সুহৃদ চাকমা
১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। একদিকে গোটা ভারতবর্ষ ২০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের শৃঙ্খল হতে মুক্তি লাভের পর জনমনে একধরনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, আবেগ, অনুভূতি সঞ্চারিত হয়েছিলো, অপরদিকে দেশভাগের ক্ষত ও যন্ত্রণা পুরো মুক্তির উচ্ছ্বাস ও আনন্দকে ধূলোই মিশিয়ে দিয়েছিল। দেশভাগের সেই ক্ষত আজও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজন সহজে ভুলতে পারেনি এবং ভুলে থাকাও সম্ভব নয়! গোটা ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর যে দুই টুকরো হয়ে যাবে মুক্তিকামী ভারতবাসীর অনেকেই সেদিন কখনো কল্পনা করেনি। কিন্তু রেডক্লিফের বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন মনগড়া করে একটা দাগ টেনে দিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে দুই টুকরো করে দিয়ে যায়। তারপরেও কথা ছিলো-একটা ভাল কিছু হবে, কিন্তু হয়ে গেছে অন্য কিছু! একদিকে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন মিলে গঠিত হওয়ার কথা পাকিস্তান, আর অন্যদিকে বৃহত্তর হিন্দু জাতিগোষ্ঠীসহ অন্যান্য বহুজাতি, বহুসংস্কৃতি, বহু ভাষাভাষী জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে গঠিত হওয়ার কথা ভারত। বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান রেডক্লিফের এক কলমের খসাতেই এবং তার কথা আর কাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান হয়ে যাওয়ায় সেই দেশভাগের দুঃখ আর যন্ত্রণাকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইতিহাসের এই কলঙ্কের দায় জর্জ মাউন্ট ব্যাটেন ও রেডক্লিফ যেমনি এড়িয়ে যেতে পারে না, তেমনিভাবে মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাকামী ভারতবর্ষের জাতীয় নেতারাও দেশভাগের কলঙ্কের দাগ মুছে ফেলতে পারবে না। সেই কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণকে আজ নিজ দেশের মাটিতে পরবাসীর মতন যন্ত্রণাভরা জীবন নিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সেই সাথে একদিকে পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল আজকের বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আমাদের প্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর এই পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্দয় সেনাশাসন ও সেনা নির্যাতনকে শাসকগোষ্ঠী বৈধতা দিয়ে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটা সেনানিবাসে পরিণত করেছে এবং চরমভাবে শোচনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এই কলঙ্কের দায় জর্জ মাউন্ট ব্যাটেন ও রেডক্লিফ এবং সেই সময়কার অবিভক্ত গোটা ভারতবর্ষের কংগ্রেস ও মুসলিমের জাতীয় নেতারা কখনো এড়িয়ে যেতে পারবে না-এই কলঙ্কের দায় তাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে। তাদের ভুলের কারণে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণকে আজ চরমভাবে খেসারত গুণতে হচ্ছে।
১৯৪৭ সনে ১৫ আগস্ট দিনটি ছিল আপামর ভারতবাসীর পক্ষে বৃটিশ-পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে কাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগের পরম আনন্দময়, গৌরবোজ্জ্বল ও চিরস্মরণীয় একটি ঐতিহাসিক দিন। একদিকে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করার সময়, অপরদিকে দেশভাগের ফলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনের হাতছানি। এরই পাশাপাশি গোটা ভারতবর্ষের মানুষ দুই টুকরো হয়ে যাচ্ছে, এমনতরো পরিস্থিতিতে অবিভক্ত ভারতবাসীর মধ্যে একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় জীবনে হৃদয়ের গহীনে একটা বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যা আঘাতে আঘাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। একদিকে আনন্দ, অপরদিকে বেদনা ও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯৮.৫ পারসেন্ট জুম্ম জনগোষ্ঠীর মানুষজন। কিন্তু এ-কথাটি অনেকেই জানে না, এই ১৫ আগষ্ট দিনটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী জুম্ম জনগণের নিকট চরম উৎকন্ঠা ও উদ্বেগের দিন । যদিও সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী স্বাধীনতাকামী সমগ্র ভারতবাসীর সঙ্গে মুক্তির উল্লাসে অনুপ্রাণিত হয়ে রাঙ্গামাটিতে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন, তথাপি তাঁদের মনে উৎকন্ঠা ও উদ্বেগের অন্ত ছিল না। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ভারতভুক্ত হবে কিনা, নাকি তা পাকিস্তানের সঙ্গে ঠেলে দেওয়া হবে, পার্বত্যবাসীর মধ্যে এমনই একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছিল।
এমন অনিশ্চয়তাভরা আরও দুটি রাত কেটে যেতে না যেতেই সরকারিভাবে বেতারযোগে জানা গেল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি সত্যিই পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান রেডক্লিফ এবং জর্জ মাউন্ট ব্যাটেন ইতিহাসের একটা বিরাট কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে দিয়ে নিজ দেশে ব্রিটেনে ফিরে গেলেন। যার পরিণতি আজ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির নির্মম বাস্তবতার শিকার হতে হচ্ছে। বাস্তবিকই, ১৯৪৭ সনের ১৭ আগস্টের রাতটি ছিল সমগ্র পার্বত্যবাসীর জন-সমাজের পক্ষে চরম দুঃসহ একটি কালো রাত এবং আরো একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো বলা যায়। সেদিন থেকে আজো অবধি সেই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের অবসানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সমতলের আদিবাসীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রাম চলছে। অস্তিত্ব বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্ত থেকে নিজেদেরকে রক্ষার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হয়েছে। বিশেষ করে দেশভাগের কলঙ্ক ঘোচাতে এবং নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণ স্বাধীনতার পর প্রতিরোধ সংগ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিমনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হিন্দু মন্দিরে আগুন ও ভাঙচুর, রামু বৌদ্ধমন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটসহ দুর্গাপূজায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর অহরহ। তবে হিন্দুদের প্রতিমা বা মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীদের কর্তৃক এধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ও মন্দির ভাঙচুর নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘর-বাড়ি, ধানের গোলা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বহুবার। জানা গেছে, ঘটনার আগে গ্রামের মসজিদে কিছুক্ষণ পর পর মাইকিং করে সেখানে আক্রমণের জন্য লোকজন জড়ো করা হয়। এরপর হাজারো মানুষের আক্রমণের মুখে গ্রাম ছেড়ে পলায়ন করতে হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের। এই সুযোগে মৌলবাদী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতার অনুসারীরা গ্রামে প্রবেশ করে বাড়িঘর তছনছ করে ও লুটপাট চালায় এবং এধরনের ঘটনায় শত-শত বাড়ি এবং মন্দির ভাংচুর করা হয়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর দেশের শাসকগোষ্ঠী এবং ইসলামী ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী একযোগে অন্যায়ভাবে নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়েছে বহুবার। নিজ দেশের জন্মভূমিতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসীদের আজ ঠাঁই নেই। তাইতো আক্ষেপের সুরে রবি ঠাকুরের সোনার তরী কবিতার দুয়েকটা লাইন হৃদয়ের অন্তরালে শিহরণ জাগিয়ে তোলে, সর্বশেষ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজন সবকিছু সপে দিয়ে শূন্য হাতে রবি ঠাকুরের সোনার তরী কবিতার ভাষায় বলে ওঠেন, ‘এখন আমারে লহ করুণা করে’। কিন্তু নিষ্ঠুর বাংলাদেশের স্বৈরশাসক ও ইসলামি ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী রবি ঠাকুরের সোনার তরী কবিতার মর্মার্থকে নেতিবাচক অর্থে প্রয়োগ করে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই ছোট সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’। তার মানেই হলো এই, বাংলাদেশের মাটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজনদের বসবাসের ঠাঁই নেই। অনেক কাকুতিমিনতি করে নিজ দেশের জন্মভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচার, অবিচারে তাদের নিজ দেশের মাটিতে ঠাঁই হবে না-এমনই দুরভিসন্ধিমূলক আচরণ শাসকগোষ্ঠীর চলনে-বলনে। নিজ দেশে পরবাসীর মতন জীবন অথবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থীর মতোই অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজনদের। এসব নিষ্ঠুর, নির্মম পরিস্থিতি ও বাস্তবতার পেছনে দায়ী দেশভাগের সময় জর্জ মাউন্ট ব্যাটেন এবং বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার রেডক্লিফের মনগড়া সিদ্ধান্ত।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে দেশভাগের যে শর্ত তা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে বহুজাতি, বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত না করে বরঞ্চ মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৯৮.৫% জুম্ম জনগণ, যারা অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল, মুসলিম আর অমুসলিম জনসংখ্যা বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রাম আসলেই ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শতভাগই যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু দেখা গেল যে, রেডক্লিফ বাউন্ডারি কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের সকল প্রকার দাবি ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড উপেক্ষা করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করে। এই সুপারিশের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে যায় বলে অনেকেই মনে করেন। তাহলে এই দায় কার? এই দায় কেবল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান রেডক্লিফের নয়, এই দায় অবিভক্ত ভারতবর্ষের কংগ্রেস ও মুসলিম নেতাদেরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার সময়ের গুণেধরা ও পশ্চাৎপদ সামন্তীয় নেতাদেরও। তবে দেশভাগের শর্ত অনুযায়ী যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে এসবের বেশির ভাগ দায় পড়ে বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের উপর। কেননা, দেশভাগের পেছনে রেডক্লিফই সর্বেসর্বা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখনকার সময়ের ভারতের জাতীয় পর্যারের নেতারা একটা সাধারণ আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছিলেন, সেটা হলো এই- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্খা সমানভাবে মর্যাদা দেওয়া হবে এবং কাউকে বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। কিন্তু সেই ভারতীয় নেতাদের আশ্বাসের বুলি কেবল কাগজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। দেশভাগের ফলে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিপীড়নের হাজারো কষ্টের কাহিনীগুলো আজও নীরবে চাপা পড়ে আছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার ক্ষমতার মসনদে আসীন হলেই দেশের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়নের স্টিমরোলার জোরদার করেছে। দেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি বেদখল করে তাদেরকে উচ্ছেদ করেছে, তাদের ঘরবাড়ি ও এলাকা জুড়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করে সর্বস্বহারা করেছে এবং মৃত্যুর হুমকি, হত্যা, গুম ও ক্রসফায়ার-এগুলো তাদের নিত্য দিনের ঘটনা বলা যায়। এরই পশ্চাতে দেশভাগের জাতীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতারই বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়! বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদ জাতীয় চেতনা, অনৈক্য ও দোদুল্যমানতা এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষের জাতীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা প্রবলতর হওয়ার দরুনই দেশভাগের সময় বাস্তবমুখী বাস্তবতা অনুযায়ী যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এরই পরিণতিতে দেশের মধ্যে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক নিপীড়নের বাস্তব চালচিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
আজ বাংলাদেশের মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ নিরাপদ নয়! তাদের উপর চলছে প্রতিনিয়ত অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার স্টিমরোলার। এই নির্যাতন, নিপীড়নের ফলে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। কত দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে তার কোন হিসাব রাখে না দেশের জাতীয় নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় পলিসি মেকাররা। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে, দেশভাগের শর্তকে অমান্য করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাকিস্তানে যেমনি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আশা আকাঙ্খা ও জনমতকে উপেক্ষা করা হয়েছে সেদিন। দেশভাগের সময় বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের অন্যায়ের মাশুল আজ দেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে যদি বলি, পাকিস্তান জমানায় ৫০ দশকের শুরুতেই পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলমান পরিবার পুর্নবাসন শুরু করেছিল। তার মধ্যে সদর মহকুমার নানিয়ারচর থানা এলাকায়, লংগদু থানা এলাকায়, বান্দরবান মহকুমার নাইক্ষ্যংছড়ি থানা এলাকায় ও লামা থানা এলাকায় উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে ষাট দশকে এই মুসলমান পরিবারের পুর্নবাসন আরও জোরদার করেছিল বলে অতীতের ইতিহাস তারই সাক্ষী বহন করে।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ আমাদের অনেক জুম্ম জনগণকে চিরতরে জন্মভূমি হারা করে দিয়েছিল। এই দেশভাগের ফলে সৃষ্ট কষ্ট ও যন্ত্রণাগুলো আজও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। জুম্ম জাতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা এবং অবর্ণনীয় দুঃখ আর কষ্টের সহ্যের সীমা সেদিন অতিক্রম করেছিল। সেদিনগুলোর কথা মনে পড়লে শরীরের মধ্যে শিহরণ জাগে, লোম খাড়া হয়ে যায় এবং চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝড়ে। অথচ কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ না দিয়ে অন্যত্র বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করতে পারতো পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু তা করা হয়নি। কী দুঃখজনক বিষয়, কর্ণফুলী নদীতে তাদের বাঁধ নির্মাণ করতেই হবে। অন্যত্র যদি বাঁধ নির্মাণ করা হত হয়তোবা তেমন জুম্ম জনগণ ক্ষতিগ্রস্তও হত না। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর এটাই সত্যিকার অর্থে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় ধাপ। এরপরের আঘাত ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আর উপজাতি এলাকা নয় গৃহীত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চিরতরে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তখন বলা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আর পৃথক শাসিত এলাকা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন হতে পাকিস্তানের অন্যান্য দশটি এলাকার মতোই শাসিত হবে। এভাবেই পাকিস্তানের জমানায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলমান অনুপ্রবেশ, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ এবং পাকিস্তান আমলে সংবিধান সংশোধন, এসব ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র ছিল সবচেয়ে মারাত্মক যা তখনকার সময়ে বাধাহীনভাবে কার্যকরী হয়ে যায়। এরপর ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পায়। বাংলাদেশ নামক একটা নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। টার্গেট আবারও পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া জুম্ম জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়া, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার পর থেকে জুম্ম জনগণের সাথে দুরভিসন্ধিমূলক আচরণই তার স্পষ্ট প্রমাণ। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশের শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৩ সালে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন শুরু হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ১৯৭৩ সালে রুমা, আলিকদম ও দীঘিনালায় তিনটি সেনানিবাস তৈরি করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ১,১৫,০০০ সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি ৬ জন জুম্ম জনগণের পেছনে ১ জন সেনা সদস্য নিয়োজিত থাকতেন। এভাবে দিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারী হয়ে উঠল স্বল্প সময়ের মধ্যে সামরিকীকরণ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে স্থাপন করা হয় ৫০০ এর বেশি সেনাক্যাম্প। একই সাথে সমানতালে চলতে থাকে গণহত্যা, জুম্মদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ ইত্যাদি অমানবিক শোষণ ও নিপীড়ন। ২৫ মার্চ ১৯৮০ সেনাবাহিনী জুম্মদের উপর ভয়াবহ ও পাশবিক কলমপতি গণহত্যা সংঘটিত করে, এর পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রায় ১ ডজনের অধিক গণহত্যা সংগঠিত করেছিল শাসকগোষ্ঠী। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ বৌদ্ধ বিহার ও বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনেরও কোন অন্ত ছিল না। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৯ সাল হতে জেনারেল এরশাদের শাসনামলের ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সরকারি অর্থ সহায়তায় সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের জায়গা-জমির উপর চার লক্ষাধিক বহিরাগত মুসলমানদের বসতি প্রদান করা হয়। সেনাবাহিনী মুসলিম সেটেলারদের শুধুমাত্র মানব ঢাল হিসেবে নয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে, ভূমি দখলে রাখার উপায় হিসেবেও ব্যবহার করেছিল এযাবতকাল ধরে। সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। সিএইচটি কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে ২০০৪ হতে ২০১১ সালের মধ্যে সংগঠিত সামরিক বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ১,৪৮৭টি। তার মধ্যে ছিল বিনা অপরাধে মৃত্যু, আঘাত, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী খোঁজার নামে রাত-বিরেতে ঘরবাড়ি তল্লাশি, ঘরের জিনিসপত্র তছনছ, ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন, মন্দির ধ্বংস, গ্রেপ্তার, হয়রানি ও উচ্ছেদ ইত্যাদি।
এযাবতকালে দেশের ক্ষমতাসীন সরকার বহুবার অদলবদল হয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাশাসন হতে মুক্তি দেওয়া হয়নি। কোনো সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের উপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, অত্যাচার, অবিচার থামাতে পারেনি। প্রকৃত অর্থে দেশভাগের সময় ভারতবর্ষের জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতা, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জুম্ম নেতাদের পশ্চাৎপদ জাতীয় চেতনা ও রেডক্লিফের বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের মনগড়া সিদ্ধান্ত-এই ত্রি-মুখী ঘটনাগুলির অসংগতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে প্রতিনিয়ত নিষ্ঠুর, নির্মম ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আজও দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
সবশেষে, এযাবতকালীন সামগ্রিক তথ্য উপাত্ত, বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, দেশভাগের সময় ভারতীয় নেতৃবৃন্দ, বৃটিশের জর্জ মাউন্ট ব্যাটেন ও বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার রেডক্লিফ দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত নিয়ে আন্তরিকতার সহিত মোটেই চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। তাই ঘটে গিয়েছিল ইতিহাসের দেশভাগের ঐতিহাসিক ভুল। তা না হলে, কিভাবে ৯৮.৫ শতাংশ অমুসলিম অধ্যুষিত এই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা যায় বলুন? এই ঐতিহাসিক ভুল ভবিষ্যতে সংশোধিত হবে কিনা কেউ জানে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মধ্যে নিরন্তর বহমান দুঃসহ দূরবস্থা, অস্থিতিশীলতা, অসহায়তা, নিজভূমে পরবাসীর যাতনা, এথনিক ক্লীনজিং ইত্যাদি নিরীক্ষণের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট যাবতীয় ক্ষোভ, সমবেদনা ও বিবেকের তাড়নার প্রতীকীরূপই হলো আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। দেশভাগের এই অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে উঠে বাংলাদেশ একদিন হয়ে উঠবে সকল জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রাণের দেশ এবং দেশভাগের সময়ে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ভুলও একদিন সংশোধিত হবে, এমনই প্রত্যাশা সবার!