসী ফোরামও গোটা দেশের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন নেতৃত্ব তৈরীর কাজ করে যাচ্ছে। দেশে এ নেতৃত্ব তৈরী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে বাংলাদেশের আদিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন , সবাই আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের শুরুর কথা বলেন। তবে সেটি যে এখনো চলমান রয়েছে তা কেউ শক্তিশালীভাবে বলছে না। তবে আমি মনে করি, এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী যুবকেরা বেশ মাজা শক্ত করে দাঁড়িয়েছে। মধুপুর অঞ্চলে লেক খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে যুবকেরা রুখে দাঁড়িয়েছে। বান্দরবানেও ফাইভ স্টার হোটেল প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁিড়য়েছিল সেখানকার আদিবাসী যুবকরা। এভাবে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ভারতে বন অধিকার আইন হয়েছে। সেখানে স্বীকার করা হয়েছে যে, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার মাধ্যমে বন নির্ভর মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকার ঐতিহাসিক অবিচার করেছিলো। তার জন্য সেখানে ফরেস্ট রাইটস এ্যাক্ট করা হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে তারা আস্তে আস্তে বন ও ভূমির উপর অধিকার ফিরে পাচ্ছে যা আমরা এদেশে করতে পারছি না। আমরা দেখছি বান্দরবানের লামা রাবার কোম্পানি আদিবাসীদের ভূমি দখল করছে। সরকার এত শক্তিশালী যে আমাদেরকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। কিন্তু একটা রাবার কোম্পানিকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকার আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে না।
নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, পার্বত্য চট্টগামকে একটি মিলিটারি জোনে পরিণত করা হয়েছে। এই মিলিটারি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ নয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান হচ্ছে না এবং পার্বত্য শান্তি চুক্তিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমাদের এখনও লড়াইয়ের বহুদূর বাকী। এ লড়াই আমাদেরকেই একসাথে চালিয়ে নিতে হবে।
আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্য ‘মাদল’ বাজিয়ে উক্ত সম্মেলন উদ্ধোধন করা হয়। আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নারী বিষয়ক সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের জাতীয় কমিটির সদস্য কৃষ্ণপদ মুন্ডা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি ও মধুপুর অঞ্চলের আদিবাসী নেতা অজয় এ মৃ, আরেক সহ-সভাপতি ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমুখ। এছাড়া আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।