সজীব চাকমা
◨ আদিবাসী প্রসঙ্গ
বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে।
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৩ সালকে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের আন্তর্জাতিক বর্ষ’, ৯ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ এবং ১৯৯৫ সাল হতে ২০০৪ সাল সময়কে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের প্রথম আন্তর্জাতিক দশক’ হিসেবে ঘোষণার পর থেকে বিশ্বের ও দেশের অপরাপর আদিবাসীদের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণও এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। সেই থেকেই এই পরিচয়টি আরও অধিকতর সামনে এসেছে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদেরকে অনেক আগেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, উক্ত শাসনবিধির তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন আইনসমূহের মধ্যে দি ইন্ডিয়ান ইনকাম ট্যাক্স এ্যাক্ট ১৯২২, দি ইন্ডিয়ান ফিনান্স এ্যাক্ট ১৯৪১, দ্য ফরেস্ট এ্যাক্ট ১৯৭২ প্রভৃতির ক্ষেত্রেও ‘আদিবাসী পাহাড়ী’ (indigenous hillmen) শব্দটি উল্লেখকরা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে, এমনকী সাম্প্রতিক কালেও সরকারের পক্ষ থেকে এবং সরকারী বিভিন্ন দলিলে বাঙালী জনগোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ বলে অভিহিত করা হয়ে আসছিল। বর্তমান সরকারী দল আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ‘আদিবাসী’ আখ্যাটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রগতিশীল সাহিত্যিক প্রয়াত আহমদ ছফা ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত তার জীবনের প্রথম প্রবন্ধ ‘কর্ণফুলীর ধারে’তে পাহাড়ী মানুষদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই অভিহিত করেছিলেন।
এ বছরের মে মাসে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি মোঃ ইকবাল আহমেদ মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই।’ গত ২৬ জুলাই ২০১১ বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নাটকীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা না করতে এবং তার পরিবর্তে ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী’, ‘Ethnic Minority’ হিসেবে অভিহিত করার আহ্বান জানান। দীপু মনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় কোন আদিবাসী নেই। ঐ এলাকার অধিবাসীরা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী।’ জানা যায়, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রাক্কালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের যাতে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হয় তার জন্য সরকারী একটি বিশেষ মহল অত্যন্ত তৎপর ছিল।
▋পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের আদিবাসী জাতির বসবাস রয়েছে। সে সমস্ত দেশের আদিবাসীদের ভূমি ও সম্পদের অধিকারসহ অনেক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। সেই দেশের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য কোন প্রকার হুমকী সৃষ্টি হয়েছে বলে তো নজির নেই। সম্ভবত বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশী তাদের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ত্রস্ত থাকে। এটা এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতা অথবা জনগণের প্রতি অবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ।
বস্তুত সরকার এদেশের সংখ্যালঘু জাতিগুলো ‘আদিবাসী’ নয় এই দাবীর পেছনে প্রধানত দু’টি যুক্তি উপস্থাপন করছে। প্রথমত, তারা এ অঞ্চলের আদিম বাসিন্দা নয়। তারা সবাই বাংলাদেশের ভূখন্ডের বাইরে থেকে এসেছে। বাঙালীরাই এদেশের প্রকৃত আদিবাসী। দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে, এ জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকী সৃষ্টি করবে। প্রকৃত প্রস্তাবে উভয় যুক্তিই খোঁড়া এবং ভিত্তিহীন। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের আদিবাসী জাতির বসবাস রয়েছে। সে সমস্ত দেশের আদিবাসীদের ভূমি ও সম্পদের অধিকারসহ অনেক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। সেই দেশের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য কোন প্রকার হুমকী সৃষ্টি হয়েছে বলে তো নজির নেই। সম্ভবত বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশী তাদের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ত্রস্ত থাকে। এটা এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতা অথবা জনগণের প্রতি অবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। আর কথায় কথায় সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের ন্যায্য দাবীকে বা অধিকারকে ও আন্দোলনকে উপেক্ষা করা এবং দমন-পীড়ন করা বাংলাদেশ সরকারসমূহের একটা সাধারণ অপকৌশল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ব পর্যন্ত এই সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের কাজের অংশ হিসেবে জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবীকে পদদলিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অনেক তান্ডবলীলা চালালো হয়েছিল। আর এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকী সৃষ্টি’র অজুহাতটি সেই পুরানো অপকৌশলেরই অংশ বৈ কিছু নয়। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়, তারা ছিল অভিবাসী-এই যুক্তিতে জুম্মদেরকে বা অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে।
সরকার মূলত আন্তর্জাতিক দলিলে গৃহীত ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘আদিবাসী’ শব্দকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেবল ‘আদিম বাসিন্দা’ বা ‘প্রাচীন অধিবাসী’ এই ধারণার সাথে গুলিয়ে ফেলছে বা অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াসও চালানো হচ্ছে। বস্তুত ‘আদি বাসিন্দা’ এই ধারণার সাথে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ পরিচয় বা সংজ্ঞার মধ্যে মুখ্যত কোন সম্পর্ক নেই।
প্রসঙ্গক্রমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বর্তমান ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ এর সংজ্ঞা স্মরণ করা যাক। এখানে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোটিয়র জোসে মার্টিনেজ কোবো’র ১৯৮৪ সালে প্রদত্ত সংজ্ঞাটি যা জাতিসংঘ ‘ওয়ার্কিং ডেফিনিশন’ হিসেবে গ্রহণ করেছে তা উল্লেখ করা যাক। এতে বলা হয়েছে যে- ‘আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদেকে বুঝায় যাদের ভূখন্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশিক কাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে যারা নিজেদেরকে উক্ত ভূখন্ডে বা ভূখন্ডের কিয়দংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। বর্তমানে তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইনী ব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্ব-পুরুষদের ভূখন্ড ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যত বংশদরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মোট কথা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা বহিরাগত কর্তৃক দখল বা বসতিস্থাপনের পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মূল অধিবাসীর বংশধর।’
অপরদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন নং ১৬৯ এর সংজ্ঞা অনুয়ায়ী- ‘স্বাধীন দেশসমূহের জাতিসমূহ- যারা এই মর্মে আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত যে, তারা ঐ দেশটিতে কিংবা দেশটি যে ভৌগলিক ভূখন্ডে অবস্থিত সেখানে রাজ্য বিজয় কিংবা উপনিবেশ স্থাপন কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণ কাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যারা তাদের আইনগত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশবিশেষ বা সম্পূর্ণ লালন করে চলেছে।’
বলাবাহুল্য, উক্ত সংজ্ঞায় কোথাও আদিবাসী হওয়ার জন্য আদিম বাসিন্দা হওয়ার শর্ত নেই। আর প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-উপনিবেশিক কাল থেকে এবং উপনিবেশ স্থাপন কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণেরও বহু কাল আগে থেকে যে জুম্মরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে তাতো দিবালোকের মত সত্য। আর জুম্মরাই যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত প্রাচীন স্থায়ী অধিবাসী- ইতিহাসও তারই সাক্ষ্য দেয়। এই প্রসঙ্গটি পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হবে। যাই হোক, আদিবাসী বলতে বস্তুত দেশে দেশে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অধিকারী সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলোকেই তুলে ধরা হয়েছে। আর এটা কোন জাতিগত পরিচয়ও নয়। এই অভিধার মধ্য দিয়ে মূলত এ সমস্ত জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংকটময় প্রান্তিক অবস্থাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ‘ইন্ডিজেনাস’ ও ‘ট্রাইবাল’- উভয়ই সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই তুলে ধরে।
উল্লেখ্য, সরকার ও জাত্যাভিমানীদের কাছে, ‘উপজাতি’ শব্দটিই অধিক পছন্দের। ‘ট্রাইবাল’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত ‘উপজাতি’ শব্দটি এখন বিতর্কিত এবং সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও সরকারীভাবে প্রচলিত রয়েছে বলে জনগণ তা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর অতীতে মূলত নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় ব্যবহৃত হলেও এখন তার অর্থ অন্যভাবে বা অপমানজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা যতটা না নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তার চেয়ে বেশী এদেশের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী জাতিসমূহকে ‘হেয় প্রতিপন্ন করা’, ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক জ্ঞান করা’, তাদের অগ্রগতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দমন করার উদ্দেশ্যেই তারা এটা চাপিয়ে দিতে চায়। না হলে তাদের স্বার্থটা কোথায়? এটা এক ধরনের বর্ণবাদী, জাত্যাভিমানী ও আগ্রাসী মানসিকতা।
◨ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও অপপ্রচার প্রসঙ্গ
বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতির চর্চা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত সংকীর্ণ ও কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই অপসংস্কৃতির উৎপত্তি। এই অপসংস্কৃতিটি বাংলাদেশের জনগণের মনে, মননে যথেষ্ট ক্ষতি করছে। এর কাজ হলো মূলত একটি সংকীর্ণ ও কায়েমী স্বার্থ হাসিল করা, অপরের মত ও অধিকারকে অসম্মান ও অবদমিত করা, সত্য ও মিথ্যাকে গুলিয়ে দেয়া অথবা সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যর্থ অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আর এই অপসংস্কৃতির অসুখে আক্রান্ত বাংলাদেশের সবকটি বড় রাজনৈতিক দল। আর এর দ্বারা সংক্রমিত অনেকেই। এটা দেশের গণতন্ত্রায়নে ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ভেতর থেকে আঘাত হানছে।
এই ইতিহাস বিকৃতির অপসংস্কৃতি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বস্তুত এটা জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ। সেই ষড়যন্ত্র আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। আর সেই ষড়যন্ত্রের গতিবেগ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে যখন স্বয়ং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এদেশে কোন আদিবাসী নেই, আদিবাসী যদি কেউ থাকে তাহলে বাঙালীরাই প্রকৃত আদিবাসী। লক্ষণীয় ব্যাপার এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দিকেই বেশী। নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে, বই বের করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা এদেশের অর্থাৎ বাংলাদেশের স্থায়ী অধিবাসী নয়। এজন্য সত্যমিথ্যা মিশিয়ে অনেক উদ্দেশ্যমূলক ও আক্রোশমূলক কাহিনী বা বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেসব বক্তব্য রীতিমত ইতিহাস বলে প্রচার করা হচ্ছে।
নিম্নে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর, পক্ষপাতমূলক ও মিথ্যা তথ্য ও ব্যাখ্যার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যাক।
১। সম্প্রতি জনৈক জামাল উদ্দিন কর্তৃক লিখিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ নামে একটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে-
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের চিরকালীন অখন্ড ভৌগলিক অঞ্চল। অতীতে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে এ অঞ্চল প্রতিবেশী রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু কখনো ভিন্ন দেশের অংশে পরিণত হয়নি, চিরকালই নামে চট্টগ্রাম এবং ভৌগলিক পরিচয়ে বাংলার আদি অখন্ড অঞ্চল হিসেবে ছিল এবং এখনও রয়েছে।’
‘কুকি–চীন ভাষাভাষিদের পরে এ অঞ্চলের উত্তরাংশে সম্ভবত উত্তর দিক থেকে আসে বরো ভাষাভাষি ত্রিপুরাদের রিয়াং জনগোষ্ঠীর লোকেরা।….রিয়াংদের পরে সম্ভবত চাকমারা অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে।’
‘১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খাঁ এ প্রদেশের রাজস্ব সংগঠনকে পুনর্গঠন করেন। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম (পার্বত্য অঞ্চলসহ) অঞ্চলটি ইসলামাবাদ চাকলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
‘উপজাতি বলতে এখন যাদেরকে বোঝানো হয়, তাদের পূর্ব পুরুষেরা বাইরে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে শ’দুয়েক বছর পূর্বে।’
‘বাংলাদেশ ভূখন্ডে সাঁওতালদের আগমনকাল একশ বছরের মত।’
২। অপরদিকে জনৈক সাহাদত হোসেন খান কর্তৃক রচিত ‘পার্বত্য উপজাতিদের আদি নিবাস’ নামে অপর একটি বইয়ে আরও বেশী আপত্তিকর, উস্কানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। বইটির বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত নিম্নে মানসম্পন্ন এবং চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। তার কয়েকটি মাত্র তুলে ধরা হল-
‘লিখতে গিয়ে দেখেছি যে, পার্বত্য উপজাতীয়রা আদৌ আদিবাসী নয়। কয়েকশ’ বছর আগেও তারা এ দেশ এবং এ মাটির কেউ ছিল না। বাংলাদেশ নামের এ ভূখন্ডের সঙ্গে তাদের নাড়ির কোন সম্পর্ক নেই। তারপরও তাদের কোন কোন গ্রুপ বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তাদের এ অশুভ চক্রান্তে ইন্ধন যোগাচ্ছে বিদেশীরা।….আমি পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। এ চুক্তি পুরোপুরি বাঙ্গালীদের স্বার্থ বিরোধী।’
‘উপজাতীয়রা সুখে থাক একজন মানুষ হিসেবে এ কামনা আমারও। কিন্তু বাইরের ভূখন্ড থেকে এসে এখানকার মূল বাসিন্দাদের চেয়ে বেশী সুবিধা ভোগ করবে আমি তা সমর্থন করতে পারি না।’
‘চাকমারা তাদের দাবী অনুযায়ী এ মাটির সন্তান কিংবা গারো নয়। বরং তারা হলো বহিরাগত ও শরণার্থী।’
‘চাকমাদের আদি ভূমি খুঁজে বের করা সত্যি অসম্ভব।’
‘এসব বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, চাকমারা হচ্ছে বহিরাগত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রিত একটি জনগোষ্ঠী যাদের ভাষা, ইতিহাস এমনকি পরিচিতি বিভ্রান্তিকর এবং অজানা। এটাই ভাগ্যের পরিহাস যে, এ ধরণের নাম পরিচয়হীন একটি সম্প্রদায় দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।’
‘শাব্দিক অর্থে চাকমা হচ্ছে একটি পার্বত্য যাযাবর সম্প্রদায় অথবা অজ্ঞাত বংশোদ্ভূত লোক যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য জায়গা থেকে তারা বিতাড়িত হয়।’
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে জন বসতির ইতিহাস নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বইপত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু এসব লেখালেখির গভীরতা খুব কম। প্রকাশিত লেখালেখিগুলো গবেষণামূলক হলে নিঃসন্দেহে এ খন্ডনীয় সত্য প্রমাণিত হতো যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানরাই হলো প্রথম বসতিস্থাপনকারী এবং বাংলাদেশ হলো এ ইতিহাসের বৈধ উত্তরাধিকারী।’
‘চাকমা অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য কোন উপজাতি ইংরেজদের উপর হামলা চালায়নি।’
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে গারো পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতীয়রা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানায় বসবাস করলেও প্রতিবেশী ভারত ও বাইরের রাষ্ট্রের প্রতি তারা কমবেশী দুর্বল। বাইরের দেশগুলোও তাদের মদদ দিচ্ছে। লক্ষ্য করলে একটি সত্য পরিষ্কার ধরা পড়ে যে, যারা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানা পরিবর্তন করতে চায়, তাদের একজনও মুসলমান নয়।’
পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, উক্ত লেখাসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ইতিহাসের উপর কীভাবে আঘাত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের নামে কী মিথ্যার বেসাতি করা হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদেরকে কী হিংসার চোখে দেখা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চাকমাদেরকে সবচেয়ে বেশী আক্রমণ করা হয়েছে বিশেষ করে সাহাদত হোসেন খানের বইয়ে। আবার বইয়ের শুরুতে ‘লেখকের কিছু কথা’য় লেখা হয়েছে, ‘উপজাতীয়দের কেউ যদি আমার লেখায় আহত হন তাহলে আমি দুঃখিত।…মানুষ হিসেবে তারা অত্যন্ত সরল।’ কী সুন্দর কথা! আসলে এ সমস্ত লোকরাই আদিবাসীদের পিঠ চাপড়ে সহজ-সরল বলে ফোঁস ফোঁস করে গরল ঢেলে দেন। আর আদিবাসীরা সেই ছলনার গরলে গলে গিয়ে দিন দিন নিজ আবাসভূমিতে বিরল হয়ে যাচ্ছেন। আর ‘যারা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানা পরিবর্তন করতে চায়, তাদের একজনও মুসলমান নয়’- এই বক্তব্য দিয়ে অতি সুক্ষ্মভাবে দেশের বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী জুম্মদের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার একটা অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। এই বক্তব্য পড়লে মনে হবে যে, জুম্মরা স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য লড়াই করছে আর মুসলমানদের কাছ থেকে সেই ভূখন্ড কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এর চেয়ে জলজ্যান্ত মিথ্যাচার, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য আর কি হতে পারে!
৩। উক্ত বক্তব্য পড়ার সাথে সাথে পাঠকদের অবশ্যই স্মরণ হবে বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য। তিনি বলেছিলেন- ‘উয়ারী বটেশ্বরের পোড়াতত্ত্ব অনুযায়ী এ দেশের জনগণের ৪ হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সব উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে, তারা ১৬ থেকে ১৯ শতকে সুলতানি ও মোগল আমলে মিয়ানমার কম্বোডিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আগমন করে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তাই তারা আদিবাসী নয়। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমির ফার্স্ট নেশন হিসেবে এ অঞ্চলের আদিবাসী হতে পারে না তারা। বরং তারা ঐতিহাসিকভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অভিবাসনকারী জনগোষ্ঠী।’
৪। এ প্রসঙ্গে এখানে তানভির মোকাম্মেল এর ‘কর্র্ণফুলীর কান্না’ নামের প্রামাণ্য চিত্রটির একটি অংশ স্মর্তব্য। সেখানে এক সাক্ষাৎকার পর্বে ৭৯/৮০ সালে লংগদুতে পুনর্বাসিত সেটেলার পাড়ার এক সেটেলার বাঙালী সাক্ষাৎকারে বলেছিল অনেকটা এরকম, ‘এখানকার উপজাতিরা তো এসেছে বর্মা, থাইলন্ড, কম্বোডিয়া থেকে।’ বলাবাহুল্য, ঐ নিরক্ষর বাঙালী যে বড় গবেষকের মত আদিবাসী জুম্মদের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে বক্তব্য দিলো, তা নিশ্চয়ই তার জানার কথা নয়। এটা যে শেখানো বুলি বা সুপরিকল্পিত অপপ্রচারণার নমুনা তা বলাই বাহুল্য।
বস্তুত এখানে ঐ বাঙালী সেটেলারটি, উল্লেখিত বইয়ে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির বক্তব্যের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী জুম্মদের ইতিহাস বিষয়ে ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বরঞ্চ সকলেরই একটা জায়গায় মিল লক্ষণীয় যে, সবারই প্রচেষ্টা এটা প্রমাণ করা যে- জুম্মরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদি বাসিন্দা নয়। তারাই বহিরাগত। বাংলাদেশ হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকে কেবল বাঙালীরই দেশ। কী অদ্ভুদ ইতিহাস বোধ বা ইতিহাস জ্ঞান।
আর উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর আদিবাসীদের ইতিহাস বিষয়ে যে বিভ্রান্তিকর ধারণাগুলো প্রচারের অপচেষ্টা করা হচ্ছে সংক্ষেপে সেগুলো হলো-
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চিরকালই চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অংশ। আর বাংলাদেশ হচ্ছে বাঙালীরই দেশ।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বহিরাগত। তারা দুশ’ বছর আগে এদেশে এসেছে। এমনকী একশ বছর আগে এসেছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানরাই হলো প্রথম বসতিস্থাপনকারী এবং বাংলাদেশ হলো এ ইতিহাসের বৈধ উত্তরাধিকারী।
বলাবাহুল্য উক্ত অপপ্রচারণা বা বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করে আদিবাসীদের রাজনৈতিক ও ঐতিহ্যগত ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং এ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করে তাদের উপর যে নির্যাতন, নিপীড়নের স্টিম রোলার চালানো হয়েছে, অবৈধভাবে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত যে আদিবাসীদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদেরকে সংখ্যালঘু করে ইসলামীকরণ করা হচ্ছে তার বৈধতা দান করা।
◨ অপপ্রচার বনাম ইতিহাস
এখন দেখা যাক প্রকৃত ইতিহাস কী বলে। বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের প্রাচীন ইতিহাসের অনেক কিছুই এখনও অনাবিস্কৃত। তবে এই ইতিহাস উদঘাটন করা মোটেও অসম্ভব নয়। আর ধীরে ধীরে অনেক কিছুই জানা সম্ভব হচ্ছে। আর বাঙালীর ইতিহাস প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, ‘বাঙালীর ইতিহাস আজো বলতে গেলে অনাবিস্কৃত ও অলিখিত’। কাজেই ইতিহাসের চুড়ান্ত নির্ণয় করা কঠিন। তবে যা আবিস্কৃত হয়েছে তা থেকেও একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। সেটা হচ্ছে- বাঙলা, বাঙালী, বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম এর ইতিহাসের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকেও গুলিয়ে ফেলা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী জুম্মদের ইতিহাস শুরু করা হচ্ছে সেই বঙ্গ বা বঙ্গাল থেকে। সে কারণে বঙ্গ, বঙ্গাল বা বাঙালীর ইতিহাসকে নির্বিচারে বাংলাদেশের, চট্টগ্রামের বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বলে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। অপব্যাখ্যাকারীদের ভাষ্যে বাংলার বা বাঙালীর ইতিহাস বলতে মূলত মুসলমান বাঙালীদের ইতিহাসই কল্পনা করা হচ্ছে। আর বাঙালীর ইতিহাস ও বর্তমানের বাংলাদেশের ইতিহাসের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা ভুলে যাওয়া হচ্ছে। সে কারণেই বাঙালী ব্যতীত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী অন্যান্য ভিন্ন জাতিসমূহের ইতিহাসকে বিবেচনাই করা হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বিবেচনার ক্ষেত্রে একদেশদর্শী ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করা হচ্ছে। আর এই দোষে দুষ্ট হয়েই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনছেন সূদুর নরসিংদীতে আবিস্কৃত প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন উয়ারী-বটেশ্বরের কথা, যা মৌর্য যুগের জনপদ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, মৌর্যরা এই জনপদের শাসক হলেও তারা বাঙালী নয়, ‘বিদেশী’ বলেই উল্লেখ করেছেন ড. আহমদ শরীফ। আর পরবর্তীতে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও মৌর্য, গুপ্ত ও পাল আমলে এ অঞ্চল বাংলার শাসনভুক্ত ছিল না।
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালী জাতি ছাড়াও আরও প্রায় অর্ধ শতাধিক ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। বাংলা ও বাঙালী থেকে বাংলাদেশের নামকরণ হলেও এদেশের সবাই যে বাঙালী নয় তা দিবালোকের মতই সত্য।আর ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই এ সব ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বিচরণ বা বসবাস করে আসছে। কিন্তু তারপরও এসব জাতিসমূহকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপকতা ও গভীরতা সবচেয়ে বেশী দৃশ্যমান হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসমূহের ক্ষেত্রে।
এদেশের বা এ অঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ে লেখক ও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান লিখেছেন-
‘এটা বলাবাহুল্য যে, আজ বাংলাদেশ যে অক্ষাংশ–দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত সেই ভূখন্ডে ‘বাংলাদেশ’ বলে কোন রাষ্ট্র ছিল না।’ (পৃঃ ২৭, বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ)
‘১২০৪–৫ সালে যখন মুহাম্মদ ইখতিয়ারুদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজি নদিয়া আক্রমণ করেন তখন বঙ্গের নির্দিষ্ট একটা রাজ্যনাম বা আঞ্চলিক নাম ছিল।’
‘মোঘল বিজয়ের পর ঐতিহাসিক আবুল ফজল বাঙ্গালার সীমানা নির্ধারণ করেছেন চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াগড়হি ৪০০ ক্রোশ, পূর্ব ও উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র এবং পশ্চিমে সুবা বিহার।’
‘১৭ আগস্ট ১৯৪৭ র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও খুলনা জেলা পূর্ববঙ্গে রয়ে যায়।’
তিনি আরও লিখেছেন- ‘সৈয়দ আমীরুল ইসলাম তাঁর বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস–এ নরসিংদি অঞ্চলে বঙ্গের আদি অবস্থান বলে অনুমান করেছেন। কারণ নরসিংদি জেলার মধ্যে বঙপুর, বঙের টেক, বঙ্গার চর, বাঙালী নগর, বাঙাল গাঁও, উত্তর বাঙাল গাঁও, বাঙাল সাতপাড়া ইত্যাদি নাম রয়েছে, এর কাছেই কাপাসিয়া যেখানে কার্পাস তুলো জন্মাত।’
বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন-
‘বস্তুত ব্রিটিশ পূর্বকালে আজকের বাংলাভাষী অঞ্চল কখনো একচ্ছত্র শাসনে ছিল বলে প্রমাণ নেই। কাজেই বাংলার সার্বিক ইতিহাসের ধারণা–কল্পনা সম্ভব নয়। আমরা যখন বাংলার আদি ইতিহাসের কথা বলি, তখন আমরা আবেগবশে সত্যকে অতিক্রম করে যাই, কেননা, জানা তথ্য আমাদের সে অধিকার দেয় না। পূর্বে যেমন রাঢ়, সুহ্ম, পুন্ড্র, গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি নামে বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচিত ছিল, কোন একক নামে বা একক শাসনে গোটা আধুনিক বাংলা কখনো অভিহিত বা প্রশাসিত ছিল না’
‘বাংলার রাঢ়–বরেন্দ্র অঞ্চলই প্রাচীন। পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ অর্বাচীন। রাঢ় ছিল অনুন্নত ও অজ্ঞাত। তাই বরেন্দ্র নিয়েই বাঙলার ইতিহাসের শুরু। মানুষের আদি নিবাস ছিল সাইবেরিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। সেখান থেকেই নানা পথ ঘুরে আসে ভূমধ্য সাগরীয় দ্রাবিড়–নিগ্রো, সাইবেরীয় নর্ডিক–মঙ্গোল। এরাই অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, শামীয়, নিগ্রো, আর্য, তাতার, শক, হুন, কুশান, গ্রিক, মঙ্গোল, ভোট চীনা প্রভৃতি নামে পরিচিত। আমাদের গায়ে আর্য–রক্ত সামান্য, নিগ্রো–রক্ত কম নয়, তবে বেশী আছে দ্রাবিড় ও মঙ্গোল রক্ত, অর্থাৎ আমাদেরই নিকট–জ্ঞাতি হচ্ছে কোল, মুন্ডা, সাঁওতাল, নাগা, কুকী, তিব্বতী, কাছারী, অহোম প্রভৃতি।’
‘উনিশ শতক অবধি ‘গৌড়’ ও ‘বঙ্গ’ নামে দু’ভাগে নির্দেশিত হতো এ বৃহৎ অঞ্চলটি। তুর্কিপূর্বকালে গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, পুন্ড্রও, বরেন্দ্র, বঙ্গ বঙ্গাল, সমতট এবং হরিকেল ও কামরূপ (অসম) নামে পরিচিত হত বিভিন্ন অঞ্চলে।’ ‘বঙ্গ– ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, হরিখেল– চট্টগ্রাম, পার্বত্য ত্রিপুরা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম।’
‘আজ আমরা ভৌগোলিক, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে যে জনগোষ্ঠীকে বাঙালী এবং যে ভূখন্ডকে বাঙলা বা বাঙলাদেশ বলে জানি, তা আধুনিক কালের। প্রাচীনকালে এদেশে একক নামের ও অভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের কোন পরিচয় মেলে না। মোটামুটিভাবে বলা যায় গৌড়, রাঢ় ও পুন্ড্র অঞ্চলই প্রাচীন জনপদ। এসব অঞ্চলে বিছিন্নভাবে কিছু বর্বর বুনোমানুষ গোষ্ঠীজীবনে অভ্যস্ত ছিল।’
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন- ‘প্রাচীনকালে বঙ্গদেশের কোন নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। যুগে যুগে ইহার সীমা ও আয়তনের পরিবর্তন হইয়াছে….বঙ্গাল পূর্বে পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম ছিল। বঙ্গ ও বাঙ্গাল এই দুইটি নামই এক সময় দুইটি পৃথক দেশেরনাম ছিল।’
উপরোক্ত তথ্য ও আলোচনা থেকে প্রমাণিত যে, বাংলাদেশ মানেই কেবল বাঙালীর দেশ নয়। অতীতের বিভিন্ন রাজ্য বা অঞ্চল নিয়েই আজকের এই বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম যে চিরকাল বর্তমান বাংলার বা বাঙালীর অধিকৃত ছিল না তাও সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের যে ইতিহাস-ঐতিহ্য তাতে বিভিন্ন জাতির মানুষের, ব্রাহ্মণ্যবাদী, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানদের অবদান রয়েছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম অন্যতম প্রধান ধর্ম হলেও ভারত উপমহাদেশে এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে আরব মুসলমানদের কর্তৃক ভারত বিজয়ের পর থেকে। ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘আমরা আগে ছিলাম animist, পরে হলাম pagan, তারও পরে ছিলাম হিন্দু-বৌদ্ধ, এখন আমরা হিন্দু কিংবা মুসলমান।’
◨ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম বসতিস্থাপনকারী জুম্মরাই
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত বা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও অনুপস্থিত। অনেক সময় এর ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গ, বঙ্গাল, বাংলাদেশ বা চট্টগ্রাম বন্দর থেকেই শুরু করা হয়। ফলে এই ইতিহাস খন্ডিতই থেকে যায়। আর এ অঞ্চলে যে ১৪টি আদিবাসী জাতির বসবাস তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য যেমনি স্বতন্ত্র, বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনি তাদের অতীত ইতিহাস এখনও বেশ গবেষণা সাপেক্ষ। তবে অবশ্যই প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর পশ্চাতে আছে শত শত বছরের ঐতিহ্য ও কিংবদন্তী কাহিনী। তাদের মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, লুসাই, পাংখো, খুমী, খিয়াং ও চাকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতিস্থাপনের ইতিহাস প্রাচীনতর। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম কখন জনবসতি শুরু হয় তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। তবে আজকে যারা নিজেদেরকে জুম্ম বা আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে চাইছে আর সরকার জোর করে উপজাতি বা বাঙালী পরিচয়টি চাপিয়ে দিতে চাইছে তারাই যে এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীনতম বসতিস্থাপনকারী তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ভ্রমণশীল নানা মানবগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে থাকলেও অনেকেই শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে বসবাস করেনি। ভারত বা প্রাচীন বাংলা কিংবা অন্য কোন সমতল ভূমির সভ্যতার মানুষ যারা ইতোমধ্যে স্থায়ী কৃষি সভ্যতা গড়ে তুলেছে, প্রাকৃতিক দুর্গম্যতার কারণে তারা এখানে কদাচিৎ আগমন করেছে বলে ধারণা করা যায়। বিভিন্ন সময় আরাকান, ত্রিপুরা ও বাংলার রাজশক্তির দ্বারা বাহ্যিকভাবে প্রভাবিত বা কর্তৃত্বাধীনে থাকলেও এই জনপদ বিকশিত হয় স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত যারা এখানে এই দুর্গম এলাকাটি আবাদ করে স্থায়ী আবাসভূমি গড়ে তোলে, সম্পূর্ণ নতুন এক সভ্যতার উন্মেষ ঘটায় তারা আদৌ বাঙালীও নয়। তারা সংখ্যায়লঘু, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অধিকারী একাধিক জুম্ম জাতি।
খন্ডিতভাবে বলা হয় এ অঞ্চলের আদিবাসীরা বহিরাগত। তারা ত্রিপুরা, আরাকান, বার্মা ইত্যাদি অঞ্চল থেকে এসেছে। যদিও আরও গবেষণা সাপেক্ষ তবুও যদি ধরেই নিই যে, তারা উক্ত অঞ্চল থেকেই এসেছে, তাতেও প্রমাণ করা যায় যে, এই সমস্ত আদিবাসীরা এ অঞ্চলের প্রথম বসতিস্থাপনকারী। তারাই এই অঞ্চলকে আবাদ করে বাসযোগ্য করে তোলে। আর তারা সেই সূদুর অতীতে যখনি এই অঞ্চলকে জনপদে পরিণত করে তখন চট্টগ্রাম জেলা বা বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, আরাকান এই পাহাড়ী ভূখন্ডটি পাহাড়ী জীবনে অভ্যস্ত বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসমূহেরই বিচরণ ক্ষেত্র। তুলনামূলকভাবে যারা সংখ্যায় বেশী, শক্তিশালী বেশী তারাই বিভিন্ন সময় এই অঞ্চলসমূহে এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। এমনকী বিভিন্ন সময় ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামসহ বিস্তীর্ণ সমতল অঞ্চলও এসব জাতিগোষ্ঠীর রাজ্যভুক্ত ছিল। পূর্ব থেকেই পার্বত্য অঞ্চলটি কার্যত চট্টগ্রামের বাইরে ছিল তারও নানা তথ্য পাওয়া যায়। বস্তুত বৃটিশরা আগমনের পর তারাই গোটা উপমহাদেশীয় অঞ্চলকে ধীরে ধীরে অধিকার করে স্থিতিশীলতা দান করেন, সংহত করেন এবং বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানার ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা বার্মা বা আরাকান থেকে, চীন বা হিমালয়ের পাদদেশ, এমনকী সূদূর ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল থেকে আগমন করেছে কীনা তার চেয়ে বড় বাস্তব বিষয় হচ্ছে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এরাই হচ্ছে আদি ও প্রথম বসতি স্থাপনকারী। এজন্য শত শত বছরের ইতিহাসের দরকার হয় না, মাত্র শ’দুয়েক বছর পেছনে গেলে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এ অঞ্চলের আদমশুমারীর ধারাবাহিক পরিসংখ্যান দেখলেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ- পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৪১ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ৯৭.০৬%, বাঙালী জনগোষ্ঠী ২.৯৪%; ১৯৫১ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ৯৩.৭১% আর বাঙালী জনগোষ্ঠী ৬.২৯%, ১৯৬১ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ৮৮.২৩% আর বাঙালী জনগোষ্ঠী ১১.৭৭। অপরদিকে স্বাধীনতার পর জাতিগত আগ্রাসন ও জুম্মদের ভূমি বেদখল করে অনুপ্রবেশের ফলে ১৯৯১ সালে এর অনুপাত দাঁড়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ৫১.৪০% আর বাঙালী জনগোষ্ঠী ৪৮.৬০%।
আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীই যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম বসতিস্থাপনকারী তার কয়েকটি যুক্তি ও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য নিম্নরূপ-
ক. চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বন্দর ছিল। ফলে এটা কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নয় বরং শুরু থেকে নানা জনগোষ্ঠীর বা রাজ্যের মানুষের আনাগোনার ক্ষেত্র ছিল। আর নৈকট্যের কারণে এতে আরাকান, ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের বিচরণ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ফলে এই অঞ্চলে প্রাচীন কাল থেকেই আদিবাসী জুম্মদের আনাগোনা থাকা স্বাভাবিক।
খ. ড. আহমদ শরীফের লেখায় দেখা যায়, ‘খ্রিস্টীয় চার-পাঁচ শতক অবধি আরাকান-চট্টগ্রাম একক অঞ্চলরূপে ছিল। চট্টগ্রাম গোড়া থেকেই সম্ভবত আরাকানী শাসনে ছিল। আর নয় শতকের শেষপাদে ৮৭৭ অব্দের পূর্বে কোন সময়ে সমগ্র সমতট আরাকানী শাসনভুক্ত ছিল।’ এই স্বাক্ষ্য থেকেও এই অঞ্চলে আদিবাসী জুম্মদের বিচরণ থাকার সম্ভাবনা অধিক।
গ. বর্তমান ভারতের আসাম, অরুনাচল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ হয়ে ত্রিপুরা, মিজোরাম, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চটগ্রাম, আরাকান, বার্মা এ সমস্ত অঞ্চলের ভৌগলিক ও নৃতাত্ত্বিক মানচিত্রও যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে মঙ্গোলিয়ান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী হিসেবে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আদিবাসী জুম্মদেরই বিচরণ থাকার সম্ভাবনা বেশী, বাঙালীর নয়।
ঘ. ড. আহমদ শরীফ তাঁর চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ করেছেন- ‘চট্টগ্রামের আর একজন রাজা ববলাসুন্দরের চার সন্তান ছিল: চন্দ্রবাহন, অতীতবাহন, বালবাহন ও সুন্দর হচি। এঁরা সবাই বৌদ্ধধর্মের পৃষ্টপোষক ছিলেন। চন্দ্রবাহন আরাকানে, অতীতবাহন চাকমাদেশে (পার্বত্য চট্টগ্রামে), বালবাহন বর্মায় এবং সুন্দর হচি আসাম-কাছার-ত্রিপুরায় রাজত্ব করেন।’
ঙ. ড. আহমদ শরীফ আরও উল্লেখ করেছেন- ‘পগাঁর বিপর্যয়ের সুযোগে আরাকান -রাজ Mihnti প্রবল হয়ে উঠেন। তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন।….মার্কোপোলো এবং ১৩১৩ সনে স্যার জন হার্বার্ট চট্টগ্রাম পর্যটন করেন।… Mihnti বা মেঙদির আমলে উত্তরবঙ্গের চাকমা রাজধানী মাইচাগির (১৩৩৩-৩৪) আরাকান অধিকারে আগে (আসে?)।’ তাঁর লেখায় আরও পাই- ‘ইলিয়াস শাহ বংশীয় সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর রাজত্বকালে (আরাকানরাজ) মঙ সাউ মঙের ভাই মঙ খ্রী ওর্ফে আলি খান (১৪৩৪-৫৯) রামুর কিছু অংশ অধিকার করেন।..রামুর যে অংশ আরাকানরাজের অধীনে গেল সে অংশ রাজারকূল আর যে অংশ চাকমা সামন্তের (?) অধিকারে রইল তা চাকমারকূল নামে আজো পরিচিত।’
চ. ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ Joao de Barros কর্তৃক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত Descripcao do reino de Bengalla নামক একটি মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশে কর্ণফুলী নদীর পার্শ্ববর্তী ‘চাকোমাস’ (Chacomas) নামক একটি স্থানের নাম চিহ্নিত আছে। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে Gastaidi নামক একজন ইউরোপীয় কর্তৃক অঙ্কিত BENGALA নামক মানচিত্রে চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিকে এবং আরাকানের উত্তর দিকে একটি স্থানের নাম Chadma (চাডমা) হিসেবে পাওয়া যায়।
ছ. চট্টগ্রাম কাউন্সিলের প্রথম চীফ Mr. Henry Verelst তাঁর এক ঘোষণায় (১৭৬৩ খ্রিঃ) তৎকালী চাকমা রাজা শেরমুস্ত খান এর রাজ্যের বিবরণ দেন এভাবে- ‘ফেনী নদী থেকে সাঙ্গু পর্যন্ত সকল পাহাড়ী এলাকা এবং নিজামপুর রোড থেকে কুকিরাজার পর্বতমালা পর্যন্ত।’
জ. ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুনু খাঁ দেওয়ানের নেতৃত্বে জুম্মদের যে কৃষক বিদ্রোহ (১৭৭৭-১৭৮৭) সংঘটিত হয়েছিল যা ইতিহসে ‘তুলা বিদ্রোহ’ নামে উল্লেখ রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর উজান বেয়ে অভিযানে আসা ব্রিটিশ সৈন্যদের জুম্ম বিদ্রোহীরা এক দশক ধরে বার বার পরাজিত করেছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে জুম্মদের অভিজাত শ্রেণীর একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে তৎকালীন রাজা জানবক্স খাঁ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ১৭৮৭ সালের এক আক্রমণে জুম্মরা পরাজিত হলে কলকাতার ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গে ব্রিটিশদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন।
ঝ. ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণ করেন তখন তিনি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখো, খুমী, চাক, মুরং ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী এবং চাকমা রাজা ও বোমাং রাজার দেখা পান বলে উল্লেখ করেন।
উপরোক্ত তথ্য থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের কিয়দংশ জুড়ে কারা বিচরণ করেছিলেন এবং কারা রাজত্ব করেছিলেন। আর এই আদিবাসী জুম্মদের কর্তৃক মোগল এবং পরবর্তীকালে বৃটিশদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক প্রতিরোধ সংগ্রামও সেই সাক্ষ্য দেয়। সর্বশেষ ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামের এই বিশেষত্বকে এবং আদিবাসী জুম্মদের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে স্বীকার করেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে এবং শাসনের সুবিধার্থে প্রথমে চাকমা, পরে বোমাং ও মং এই তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে।
এখন আদিম বাসিন্দার ভিত্তিতে যে বাঙালীরা আদিবাসী হতে চায় তাহলে তাদের সূদুর বঙ্গ বা বঙ্গাল রাজ্যে বা অঞ্চলে চলে যেতে হয়। যেখান থেকে বাঙালী জাতির উৎপত্তি। আর আদি বাসিন্দার আরও যদি হিসাব কষি তাহলে পাহাড়ী-বাঙালী সবাইকে এই উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে সূদুর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বা তার আশেপাশের অঞ্চলে। মানবজাতির ইতিহাস তো তাই বলে।
আবদুল হালিম ও নূরুন নাহার বেগম তাঁদের ‘মানুষের ইতিহাস প্রাচীন যুগ’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘পৃথিবীর সব দেশের মানুষ একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।….আধুনিক মানব সমাজের উৎপত্তি হয়েছিল একটা মাত্র উৎস থেকে। আদিম এ মানুষদের সংস্কৃতি ছিল পুরান পাথর যুগের শিকারী সমাজের সংস্কৃতি। এ যুগে মানুষ তার সামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজেদের দেহের বিবর্তন ঘটিয়ে যে সুসম্পূর্ণ মানব দেহের উদয় ঘটিয়েছিল, আধুনিক পৃথিবীর সব কটি জাতির প্রত্যেকটি মানুষ সে সুপরিণত মানবদেহেরই উত্তরাধিকার মাত্র। আদিম শিকারী মানুষ যে সমাজ সংগঠন এবং বস্তুগত ও ভাবগত সংস্কৃতি সৃজন করেছিল তার অনেক উপাদানে আজকের পৃথিবীর সবকটি জাতির ও সমাজের মূল ভিত্তিরূপে কাজ করছে। আদিম মানুষ যে ভাষার উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল সে ভাষা ও চিন্তা ক্ষমতা, তার উদ্ভাবিত প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলী এবং নানাবিধ সামাজিক আচরণ ইত্যাদি আজকের দিনের সব মানবগোষ্ঠীর সামাজিক আচরণের মূল ভিত্তিরূপে বিরাজ করছে। ….আদিম শিকারী সমাজের মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমশ সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।’
ড. আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাংলার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ লেখায় উল্লেখ করেছেন- ‘আজকাল যে কথাটা স্বীকৃত হতে যাচ্ছে, অর্থাৎ আমরা যদিঅ স্ট্রিক-মোঙ্গলদের বংশধর হই, তাহলে সেই অস্ট্রিক-মোঙ্গলরা চিরকাল এদেশে ছিল নির্জিত, নিপীড়িত। তাদের অধিকাংশ মানুষ এখনও নিম্নবর্ণের ও নিম্নবিত্তের- অস্পৃশ্য। তারা কখনও মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। তাদের মধ্যে যারা বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গেছে তারা সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া ইত্যাদি। …আমরা দুই হাজার বছর ধরে বিজাতি, বিভাষী বিদেশীদের দ্বারা পীড়িত হয়েছি, নির্জিত হয়েছি। আমাদের স্বগোত্র স্বজাতি আজও নিরন্ন, নিপীড়িত, নিম্নবিত্ত ও মানবিক-মৌলিক অধিকার-বঞ্চিত। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে- হাড়ি-ডোম-মুচি-মেথর-বাগদিরাই আমাদের স্বগোত্র, স্বজাতি, আমাদের ভাই। আমাদের দেহে তাদেরই রক্তের ধারা বহমান। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, সাঁওতাল, কোচ, গারো, খাসিয়া, চাকমা আমাদের ভাই। আমরা যারা আমাদের গোত্র পরিচয় মুছে দিয়ে আমাদের জাতি পরিচয় লুকিয়ে বিদেশী, বিভাষী, বিজাতি শাসক শ্রেণীতে মিশে যেতে চেয়েছি, শাসকের সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করেছি, শাসকের পরিচয়ে আত্মপরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছি, তারা ভুল করছি, আত্মপ্রবঞ্চনা করেছি- তার জন্যে আমাদের দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে, আজও হচ্ছে। এটা আমাদের উপলব্ধিতে না আসলে ইতিহাস চর্চা হবে অর্থহীন।’
বিশিষ্ট লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা তাঁর ‘আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের অধিকার ও সরকারের অবস্থান’ প্রবন্ধে যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে, ‘প্রথম বা আদি অধিবাসী’ অর্থে যেভাবে আদিবাসী বুঝানো হয়ে থাকে, এশিয়ার ক্ষেত্রে তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এশিয়ার ক্ষেত্রে ‘প্রথমবা আদি অধিবাসী’ বৈশিষ্টের চেয়ে যাদের সমাজব্যবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেশের মূল শ্রোতধারার জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি হতে পৃথক, যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে পারিবারিক আইন পরিচালনা ও আভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করে, ভূমির সাথে যাদের নিবিড় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং যারা সাধারণভাবে মূলশ্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে সেই অর্থেই আদিবাসী হিসেবে বুঝানো হয়ে থাকে। উক্ত বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশের মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশে যেমন- নেপাল, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশেও এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।…ঐতিহাসিক কাল থেকে যাদের উপর চরম বৈষম্য ও বঞ্চনা চলে আসছে তাদের সেই বিশেষ প্রাপ্যটাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রদানের জন্য জাতিসংঘের বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশে সেসব অবহেলিত ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার নীতি অনুসৃত হয়ে আসছে।’
পরিশেষে এটাই আমরা বলতে চাই, জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভাল। আমাদের ইতিহাসের উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভূমিকা ভালো হোক, গণতান্ত্রিক হোক, মানবতাবাদী হোক, আমাদের প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর অবস্থান সমমর্যাদা ও সমঅধিকার ভিত্তিক হোক এটাই কাম্য। তাতেই আমাদের সবার ভবিষ্যত, দেশের ভবিষ্যত সুন্দর ও নিরাপদ হতে পারে। আরেক জাতির ইতিহাসকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করে এবং তার ঐতিহ্যগত ও ভূখন্ডের অধিকার কেড়ে নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে কখনো শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।