হিল ভয়েস, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বান্দরবান: বমপার্টি খ্যাত কেএনএফের হুমকি, অপহরণ, হত্যা, উচ্ছেদ, জোরপূর্বক খাদ্যশস্য আদায় ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ির সাধারণ গ্রামবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে। এর ফলে গত বছর থেকে যাবৎ ১৮ জনকে অপহরণ (তার মধ্যে ১১ জন বম, ৬ জন তঞ্চঙ্গ্যা ও ১ জন মারমা), কমপক্ষে ৭ জনকে হত্যা (তার মধ্যে ৩ জন বম, ৩ জন ত্রিপুরা ও ১ জন তঞ্চঙ্গ্যা), প্রায় দুই ডজন গ্রামের এক হাজারের বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা ও মারমা অধিবাসী উচ্ছেদ, বম জনগোষ্ঠীর ৭ শতাধিক গ্রামবাসী শরণার্থী হিসেবে মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে।
বমপার্টির অপহরণ ও হত্যার সর্বশেষ বলি হয়েছে রুমার বগালেইক এলাকার লালরামচনহ্ বম (লারাম বম)। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রুমার বগালেক পাড়ায় গীর্জায় উপাসনা চলাকালীন বমপার্টির সন্ত্রাসীরা লারাম বম, তার ছেলে, স্ত্রী, মা-বাবা পাঁচজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে অর্ধেক রাস্তা থেকে পরিবারের অপর চারজন সদস্যকে ছেড়ে দিলেও লারাম বমকে ছেড়ে না দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অপহরণের ৫ দিন পর গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ হারমন এবং দার্জিলিং পাড়ার মাঝখানে রুনতং পাড়ার রাস্তার মুখের খাদে তাঁর অর্ধ-গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। বমপার্টির সন্ত্রাসীরা লারাম বমের জিহ্বা কেটে, চোখ ছিদ্র করে এবং গলা কেটে দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এর আগে গত ২১ জুন ২০২২ বমপার্টির সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে তিনজন নিরীহ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা ও দুই শিশুকে গুলিবিদ্ধ করে।
উক্ত ঘটনার পর ২৯ জুন ২০২২ থেকে বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়ন এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের অন্তর্গত তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ডজনখানেক গ্রামের হতদরিদ্র শতাধিক জুমচাষী পরিবারকে উচ্ছেদ করে বমপার্টির সন্ত্রাসীরা। গ্রাম ছেড়ে না গেলে গুলি করে হত্যা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকিতে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীরা প্রাণের তাগিদে খাদ্যশস্য ও জিনিষপত্র ফেলে ও জুমক্ষেত রক্ষিত রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
এরপর ১৫ অক্টোবর ২০২২ তারিখে বমপার্টির সন্ত্রাসীরা বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়া থেকে ৬ তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে ৫ জন বমপার্টির আস্তানা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও রাঙ্গোয়া তঞ্চঙ্গ্যা (৩২) নামে একজন গ্রামবাসী পালিয়ে আসতে পারেননি। গত ১৯ অক্টোবর ২০২২ গ্রামবাসীরা বড়থলি ইউনিয়নের উলুছড়া এবং গঙ্গাছড়া পাড়ার মধ্যবর্তী এক স্থানে তার গালাকাটা লাশ উদ্ধার করে। তাকেও কুপিয়ে কুপিয়ে বমপার্টির সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে রুমার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের সুনসং পাড়ার সাবেক ইউপি মেম্বার লালপেকথাং বম ওরফে আপেক (৪৯), রুমানা নতুন পাড়ার কার্বারী বিয়াকসাং বম (৪৯) এবং সুনসং পাড়ার লালপিয়ানসাং বম (৩২) নামে তিনজনকে অপহরণ করে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা। প্রায় ২০/২৫ দিনের মাথায় সুনসং পাড়ার লালপিয়ানসাং বমকে ছেড়ে দেয়। তবে অন্য দুইজন লালপেকথাং বম এবং বিয়াকসাং বমকে আজ অবধি ছেড়ে দেয়নি। বমপার্টি সন্ত্রাসীরা তাদেরকে হত্যা করেছে বলে পরিবারের সদস্যদের ধারণা। হত্যা করার পরেও তাদের লাশ পরিবারদেরকে কাছে হস্তান্তর করেনি এবং তাদের কবরও দেখিয়ে দেয়নি কেএনএফ সন্ত্রাসীরা। তাদের সন্তানরা তাদের কাছে প্রিয় বাবা কখন ফিরে আসবে এই অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছে।
২০২২ সালে নভেম্বর মাসে পাখুম বম নামে মুননোয়াম পাড়ার সাবেক ইউপি মেম্বারকেও অপহরণ করে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা। তাকেও এখনো ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তার পরিবারের সদস্যরা কোন খবর পায়নি তিনি জীবিত আছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত নভেম্বর ২০২২ থেকে বমপার্টি ও সেনাবাহিনীর হুমকি ও উৎপীড়নের ফলে রুমার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বম জনগোষ্ঠীর ৭০০ জন নিরীহ শিশু, নারী ও পুরুষ স্ব স্ব গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভারতের মিজোরামের লংত্লাই জেলার চংতে মহকুমার চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
গত ১৭ এবং ১৯ জানুয়ারি বমপার্টির সন্ত্রাসীরা রুমা উপজেলার দুটি পৃথক ঘটনায় সিংলুম লিয়ান লুসাই ও লুমিয়োং মারমা নামক দুইজন নিরপরাধ গ্রামবাসীকে অপহরণ করে ও অমানষিকভাবে মারধর করার পর আহত অবস্থায় ছেড়ে দেয়।
গত ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ বমপার্টির হুমকি ও উৎপীড়নের ফলে রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের বাসতালাই, আর্থা পাড়া, হ্যাপি হিল এবং মুয়ালপি পাড়া থেকে বম ও মারমা জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন শতাধিক গ্রামবাসী স্ব স্ব গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রাংসা পাড়া, ইলি চান্দা পাড়া, ক্যকটাই পাড়া, ক্রোংক্ষ্যং পাড়াসহ রুমার প্রায় ১২টি পাড়ার লোকজন তিনদিন ধরে আতঙ্কে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।
এভাবে গুম হত্যার নির্যাতন এবং নিপীড়নের ভয়ে বম জাতির অনেক পরিবার নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিজোরাম প্রদেশে পালাতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে বম পাড়া সংলগ্ন সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করবে এবং যুদ্ধ হলে গোলাগুলিতে গ্রামবাসী নিহত হতে পারে বলে বম পাড়াবাসীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং পাড়া ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয় বমপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
এছাড়া পাড়ার স্কুল ঘর দখল করে বমপার্টির সদস্যরা অবস্থান করে থাকে। এতে সেনাবাহিনী অপারেশন চলে পারে এই ভয়ে স্কুল ঘরে না থেকে পাড়ার বাইরে থাকতে বমপার্টির সদস্যদেরকে অনুরোধ করলে উল্টো পাড়াবাসীদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় তারা।
আর বমপার্টির সন্ত্রাসীদের মুখে কেবল মারধর এবং হত্যার হুমকি শোনা যায়। ফলে খুন-খারাবি এবং অত্যাচারের ভয়ে বম জনগণ চরম আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। খ্রিষ্টান পাদ্রী, চার্চ এল্ডার ও জনপ্রতিনিধি কেউ বাদ নেই বমপার্টির শারিরীক নির্যাতন এবং হুমকি-ধামকি থেকে।
অপরদিকে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বমপার্টিকে সময়ে মদদপ্রদান ও কৌশলগত সহায়তা প্রদান, কখনো জনমতকে বিভ্রান্ত করতে বমপার্টি ও বমপার্টির আস্তানায় আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ইসলামী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অপারেশন, আবার কখনো বমপার্টির সাথে বন্দুকযুদ্ধের সাজানো নাটক মঞ্চায়ন, বমপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানার অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে জেনেও আক্রমণ না করে কৌশলে তাদেরকে রক্ষা করা ইত্যাদি ষড়যন্ত্র তো রয়েছেই। উপরন্তু বমপার্টির সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে সাধারণ বম গ্রামবাসীর উপর সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের ফলে বম জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন একেবারেই বিষিয়ে উঠেছে।