বাচ্চু চাকমা
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি, জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হুংকার, জলপায়ীদের রাঙা বেয়নেট ও বন্দুকের নলের সামনে দমে না যাওয়ার সেই জুম্ম ছাত্র সমাজের নবজাগরণের ইতিহাস আমিও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। পাহাড়ের শাসকগোষ্ঠীর উদ্যত চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে অকুতোভয় প্রতিবাদী জুম্ম ছাত্র যৌবনরা আবারও নতুন করে সমবেত হয়েছিলো সেদিন। জেল-জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন কিংবা মৃত্যুর হুমকি-ধামকি কোন কিছুই সে সময় মুক্তিকামী ছাত্র জনতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর সকল বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে শত-শত জুম্ম ছাত্র যৌবন সেদিন সমবেত হয়েছিলো পিসিপির মুক্তির মিছিলে। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্রিটিশ আমল কিংবা পাকিস্তান আমলের জুম্ম ছাত্র আন্দোলনের কথায় বলছি না, বলছি না ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথাও। ১৯৮৯ সালে ৪ঠা মে লংগদুর গণহত্যার প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র যৌবনদের অপ্রতিরোধ্য ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়েও আজ আমি কথা বলছি না। আমি কেবলমাত্র কথা বলছি আমার স্বচক্ষে দেখা ২০০৭-৮-৯ জরুরি অবস্থার মতন কঠিন সময়ে জুম্ম ছাত্র সমাজের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বের সংকটকালীন সময় যেমনি ছিলো তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র কান্ডারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরও সেদিন দুঃসময় চলছিলো। এমনিতর কঠিন পরিস্থিতি এবং জুম্ম জাতির দূর্যোগের মুর্হুতে জুম্ম ছাত্র সমাজ ২০০৭-০৮-০৯ সালের জরুরি অবস্থাকে উপেক্ষা করে পাহাড়ের বুকে নবজাগরণের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো। সেই দিনগুলোতে পিসিপি’র উত্তাল প্রতিবাদী মিছিল আর জুম্ম ছাত্র সমাজের অপ্রতিরোধ্য শক্তি জুম্ম জাতিকে ক্রান্তিকালের যাত্রা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো।
জরুরি অবস্থার কঠিন সময়ে বাংলাদেশসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো ছিলো একেবারেই নিষিদ্ধ। সেনা, ডিজিএফআই ও অন্যান্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভীষণভাবে তৎপর ছিলো। জনসংহতি সমিতি ও পিসিপির নেতৃবৃন্দ ছিলো সবচেয়ে বেশি টার্গেট। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির দিন দিন নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা অন্যান্য সময়ের তুলনায় সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। একের পর এক মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল এবং নির্বিচারে চাঁদাবাজি, খুন-গুম হয়ে উঠে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কারপন্থীদের উৎপীড়নে ঘরে বাইরে কোথাও ছিলো না মানুষের নিরাপত্তা। প্রতিটি রাত এবং প্রতিটিক্ষণ ছিলো আতঙ্ক আর অনিশ্চিতে ভরা। পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিলো দিন দিন অসহনীয় শ্বাসরুদ্ধকর। জুম্ম জাতীয় জীবনে বিরাজ করছিলো এক বিশাল শূণ্যতা। তাই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দুঃশাসন ভাঙতে প্রয়োজন ছিলো নতুন করে ছাত্র সমাজকে জাগরণের। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো না গেলেও অন্যান্য নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারিত করে ছাত্র সমাজকে জাগানিয়ার গান শুনানো হয়েছিলো সেদিন। আসতে আসতে শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কারপন্থীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ-বিক্ষোভ বারুদের মতোই জমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ছাত্র সমাজের এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-ঘৃণা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটির শহরেই বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। বাকরুদ্ধ জুম্ম জনতার কন্ঠে পিসিপির নেতৃবৃন্দ সেদিন ফিরিয়ে এনেছিলো প্রতিবাদের আওয়াজ। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জুম্ম ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। ছাত্র সমাজের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছিলো অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাস, সাহস আর মনোবল। সংগ্রামী চেতনাকে করেছিলো আরও অধিকতর শাণিত মনে হয় যেন জুম্ম ছাত্র সমাজের নবজাগরণের ইতিহাস।
জরুরি অবস্থার মতন কঠিন সময়ে সারা বাংলাদেশের মানবতা যখন ভূলুণ্ঠিত এবং গণতন্ত্র নামক পাখিটি যখন কাঁচায় বন্দী ছিলো তৎকালীন সময়ের জুম্ম ছাত্র সমাজের অগ্রগামী অংশ হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করে সংগ্রামের নবজাগরণের ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে ২০০৮ সালে ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কাটা পাহাড়ে বসে তৎকালীন পিসিপির সভাপতি মংসিঞো মারমা, সাংগঠনিক সম্পাদক উদয়ন ত্রিপুরা, তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক শরৎ জ্যোতি চাকমাসহ কয়েকজন সক্রিয় কর্মী একত্রিত হয়ে নীতিচ্যুত সংস্কারপন্থী উপদলীয় চক্রান্তকারীদের সাথে যোগসূত্র থাকায় তৎকালীন পিসিপির সাধারণ সম্পাদক প্রিয়দর্শী চাকমাসহ তার সাথে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের সকলকে বহিষ্কার করা করেছিলো। ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে পিসিপির ২০ মে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এবং বিকেলে আসাদ গেইট এর সামনে সিবিসিবি সেন্টার হলে প্রতিনিধি সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো। উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা এবং প্রধান বক্তা ছিলেন সঞ্জীব দ্রং। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এক সময়ের হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অন্যতম নারী নেত্রী ওয়াইসিং প্রুসহ অসংখ্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ। উক্ত সম্মেলনে বিভেদপন্থী সংস্কারপন্থীদের সাথে যোগসূত্র থাকায় পিসিপির নীতিচ্যুত বহিষ্কৃত কর্মী প্রিয়দর্শী চাকমা ও অন্যান্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সর্বসম্মতিক্রমে বহিষ্কারাদেশ পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিলো।
জরুরি অবস্থার সময়ে ২৫ নভেম্বর ২০০৮ সালে রাঙ্গামাটি পৌরসভা হল রুমে বিশেষ পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় পিসিপির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করতে হয়েছিলো। জরুরি অবস্থার কঠিন সময়ে পিসিপির আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বীতিক্রমধর্মী একটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। উক্ত কাউন্সিলের মাধ্যমে উদয়ন ত্রিপুরাকে সভাপতি ও শরৎ জ্যোতি চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিলো।
স্মরণে আসছে সেই সময় যে সময়ে সারা বাংলাদেশের জরুরি অবস্থার মতন একটা শ্বাসরুদ্ধকর সামরিক শাসন চলছিল। সেই কঠিন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক আবহাওয়া আরও অধিকতর ভয়ংকরভাবে প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করেছিলো। সেই দূর্যোগের মুর্হুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতালোভী, প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী সংস্কারপন্থীরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে আতার্ত করে সংস্কারের ধোঁয়া তুলে জনসংহতি সমিতির ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেঠে উঠেছিলো। তারই অংশ হিসেবে তৎকালীন সেনা-সমর্থিত জুম্ম জাতিবিরোধী সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটি শহরে বিভিন্ন পেশাজীবি ও জনসাধারণের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের উপরে হত্যা ও হামলা করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র এঁটেছিলো। তৎকালীন পিসিপির নেতৃত্বে রাঙ্গামাটির সচেতন ছাত্র সমাজ ও আপামর জনতাকে সাথে নিয়ে সংস্কারপন্থীদের জুম্ম জাতিবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছিলো। এক পর্যায়ে দেবাশীষ নগর এলাকার দোকানদারদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়কালে এলাকাবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে তাদেরকে প্রতিহত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোর্পদ করা হয়েছিলো। এতে করে প্রমাণিত হয় যে, কঠিন পরিস্থিতি ও বাস্তবতা মোকাবিলা করেও পিসিপির তৎকালীন কর্মী বন্ধুরা আপামর জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিলো।
জরুরি অবস্থার মতো কঠিন সময়ে জনসংহতি সমিতির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ যখন আত্মগোপনে তখন সেনাবাহিনীর ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনী সংস্কারপন্থীরা রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন জায়গায় কিংবা দোকান-পাটে দিব্যি আরামে ঘুরাফেরা করে জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা সন্তু লারমার বিরুদ্ধে নানাভাবে কুৎসা রটাচ্ছিলো এবং জুম্ম জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের জাল বুনছিলো। এমনিতর কঠিন পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে জুম্ম ছাত্র যৌবনরা গর্জে উঠেছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির রাজপথের প্রান্তরে। আমিও সেই ঐতিহাসিক মুর্হুতের বাস্তব সাক্ষী একজন। দেবাশীষনগর এলাকার ঘটনার একদিন পর রাঙ্গামাটি শহরের সচেতন ছাত্র সমাজ এবং আপামর জনগণকে সাথে নিয়ে পিসিপির নেতৃত্বে জুম্ম স্বার্থবিরোধী সংস্কারপন্থী গংরা রাঙ্গামাটি থেকে দিনে-দুপুরে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। জরুরি অবস্থার মতন কঠিন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় রাঙ্গামাটি শহরের সব জায়গায় সংস্কারপন্থীদের উৎপীড়ন, চাঁদাবাজি, হুমকি, ভয় আর আতঙ্কে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত পিসিপির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামে ছাত্র যৌবন ও আপামর জনতা নিজেরাই সামিল হয়েছিলো। নেতৃত্বের সারিতে ছিলেন পিসিপির আপোষহীন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিলো যখন পৌরসভার হল রুমে তারা সমাবেশ করবে বলে ঠিক করলো এবং জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছিলো। সেদিন জুম্ম ছাত্র সমাজ ভয় আর মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে বরং রাজপথে সামিল হয়ে ভয়কে জয় করে নিয়েছিলো। শাসকগোষ্ঠীর হামলা, মামলা, জেল-জুলুম ও চোখ রাঙানিকে ভয় না করে বীরত্বের সহিত রাজপথে নেমে এসেছিলো।
প্রথমে ভেদভেদী বাজারে রাঙ্গামাটি টু খাগড়াছড়ি কিংবা চট্টগ্রাম শহরের প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধে সামিল হয়েছিলো ঝাঁকে-ঝাঁকে স্কুল-কলেজের ছাত্র যৌবন ও রাঙ্গামাটি শহরের আপামর জনতা। আমরা সেদিন কেন সেখানে অবস্থান নিয়েছিলাম? উত্তর হবে একটাই, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার জন্য অবস্থান নিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে ভেদাভেদী বাজার থেকে প্রতিবাদী উত্তাল লাঠির মিছিল রাঙ্গামাটির সেনানিবাস মাঝখান দিয়ে কলেজ গেইট, কল্যাণপুর, জিমনেসিয়াম, শিল্পকলা, আঞ্চলিক পরিষদের বিশ্রামাগার, জেলা পরিষদ অফিস ও আঞ্চলিক পরিষদ অফিস, নিউ মার্কেট, জেলা প্রশাসকের অফিস পার হয়ে হ্যাপি মোড়ের দিকে ঢুকে ট্রাইব্যাল আদাম পেরিয়ে পৌরসভার দিকে বের হয়ে রাঙ্গামাটি রাস্তার প্রধান সড়ক হয়ে আবারও বনরূপা বাজারের অলিগলিতে ঢুকে প্রতিক্রিয়াশীলদের তাড়িয়ে দেওয়ার মারমুখো প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা এবং বনরূপা প্রধান সড়ক অবরোধ করে স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে ছাত্র যৌবনদের অপ্রতিরোধ্য মিছিল এবং সেদিন সারাদিন সবাই অনশন করেছিলো বা কারোর পেটে ভাত জুটেনি, বিকেল আনুমানিক ৫.০০ ঘটিকার সময় নিউ মার্কেট এর পাশে ডিসি অফিসের সামনে ড্রিমল্যান্ড হোটেলে সবজি দিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করার পর যার যার অবস্থানে চলে গেলাম। সেই সময় পিসিপির নেতৃত্বে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের জুম্ম ছাত্র সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নবজাগরণের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো সেই সময়ে রাঙ্গামাটি কলেজের জুম্ম ছাত্র-জনতা, টিটিসির ছাত্র যৌবনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো ও রাঙ্গাপানি-ভেদভেদী, কল্যাণপুর, ট্রাইব্যাল আদামসহ রাঙ্গামাটি শহরের প্রায় অধিকাংশ এলাকার ছাত্র যৌবনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো এবং অন্যান্য সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী মিটিং, মিছিল, সমাবেশে উদ্যত শাসকগোষ্ঠীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে সমবেত হয়েছিলো হাজারো অকুতোভয় নির্ভীক প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা। ষড়যন্ত্রমূলক মামলা, হুলিয়া-জেল-জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন কিংবা মৃত্যুর হুমকি কোন কিছুই সে সময় মুক্তিকামী প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে শত-শত জুম্ম ছাত্র যৌবন সমবেত হয়েছিলো সেদিনের পিসিপির পতাকাতলে। সকল প্রকার চক্রান্ত নস্যাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আন্দোলন সংগ্রামে।
আমি মনে করি সেদিন কেবল পিসিপির নেতৃবৃন্দরা হাততালির লোভে নিছক আবেগ কিংবা উত্তেজনায় লোক দেখানো কথা বলেনি, সত্যিকারভাবে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা কথা বলেছিলো। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেই সময়ের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা উদয়ন ত্রিপুরা, শরৎ জ্যোতি চাকমা, পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা, পদ্মলোচন, যৌবন বিকাশ চাকমাসহ অসংখ্য নাম না জানা ছাত্র নেতৃবৃন্দ। সেই অসংখ্য ছাত্রনেতা থেকে আজ হয়তোবা কেউ সক্রিয় আছে আবার কেউ নেই এবং অনেকেই হয়তো সক্রিয় এবং মৌন দুভাবে জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, এটাই আন্দোলন সংগ্রামের বাস্তবতা। রাজপথের মিছিল-মিটিং কিংবা সমাবেশের সামনে সারিতে প্রতিনিয়ত প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেই সময়ের একজন ছাত্র সমাজের কান্ডারী সাবেক পিসিপির সভাপতি উদয়ন ত্রিপুরার কথা না বললে নয়। সেই জরুরি অবস্থার সময়ে জুম্ম ছাত্র সমাজকে উজ্জীবিত করে রাখার সাংগঠনিক প্রতিভা ও তার আগুন ঝরানো জ্বালাময়ী ভাষণ ছাত্র সমাজকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই, সেই সময়ে রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন পাড়ায়-পাড়ায় কিংবা স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যৌবন তথা আপামর জনসাধারণ পিসিপির ডাকে সাড়া দিয়েছিলো। দীর্ঘ ১২ বছর পর আজ হিসেব মিলাতে গিয়ে আমি হিসেব মিলাতে পারছি না, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলাতে পারে ঠিক কিন্তু ছাত্র যৌবনদের মিটিং-মিছিলের প্রাণচাঞ্চল্য, রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাপ, তারুণ্যের উত্তেজনা তো একই থাকবে। সেই ২০০৭-০৮ জরুরি অবস্থার সময়ের প্রেক্ষাপট এবং আজকের প্রেক্ষাপট কোন অংশেই কম নয়। সেই সময়ে সারা বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি ছিলো, মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিলো। তারপরও জেল-জুলুম, হামলা, মামলা, ভয় ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে পিসিপির নেতৃত্বে জুম্ম ছাত্র যৌবনরা সেদিন রাজপথে সামিল হয়েছিলো। সেই সময়ের ছাত্র যৌবন দেখিয়ে দিয়েছিলো তারা পারে না পৃথিবীতে এমন কোন কাজ নেই। তারা দেশ ও জাতির জন্য মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করে না। আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামের কঠিন পরিস্থিতির বাঁকগুলো পার হতে দৃঢ়তা ও সাহসিকতা সম্পন্ন তেজোদীপ্ত জুম্ম ছাত্র যৌবনের অস্তিত্ব এখনও আছে এবং আগামীতেও থাকবে। যুগে-যুগে আদর্শিক ছাত্র যৌবনরাই জাতির সংকটকালীন সময়ে এগিয়ে এসেছে। ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকবে অবিচল, অটল ও আপোষহীন। শত প্রলোভনের কাছে হবে না পরাজিত। নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত জুম্ম জনতার সপক্ষে কাজ করার যে শপথ নিয়েছিলো পিসিপির ছাত্র যৌবনরা, সেই জনতার সাথে পিসিপির নেতৃবৃন্দ কখনোই বেঈমানী করতে পারে না। বিকিয়ে দিতে পারে না নীতি-আদর্শ, এমনই ছাত্র-জনতার অস্তিত্ব এখনও পিসিপির মধ্যে রয়েছে আমি শতভাগই আশাবাদী।
জরুরি অবস্থার সময়ে জুম্ম ছাত্র সমাজ নতুন করে জাগরণের পেছনের প্রেক্ষাপট ছিলো শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার মতো অন্তরালে সংগঠিত হওয়ার বহু ঘটনা। এই প্রতিবাদী জুম্ম ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বাধা কেবল শাসকগোষ্ঠী তাবেদার বাহিনীর ছিলো না, ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও বিভেদপন্থী উপদলীয় চক্রান্তকারী সংস্কারপন্থীদের গভীর ষড়যন্ত্র। একদিকে শাসকগোষ্ঠীর কড়া বিধি-নিষেধ, অপরদিকে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রবল তৎপরতা চলমান ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনা গোয়েন্দাচক্রের শত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে জুম্ম ছাত্র-জনতার সংগ্রামের প্রতিবাদী ধারাটি অক্ষুন্ন রাখতে পিসিপি সব সময় তৎপর ছিলো। ব্যাপক ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া যেমনি থেমে থাকেনি ঠিক তেমনিভাবে সকল বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে ছাত্র সমাজকে নবজাগরণের ডাক শুনিয়ে রাজপথের সংগ্রাম সংগঠিতকরণের কার্যক্রম সমানতালে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলো। গনতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে জুম্ম ছাত্র সমাজের খন্ড-খন্ড প্রচেষ্টা এবং ঘটনার পর ঘটনা মিলেই এক পর্যায়ে অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো। যার কারণে প্রতিক্রিয়াশীল উপদলীয় চক্রান্তকারী সেনা-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নামধারী সংস্কারপন্থী গংরা সেদিন পালানোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলো না।
আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি জরুরি অবস্থার মতো কঠিন সময়ে পিসিপির ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী ছিলো। তারা রাঙ্গামাটি শহরের প্রতি পাড়ায়-পাড়ায়, টিটিসি ও রাঙ্গামাটি কলেজে শাখা কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে পিসিপির সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও অধিকতর জোরদার ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো। জুম্ম ছাত্র সমাজের সকল মিলিত শক্তির আন্দোলনের কাছে রাঙ্গামাটি শহরে শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয় প্রশ্রয়ে লালিত সংস্কারপন্থীরা টিকতে পারে নাই। সেই সময়ের পিসিপির আন্দোলনের সাথে সচেতন ছাত্র যৌবন ও রাঙ্গামাটি শহরের আপামর জুম্ম জনতা সম্পৃক্ত হলে তা গণ আন্দোলনে রূপ নেয় এবং এক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কারপন্থী গংরা রাঙ্গামাটি শহর থেকে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে জরুরি অবস্থার সময়ে ২০০৭-০৮-০৯’র ছাত্র সমাজের সেদিনের আন্দোলনকে “জুম্ম ছাত্র সমাজের নবজাগরণের আন্দোলন” হিসেবে আখ্যায়িত করলেও কোন অযুক্তিক হবে না মনে করি। সেই সময়ের ছাত্র সমাজের আন্দোলন সফল সমাপ্তি ঘটেছিলও মূলত ছাত্রনেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দৃঢ়তায়। তৎকালীন সময়ে সেনাশাসনের জেল-জুলুম, হামলা ও মামলার ভয়ে যেখানে মানুষ সবাই আতঙ্কিত ছিলো, ঘর থেকে মানুষ বের হতে পারতো না, পাহাড়ের কিংবা সমতলে সকল সুবিধাবাদী গোষ্ঠীরা ছিলো আপোষকামী ঠিক সেই সময়ে জুম্ম ছাত্র-জনতা পার্বত্য চট্টগ্রামের গনতান্ত্রিক আন্দোলনকে বন্দী খাঁচা থেকে বের করে রাজপথের অপ্রতিরোধ্য, গগনবিদারী প্রতিবাদের উত্তাল মিছিল ও ছাত্রসমাবেশকে জনস্রোতে রুপান্তরিত করেছিলো।
অন্ধকারাচ্ছন্ন ও দোদুল্যমান ছাত্র-জনতাকে নতুন করে ঘুম জাগানিয়ার গান শুনিয়েছিলো। যার ফলে বিভেদপন্থী, সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও উপদলীয় চক্রান্তকারী সংস্কারপন্থী গংরা সেদিন রাঙ্গামাটি শহর থেকে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কালো মেঘের মতো ছায়া ফেলে যতই বাধা সৃষ্টি করুক পৃথিবীর বুকে সেই প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কোনদিনই চিরস্থায়ী হতে পারেনি। সূর্যকে মেঘ কখনই চিরদিনের জন্য ঢেকে রাখতে পারে না। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদই হল পাহাড়ের বুকে উদীয়মান সূর্যের মতো। প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির কালো মেঘের ছায়াকে দূর করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুক ছিঁড়ে সেদিন বেড়িয়ে এসেছিলো ঘুম জাগানিয়ার গান শুনিয়ে পাহাড়ের দিগন্ত জুড়ে আলো ছড়িয়েছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র সমাজ সেদিন মৃত্যুকে কখনো পরোয়া করেনি, শত-শত বীরযোদ্ধাদের মৃত্যুর যন্ত্রণাকে নিজেদের মধ্যে আপন করে নিয়েছিলো, এম এন লারমার রক্ত জুম্ম ছাত্র সমাজকে সেদিন আপোষহীন ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিলো এবং ৭০ বছর বয়সী তারুণ্যের যৌবনেভরা ভরদ্বাজমনির রক্তসহ পিসিপির গনতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল শহীদদের রক্ত একাকার হয়ে জুম্ম ছাত্র সমাজ সেদিন মনে হয় যেন বোমা বিস্ফোরণের মতোই বিকট শব্দে ফেটে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল সকল অপশক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো। আমি আজ সেদিনের মতোই জুম্ম ছাত্র সমাজকে অপ্রতিরোধ্য ভূমিকায় জাগ্রত হওয়ার আহ্বান করছি। পাহাড়ের জুম্ম ছাত্র যৌবন ও আপামর জনতা প্রতিক্রিয়াশীল সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে জাগো, জাগ্রত হও।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চারিদিকে আজ রুদ্ধশ্বাস এক পরিস্থিতি আমাদের জুম্ম জনগণের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। সেনাশাসন ও নির্যাতন চলছে নির্বিচারে। অত্যাচার ও শোষণের মাত্রা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে চলেছে। শোষণের কালো থাবায় জর্জরিত পাহাড়ের জুম্ম জনগণ। আমাদের চোখের সামনে বোনকে গণধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে, ভাইকে নৃশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের আবাদ করা সমস্ত জায়গা-জমি ও বসতভিটা। বিজাতীয়রা ব্যবসা বাণিজ্যে একচ্ছত্র আদিপত্য বিস্তার করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অফিস-আদালত সমস্ত কিছু বিজাতীয়দের দখলে। নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজ। অন্যায়ভাবে আমাদের পাহাড়ের সাধারণ মানুষ ও সংগঠনের কর্মীদের জেলে আটকানো হচ্ছে। বন্দী কারাগারে অমানষিক জীবন কাটাতে হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। শাসকগোষ্ঠীর নগ্ন থাবায় পৈশাষিক অত্যাচারে আমাদের জীবনগুলো আজ ক্ষতবিক্ষত ও বিলুপ্ত প্রায় আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব। শাসকগোষ্ঠীর জেল-জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়নের উত্তাপের ভয়ে ছাত্র যৌবন মুখ লুকিয়ে থাকার মতো তারা কেউ নয়। পৃথিবীর দেশে-দেশে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী দেয়, অত্যাচারী স্বৈরশাসকের পৈশাষিক নির্যাতনের ভয়কে জয় করেছিলো ছাত্র ও যুব সমাজ। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় চার দেয়ালের মধ্যে আজ চুপ করে বসে থাকার সময় নয়, এখনই সময় নিজেকে এবং অন্যকে জাগ্রত করার, সময় এখন জেগে ওঠার। জুম্ম ছাত্র যৌবনের জয় হোক!
তথ্যসুত্রঃ উদয়ন ত্রিপুরা, সাবেক পিসিপির সভাপতি।