বাচ্চু চাকমা
শিরোনামটি দেখে অনেকের মনে হয়তো খটকা লাগতে পারে। এটা কেমন কথা! এ কি পুরুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নয়? না, এটা মোটেই পক্ষপাতিত্বমূলক নয়। কারণ, মূলত ব্যক্তি পুরুষ বা পুরুষ মাত্রেই যুগযুগান্তরের নারীর পশ্চাদপদতার জন্য দায়ী নয়। বিষয়টি সেভাবে ভাবলে সমাধানের বা প্রগতির সঠিক পথ কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে আমরা নারীকে শাসনক্ষমতায় দেখি, কিন্তু তাই বলে সে সমাজে নারীর মুক্তি বা সমানাধিকার নিশ্চিত হয়নি। মূলত যুগ যুগ ধরে যে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে সমাজে-রাষ্ট্রে নানা বৈষম্যসহ নারী-পুরুষের বৈষম্য বিদ্যমান, সেই ব্যবস্থায় পুরুষের প্রাধান্য আছে বলেই এমনটি মনে হয়। শাসকদের রাজনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী শিক্ষার অভাবের কারণে মানুষ যুগ যুগ ধরে ধরেই নিয়েছে যে, একদিকে, বৈষম্যমূলক হলেও এটাই জগতের নিয়ম, অপরদিকে, পুরুষ জাতিই দায়ী এবং পুরুষ ভালো হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অথচ, ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে যে- নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য ব্যক্তি পুরুষ নয়, বৈষম্যমূলক শ্রেণিবিভক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং তার উপর গড়ে ওঠা বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। তবে যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, তাই পুরুষের এতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিকতর দায় রয়েছে।
বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য, আমাদের ফিরে যেতে হবে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন স্তরে। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরগুলোকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং তার খুটিনাটি অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বগুলোর গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। আমরা জানি, এক সময় আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার উপরই গড়ে উঠেছিল আদিম অরণ্যবাসী যুথবদ্ধ মানুষের সমাজ জীবন। সেই সমাজের মধ্যে কোন শ্রেণিভেদ ছিলো না এবং শোষণও ছিলো না। থাকার কথাও না। আজকে যাকে রাষ্ট্র বলা হয়, তেমন ধরনের কিছুই সেদিন ছিল না। তবে সমাজবদ্ধ মানুষ শিকারের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, উৎপাদনের প্রয়োজনে কতগুলো সাধারণ নিয়ম মেনে চলেছিল। এই নিয়ম কোন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়, নিজের স্বার্থেই তারা এই নিয়মগুলো পালন করেছিল। তারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করেছে এবং গোষ্ঠীর মধ্যে একজনকে প্রধান বানানো হয়েছিল। গোষ্ঠী প্রধান ও মেয়েদের মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাদের কথা সবাই মেনে চলেছিল। সাধারণভাবে মেয়ে আর পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা ছিল সেই আদিম সাম্যবাদী যুগে। সেই সমাজে কে ছোট, কে বড়, কে কতখানি সম্মানিত ব্যক্তি এধরনের কোন প্রশ্নই উঠতে পারেনি। সমাজকে চালানোর জন্য পুলিশ, মিলিটারি, কোর্ট, জেল, হাজত ইত্যাদির কোনটাই প্রয়োজন হয়নি। গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি লোকই হিংস্র পশুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র অবস্থায় থেকেছিল। শিকারের সময় বা অন্য কোন বিপদের সময় তারা সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির নির্দেশ মেনে চলেছিল। এই সমাজের উৎপাদন শক্তি ছিল আদিম অনুন্নত, কিন্তু উৎপাদন সম্পর্ক ছিল সাম্যবাদী। মানবসমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে এই আদি যুগকে বলা হয় আদিম সাম্যবাদী সমাজ!
আদিম সাম্যবাদী সমাজ পেরোলেই দেখতে পাই দাস সমাজ ব্যবস্থার সুদীর্ঘ যুগ। দাস যুগেই প্রথম শ্রেণিভেদ ও শোষণের আবির্ভাব হয়েছে মানব সমাজে। এই যুগে মানব জাতি পরিষ্কার দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি শোষক শ্রেণি-অপরটি শোষিত শ্রেণি! শোষক শ্রেণি- যারা দাস মালিক, যারা সমাজের সম্পত্তির মালিক অথচ শ্রম করে না। অপরটি শোষিত শ্রেণি- যারা দাস, যারা কেবল শ্রম করে, নিজেরাই উৎপাদন করে অথচ কোন সম্পত্তির উপরই তাদের অধিকার নেই! আরও উল্লেখ্য যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র বলতে কোন কিছুই ছিল না। দাস সমাজেই প্রথম রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। তা কেন? দাস মালিকরা দাসদের দিয়ে জোর করে কাজ করাত, দাসদের উপর অমানুষিক শোষণ চালাত। বিপরীতে দাসমালিকের বিরুদ্ধে দাসদের মনে বাসা বেঁধেছিল তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ। আর দাসরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। এমনতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় দাস প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য শ্রেণিসংগ্রামকে দমন করার জন্য দাস মালিকদের বিশেষ একটা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। যার দ্বারা জোর করে দাসদের দমন করে রাখা যায়। এজন্যই দাস মালিকরা মিলিতভাবে একটা শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তৈরি করেছে দাস মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী একদল সেনাবাহিনী। দাস মালিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য আইন-কানুন রচনা করেছিল এবং বিচার ব্যবস্থাও ঠিক সেভাবেই গড়ে তুলেছিল। সব মিলিয়ে ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্র ব্যবস্থা-যার মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, বিচার, জেল, আইন ইত্যাদি। এই রাষ্ট্রের আইন এমনই ছিল যে দাসপ্রভু তার দাসকে হত্যা করলে, তাকে বিক্রি করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হতো না। এই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী শক্তি প্রয়োগ করেই দাসদের দমন করে রেখেছিল। মনে রাখবেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্বের ফলেই রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়েছিল এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বকে আয়ত্তের মধ্যে রেখে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখাই হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ। তাহলে এখানে স্পষ্ট যে, বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যতদিন থাকবে, ততদিন শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণি শোষণ থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এখন আসল কথায় চলে আসি, দাস যুগে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যেও বিরাট পরিবর্তন চলে এসেছিল। আদিম সাম্যবাদী যুগে নারী-পুরুষের সম-মর্যাদা ও সমঅধিকার ছিল। কিন্তু দাসযুগে এসে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণি-শোষণ দেখা দিল, তখনই পুরুষ নারীর উপর তার নিজস্ব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছিল। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আদিম সাম্যবাদী যুগে শিকারী পুরুষ দাস যুগের পুরুষদের চাইতে অনেক বেশি বলবান ছিল। তবুও তারা নারীর উপর জবরদস্তি অধিকার প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। কারণ সেদিনের সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনধারা এমনই ছিল যে এইরকম জবরদস্তি অধিকার প্রয়োগের কথা তাদের মাথায় আসতেই পারেনি। কিন্তু যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তি হয়েছে, সেদিন থেকে পুরুষ নারীকে তার সম্পদ, তার জন্য ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল। শোষণ যেদিন থেকে সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, সেদিন থেকে নারীও হয়েছিল পুরুষের অধীন। এভাবেই শুরু হয়েছিলো নারীর উপর পুরুষের শোষণ ও অত্যাচার। স্বাভাবিকভাবেই দাসযুগে এসেই শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিসংগ্রাম দেখা দিয়েছিল এবং রাষ্ট্রব্যবস্থারও সেই সময়ে জন্ম হয়েছিল। এভাবে ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণ, শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্র, পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধস্তন অবস্থা-এসব কয়টি হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সাধারণ চেহারা। এই চেহারাগুলোর হয়তো রূপ পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু সব সময় শ্রেণি বিভক্ত সমাজের চিহ্ন হিসেবে সমাজের মধ্যে থেকে গিয়েছিল।
সামন্ত যুগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে মানুষের ধারণা অনেক বেশি পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল। এই কারণে সামন্ত যুগেই উত্তরাধিকারের রীতি দৃঢ়ভাবে দেখা দিয়েছিল। উত্তরাধিকারের রীতি চালু হওয়ায় কে উত্তরাধিকারী হবে-এই প্রশ্নটি তীব্রভাবে সামনে চলে এসেছিল সেদিন। আমরা দাস যুগেও দেখেছিলাম ব্যক্তিগত মালিকানা ও শ্রেণিশোষণ চালু হওয়ার পর থেকেই নারীকে উপেক্ষা করে পুরুষ একাই গৃহ ও সমাজের কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে। তাই সামন্ত সমাজে নিশ্চিত উত্তরাধিকার নির্ণয় করার জন্য নারীর স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে খর্ব করা হয়েছিল। তারপর সামন্ত যুগে বহু বিবাহ ও বেশ্যাবৃত্তি চালু হয়েছিল। সামন্ত সমাজে নারীকে প্রায় মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না। নারী ছিল সম্পদশালী সামন্ত প্রভূর ভোগবিলাসের সামগ্রী অথবা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ। সামন্ত প্রভূরা প্রজাদের ঘরের মেয়েদের ইচ্ছামত ভোগ করেছিল তাও সত্য। ঠিক যেভাবেই দাসপ্রভুরা দাসীদের ভোগ করেছিল। সামন্ত যুগে এমনই নিয়ম ছিল, প্রজার ঘরে কোন মেয়ের বিয়ে হলে মেয়েকে বিয়ের প্রথম রাতে ভূস্বামীর ঘরেই থাকতে হবে! এমনই অমানবিক, কুৎসিত, নিষ্ঠুর ও বর্বর নিয়মের ভিত্তিতে এই সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সামন্ত সমাজ বিলোপ হওয়ার পর পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাব ঘটে। সমাজ বিকাশের নিয়ম মেনে একটা সমাজের গর্ভে আরেকটি সমাজের জন্ম হবে এবং একটা সমাজের পর আরেকটা সমাজ আসবেই। তারই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাদী সমাজের আগমন হয়েছিল। আমরা দেখি, বুর্জোয়া সমাজের আবির্ভাবের সাথে সাথে অন্যান্য সব জিনিসের ন্যায় নারীর মূল্য নির্ধারিত হতে থাকে টাকা দিয়ে। যে যাই বলুক, ক্ষমতা, সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, প্রেম-ভালবাসা সবকিছু টাকার মাপকাঠিতে নির্ধারিত হয়। তারই প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দীর্ঘ সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে এই পুঁজিবাদী সমাজে সাধারণতঃ আইন করে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, পরিবারের মধ্যেও সব সময় পুরুষের আধিপত্য থাকে, এই সমাজে যতই নারীর স্বাধীনতা দেওয়া হোক না কেন, মোদ্দা কথায় নারীর সম্মান, মর্যাদা, স্বাধীনতা কোনটিরই নিশ্চয়তা নেই। নারী সৌন্দর্য, মানবিক গুণাবলী, মা হবার অধিকার সবকিছু এখানে অর্থের মানদণ্ডে বিচার করা হয়। নারীর সৌন্দর্য, নারীর নারীত্ব, প্রতিভাবান নারীর প্রতিভা, মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা, তার শ্রমশক্তি-সব কিছুকেই তারা পণ্য হিসেবে মনে করে, যেন টাকা দিয়ে কেনা-বেচা হয়। নারী পুরুষের স্বাভাবিক প্রেমপ্রীতি এখানে অনুপস্থিত। ব্যাভিচার ও বেশ্যাবৃত্তি বুর্জোয়া সমাজের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, নারী নির্যাতনও চলে অত্যন্ত সুকৌশলে; যদিও ভেতরে ভেতরে তা প্রচন্ড এবং ভয়াবহ।
আদিম শ্রেণিহীন সাম্যবাদী যুগে নারী-পুরুষের মধ্যে কেনো বৈষম্য ছিল না। তখনকার সমাজ ব্যবস্থাও ছিল মাতৃতান্ত্রিক। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণিবিভেদ ও শ্রেণিশোষণ উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভব এবং নারী হয়েছিল পুরুষের অধীন। এটাকেই ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন- ‘নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়’। সবকটি শ্রেণিশোষণের যুগেই নারী পুরুষের অধীন থেকেছিল এবং নানাভাবে নিপীড়িত ও শোষিত হয়েছিল। সামন্তযুগে নারীকে ঘরের মধ্যেই আটকে রাখা হয়েছিল। সামাজিক উৎপাদনে নারীর কোনো ভূমিকা ছিল না। যদিও ঘরের সমস্ত কাজও করতে হয়েছিল নারীদের, তবুও এই দৈহিক শ্রমের মূল্য এই নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থা কখনো বিবেচনা করেনি এবং এই দৈহিক শ্রমের কোনো সামাজিক মূল্যও দেয়নি। পুঁজিবাদী যুগেই নারীরা প্রথম ঘরের বাইরে চলে এসেছিল এবং বাইরের উৎপাদনের কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিল। মনে রাখতে হবে যে, বুর্জোয়ারা নিজেদের প্রয়োজনেই নারীদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করেছিল। প্রথমত বস্ত্রশিল্পে নারীদের উপযোগিতা বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থার কারণে তাদেরকে তুলনামূলকভাবে কম মজুরি দিয়ে নারীদের শ্রমশক্তিকে অধিক মাত্রায় শোষণ করেছিল। ফলশ্রুতিতে মালিক তার মুনাফা লাভের রাস্তাটি আরও সহজতর করেছিল। পুঁজিবাদী সমাজে নারীর কার্যক্রম ঘরের বাইরে চলে আসলেও নারী পুরুষের সমতা কখনো অর্জিত হয়নি। এই কথা সত্য যে, নারী উপার্জন করার কারণে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে সক্ষম হয়েছে, তবুও পরিবার, স্বামী বা পুরুষের আধিপত্য রয়ে গেছে পুঁজিবাদী সমাজে। বুর্জোয়া যুগে নারীরা দ্বিবিধ শোষণের শিকার হয়। প্রথমত পুঁজিপতির শোষণ এবং দ্বিতীয়ত পরিবারের অভ্যন্তরে গৃহস্বামীর শোষণ; একদিকে শ্রেণিশোষণ এবং অপরদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পারিবারিক-সামাজিক শোষণ। এমনতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য ব্যক্তি পুরুষ এককভাবে দায়ী নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক রীতি-নীতিসমূহ এবং সেই সাথে ধর্মীয় বিষয়গুলি নারীকে পদানত রাখতে সাহায্য করেছিল।
বাইবেল বলছে নারী হচ্ছে ‘Root of all evil’ বা ‘নারী হচ্ছে নরকের দ্বার’। একদা হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। মধ্যযুগে ডাইনি বলে ইউরোপে বহু নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এখনো আমাদের দেশে গ্রাম-বাংলায় অনেক অসহায় নারীকে ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে চাবুক মারা হয়, অথবা পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। দেশের মধ্যে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী মানুষদের দায়িত্ব হচ্ছে যে, এই সকল ধর্মের নামে অনাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়ানো দরকার। শোষণের অবসান না হওয়া পর্যন্ত পরিপূর্ণ নারীমুক্তি সম্ভব নয়। তবুও নারীমুক্তির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমরা সংগ্রাম রচনা করতে পারি। ধর্মীয় আবরণে ও প্রথাগতভাবে যেসকল নারীবিরোধী ও নারী বিদ্বেষী মতবাদ, ভাবধারা ইত্যাদি চালু আছে তার বিরুদ্ধেও আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করা উচিত অবিচলভাবে। আমরা দেখেছি, হেফাজত ইসলাম যে ধরনের কথা বলে তা খুবই উলঙ্গ ও সভ্য সমাজে কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সভ্যতার আড়ালে এবং ধর্মীয় সংস্কারের আবরণে নারী বিদ্বেষী যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে আমাদের শিক্ষায় কিংবা রাষ্ট্রীয় আইনে ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে তার মুখোশ উন্মোচন করে সেই-সবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সাহসের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে। শুধুমাত্র মুখের বুলি কপচিয়ে কোন লাভ হবে না। যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, সেই বিষয়টি সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা থাকা দরকার। সেজন্যই বলছি, বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী, সেই সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা থাকা প্রয়োজন নয় কি? মানবসমাজ ক্রমবিকাশের ধারায় প্রতিটি যুগের প্রত্যেকটি সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞাত থাকা উচিত। তা নাহলে অন্ধের হস্তী দর্শনের মতোই বিচার-বিশ্লেষণ হয়ে যাবে এবং নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য তখন কেবল পুরুষকেই দায়ী করতে থাকব।
বস্তুত বাংলাদেশে একদিকে ধর্মের নামে সন্ত্রাস, পশ্চাৎপদতা ও নারী বিদ্বেষ যেমনি রয়েছে, তেমনিভাবে আমাদের সমাজে এবং পরিবারের মধ্যেও সুক্ষ্মভাবে পুরুষতান্ত্রিকতা ক্রিয়াশীল রয়েছে। অপরদিকে অর্থনৈতিক উৎপাদনে এবং শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ, চাকরিতে ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে নারীর অংশগ্রহণ, সমাজসেবামূলক কাজে নারী সমাজের অংশগ্রহণ নারীমুক্তির পথকে প্রশস্ত করলেও তা যথেষ্ট নয়। প্রায় ৪০/৫০ লক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে আশি শতাংশের বেশি কম বয়সী নারী। এই নারীরা কারখানা মালিকদের দ্বারা নির্মমভাবে শোষিত ও বঞ্চিত। বাংলাদেশে নারী মুক্তির আন্দোলন তথা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলনে এই গার্মেন্টস নারীদের অংশগ্রহণ বা অন্তর্ভুক্তকরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বেগম রোকেয়া তার লেখনীর মধ্য দিয়ে সমাজের কুসংস্কার, অবরোধ প্রথার অতিরিক্ত প্রভাব, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, নারী শিক্ষা, নারীর প্রতি সামাজিক অবমাননা, নারীর অধিকার এবং নারী জাগরণের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছিলেন এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার বিরোধিতাও করেছিলেন। বেগম রোকেয়ার নারী আন্দোলনের মৌলিকত্ব এখানেই, মূল সুর এটাই। নারী স্বাধীনতা চেয়েছিলেন একটি অন্ধ অনুশাসন ভাঙতে, যা নারীকে করেছিল অধিকারহারা। কিন্তু তিনি এমন ভাঙনে বিশ্বাস করেনি যা ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যাবে। এইখানে মনে রাখতে হবে যে, তিনি নারীকে ঘর থেকে বের করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ঘর ভাঙতে বলেননি। বেগম রোকেয়া অনেক আগেই বুঝে নিয়েছিলেন যে, নারীর সম-অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন গোটা সমাজে একটা আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। সে কারণেই স্ত্রী শিক্ষার বিরোধিতাকে তিনি নারী নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, সামাজিক শোষণ বলে বিবেচনা করেছিলেন। এইখানে আমাদের গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে হবে, ‘নারী আন্দোলন’ কোনো নির্দিষ্টি গোষ্ঠী বা শ্রেণির আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক আন্দোলন; যার মধ্য দিয়ে একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করা যাবে।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সংবিধানে ১০ ও ২৮ নং অনুচ্ছেদ-এর ১, ২, ৩ ও ৪ ধারায় নারীর মৌলিক অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সকল পর্যায়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান মর্যাদা সংরক্ষণের কথা সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের বৈষম্য দেখা যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মম, নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও কুসংস্কারে জর্জরিত এবং অশিক্ষা ও পর্দার নামে অবরুদ্ধ জীবন যাপনে বাধ্য নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন অনেক প্রগতিশীল চেতনাসম্পন্ন মানুষ। বেগম রোকেয়া আরও বলেছিলেন, ‘আমরা অর্ধাঙ্গ, আমরা পিছিয়ে থাকিলে সমাজ উঠিবে কিভাবে? আমরা অলংকাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নয়, সকলেই সমস্বরে বলে উঠতে হবে আমরা মানুষ’। তার এই কথাগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণ করতে হলে নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও সমমর্যাদা অনস্বীকার্য। এই বিষয়ে আরও গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে হবে, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের দ্বারা শৃঙ্খলিত নারীদের মুক্তির আন্দোলন কিন্তু সর্বপ্রথম পুরুষরাই শুরু করেছিলেন। উনিশ শতকের নারী মুক্তির পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তার মৃত্যুর পর নারী মুক্তির আন্দোলনে যাদের অবদান আরও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে স্মরণ করতে হয়, তাঁরা হলেন বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়। শত-শত হাজারো অন্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজ ধর্মের নামে ভন্ডামী-এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্র। পুরুষের একাধিক বিয়েতে কোন বাধা ছিল না, বিবাহ করার পর নারীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়নি, বন্দী দাসীর মতোই আচরণ করা হয়েছিল এবং মানুষ হিসেবে নারীকে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এমনতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সামন্তীয় সমাজ যা যুগ যুগ ধরে এই নির্মম ব্যবস্থা চলেছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত ও শোষিত জুম্ম জনগণের মুক্তির দিশারী, সারা বাংলাদেশের খেটে-খাওয়া নিরন্ন মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মনের কথা, অন্তর থেকে উচ্চারিত কথাগুলো না বললে আমার এই লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যাবে বলে মনে হচ্ছে। নারীর অধিকার বিষয়ে মহান জাতীয় সংসদে দৃঢ়-কন্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হচ্ছে এই যে, আমাদের মা, বোনদের কথা এখানে নেই। নারীর যে অধিকার সেটা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। নারীকে যদি অধিকার দিতে হয়, তাহলে পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে সে অধিকার নারীকেও দিতে হবে। কারণ, তারাও সমাজে অর্ধেক অংশ’।
সবশেষে বলবো, দাস যুগে নারীর অবস্থানের বাস্তবতাগুলো উল্লেখ করেছিলাম, সামন্ত যুগের শ্রেণিগত চিন্তা-চেতনা নারীদের অধিকার দেয়নি তাও পরিষ্কার, নারীমুক্তি তো আরও সুদূর পরাহত। ইতিহাসের বাঁকে প্রসিদ্ধ হয়েছে, সামন্ত শ্রেণির চিন্তা-চেতনা গণতন্ত্র বিরোধী ও চরম প্রগতিবিরোধী। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অনেক সামন্তীয় ঘুণেধরা পশ্চাৎপদতার বেড়াজালে বন্দী থাকা রাজা-বাদশা ও সম্রাটরা সব সময় মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় প্রগতিবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল। এই চিন্তাধারার মধ্যে চরমভাবে রক্ষণশীলতার আভাস পাওয়া যায়, যা পুরানো ধ্যাণ-ধারণা ও পুরাতন ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এমনিতর ব্যবস্থার মধ্যে নারী সমাজের ন্যায্য অধিকার অর্জন করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী সমাজের সাধারণ চেহারা ও বৈশিষ্ট্যগুলো আশা করি উপরোক্ত আলোচনায় উঠে এসেছে। এই সমাজে নারীদের কিছু কিছু অধিকার দেওয়া হয়েছে ঠিক, কিন্তু সেটা কেবলমাত্র পুঁজিপতিদের স্বার্থে বা পুঁজিপতির মুনাফা লাভের স্বার্থে করা হয়েছে। গার্মেন্টস নারী কর্মীদের চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এইখানে নারীর শ্রমশক্তিকে শোষণ করা হচ্ছে দ্বিগুণে। গার্মেন্টস কারখানায় চাকরিরত নারীদের পুত্র-সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়া হয় না, গর্ভবতী নারীদের ছুটি মিললেও অতিরিক্ত সম্মানি ভাতা মিলে না। এধরনের বহু অভাব, অভিযোগ ও অসংগতি বুর্জোয়া সমাজে ঘটে চলেছে এবং এগুলো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতি ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজন সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যেকার চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন। চিন্তাধারা ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গনতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন একদল সংঘবদ্ধ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজে বিপ্লব সাধন করতে হবে। সমাজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নারীর পশ্চাৎপদতা থেকে ওঠে এসে সামনে দিকে অগ্রসর হবে, তখনই নারীর সমমর্যাদা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনার নিষ্ঠুর বাস্তবতা থেকে নারীরা মুক্তি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। চুড়ান্ত বিশ্লেষণে, নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য পুরুষ দায়ী নয়-কেবলমাত্র যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই নারীর এই পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী। আর পুরুষ নিজেও এই বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্রমাগত শাসিত এবং শোষিত। তাই নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত সংগ্রামেই বিদ্যমান বিভেদ ও বৈষমমূলক এই সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত প্রগতিশীল এক সমাজব্যবস্থা কায়েমের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।