উদয়ন তঞ্চঙ্গ্যা
‘তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ’- এ ধরনের একতরফা অপপ্রচারে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্ব সরব রয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ দৈনিক মানবজমিনে ‘পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজির রাজত্ব’ শীর্ষক সংবাদে “বছরে এ তিন জেলায় শুধু চাঁদা তোলা হয় ৪০ কোটি ২৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা” বলে উল্লেখ করা হয়। উক্ত সংবাদে “বিভিন্ন খাত ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জুম্ম জাতীয় নেতার মৃত্যুদিবস, মাতৃভাষা দিবস, দলের কাউন্সিল, বিজু/সাংগ্রাই, পূজা, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, বৌদ্ধ বিহার/মন্দির, কঠিন চীবর দান ইত্যাদির নামে” চাঁদাবাজি হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
❝ বস্তুত এই চাঁদাবাজির সাথে আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদেরকে জড়িত করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অপপ্রচার চালানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্যই হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিহ্নিত করা এবং তাদের উপর দমন-পীড়নের বৈধতা প্রদান করা।❞
এটা বলার সুযোগ নেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নানাভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে না। তবে যে হিসেবে চাঁদাবাজি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল অপপ্রচার চালাচ্ছে তা প্রকৃত পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বস্তুত এই চাঁদাবাজির সাথে আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদেরকে জড়িত করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অপপ্রচার চালানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্যই হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ আন্দোলনরত সংগঠন ও কর্মীদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিহ্নিত করা এবং তাদের উপর দমন-পীড়নের বৈধতা প্রদান করা।
উল্লেখ্য যে, ‘…বিজু/সাংগ্রাই, পূজা, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, বৌদ্ধ বিহার/মন্দির, কঠিন চীবর দান ইত্যাদি’ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য জনগণের স্বেচ্ছায় দেয়া এককালীন অর্থ সাহায্যও চাঁদাবাজি হিসেবে আখ্যায়িত করছে যার অন্যতম লক্ষ্য হলো জুম্মদেরকে এসব সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনেও বাধা সৃষ্টি করা। তাছাড়া পাহাড়ে এসব ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান প্রধানত জনগণের স্বেচ্ছায় প্রদত্ত আর্থিক, কায়িক ও মানসিক সহযোগিতা দিয়েই সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। অথচ বিভিন্ন মসজিদ/মাদ্রাসার জন্য গাড়ি আটকিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে মাইক বাজিয়ে রাস্তা-ঘাটে চাঁদা তোলা হলেও তা চাঁদাবাজি হিসেবে গণ্য করতে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী বা প্রশাসনকে দেখা যায়নি।
আরো উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর চাঁদাবাজি নিয়ে সোচ্চার থাকলেও তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন দুর্নীতি, প্রকল্প আত্মসাৎ, টেন্ডারবাজি, বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্বৃত্তায়ন ও দলীয়করণ সম্পর্কে একেবারেই নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবুও টেন্ডারবাজি, প্রকল্প আত্মসাৎ, খাদ্যশস্য বাবদে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম, ছাত্রলীগ-যুবলীগের বেপরোয়া চাঁদাবাজি সংক্রান্ত সংবাদগুলো প্রচ্ছন্ন বাধা-নিষেধের মুখেও মাঝেমধ্যে পত্রিকায় চলে আসে।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সম্পদ গাছ-বাঁশ বাণিজ্যে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি, অনিয়ম ও লেনদেন হয়ে থাকে। যেহেতু এই অনিয়মে সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল জড়িত, তাই এ বিষয়ে একদিকে এসব রাষ্ট্রীয় বাহিনী, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও দল একেবারেই জেনেও না জানার ভান করে থাকে, অন্যদিকে হয়রানির ভয়ে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দুর্নীতি-বিরোধী সংগঠন ও কর্তৃপক্ষ, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজও সাহস করে না।
বনজ সম্পদ বাণিজ্যে ঘুষ ও চাঁদাবাজি:
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন সেগুন, গামার, কড়ই ইত্যাদি গাছের জোত পারমিট ইস্যু ও বনজ সম্পদ পরিবহনে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতি ও ঘুষের কারবার হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন বিভাগে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কেবল আর্থিক বিষয় সম্পর্কিত নয়, কর্তৃপক্ষের সকল বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্বৃত্তায়নের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত রয়েছে। তাই সরকারি অফিসে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, যা সাধারণত প্রকাশ্যে স্বীকৃত। সেই সাথে মূল্য সংযোজনী কর (ভ্যাট) যেভাবে ভোক্তারা দিতে বাধ্য, সেভাবে আরেকটা অনিয়ম, যাকে ব্যাপকভাবে ‘চাঁদাবাজি’ বলা হয়ে থাকে, তাও সরকারি অফিসে ও কর্তৃপক্ষের নিকট প্রদান করা তো বাধ্যতামূলক বটে, ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব ও তাদের সাথে সংযুক্ত সহযোগী সংগঠন, স্থানীয় বিভিন্ন গ্রুপগুলোকেও প্রদান করতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বনসম্পদ-সম্পর্কিত দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সাথে বন বিভাগ, প্রশাসন, বিজিবি, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সকল কর্তৃপক্ষ, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও তাদের সহযোগী সংগঠন থেকে শুরু করে স্থানীয় সশস্ত্র গ্রুপ জড়িত রয়েছে।
আর সেই ঘুষ-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি শুরু হয় গাছের জোত পারমিট প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু থেকে। যেহেতু তিন পার্বত্য জেলার বনজ সম্পদ বাণিজ্যে ঘুষ-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির প্রক্রিয়া প্রায় একই ধরনের, তাই উদাহরণ হিসেবে প্রধানত রাঙ্গামাটি জেলায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও ক্ষমতাসীন দলের সেই ঘুষ-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ডেপুটি কমিশনারের বরাবরে জোত মালিকের আবেদন পর জোত পারমিট অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)-এর কার্যালয় থেকে। চিঠি ইস্যু করার জন্য ডিসি অফিসের কেরানীকে ৫০০ টাকা প্রদানের মাধ্যমে বনজ সম্পদ বাণিজ্যে সরকারি অফিসে ঘুষ/চাঁদাবাজি শুরু হয়। এরপর উপজেলার ইউএনও, কানুনগো ও ভূমি অফিসের স্টাফ এবং সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যানের সমন্বয়ে প্রথমে বাগানের জায়গার দাগ ও হোল্ডিং সরেজমিন তদন্ত করা হয়। তাদের কাজ হচ্ছে দাগ ও হোল্ডিং নম্বর অনুসারে বাগানের জায়গার ছবি তুলে নিয়ে আসা, যাকে বলা হয় ’ছাড়মার্কা’। এ সময় এই ছাড়মার্কার জন্য প্রতি পারমিটের বরাবরে ইউএনও অফিসে ২০,০০০ থেকে ২২,০০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিটি পারমিটে ৫ থেকে ৭ হাজার ঘনফুট গাছের অনুমোদন দেয়া হয়। সে হিসেবে ইউএনও অফিসে প্রতি ঘনফুট গাছে গড়ে কমপক্ষে ৪ টাকা ঘুষ/চাঁদা প্রদান করতে হয়।
এর পর পারমিট অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলে যায় ডেপুটি কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে। ডিসি অফিসে ‘এলআর ফান্ড’ নামে ডিসিকে দিতে হয় প্রতি পারমিটের জন্য ৫,০০০ টাকা। এছাড়া ডিসি অফিসের কেরানীকে আলাদা করে দিতে হয় ৫০০ টাকা। তদনুসারে ডিসি অফিসে প্রতি ঘনফুট কমপক্ষে ১ টাকা ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
এরপর বন বিভাগের কার্যালয়ে চলে যায়। সেসময় বন বিভাগ থেকে বাগানের গাছগুলোর মধ্যে পরিপক্ক গাছগুলো চিহ্নিত করে ‘খাড়ামার্কা’ দেয়া (মার্কিং) এবং খাড়া অবস্থায় সেসব গাছগুলোর পরিমাপ (মেজারিং) করার জন্য অফিস অর্ডার দেয়া হয়। এ সময় খাড়ামার্কার জন্য চিঠি ইস্যু করা বাবদ বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কেরানীকে প্রথমে ৫০০ টাকা এবং তারপর মার্কিং ও মেজারিংয়ের জন্য গেলে সংশ্লিষ্ট ডিভিশনের রেঞ্জারকে প্রতি ঘনফুটে কমপক্ষে ৫ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
গাছের খাড়া মার্কার পর বিষয়টি চলে যায় এসিএফ (সহকারি বন সংরক্ষক)-এর অফিসে। সেখানে প্রতি ঘনফুট গাছের জন্য এসিএফ’কে ৩ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
এরপর কার্টিং অর্ডারের জন্য যাবে ডিএফও (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা)-এর অফিসে। সেখানে গাছ কাটিং অর্ডারের জন্য ডিএফও’কে প্রতি ঘনফুট গাছের জন্য ৫ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
গাছ কাটিং করার পর পরবর্তী কাজ হচ্ছে গাছের পাসমার্কা প্রদান করা। সরেজমিন তদন্ত করে গাছের পাসমার্কা প্রদানের জন্য এ সময় রেঞ্জারকে সেগুন গাছ হলে প্রতি ঘনফুট গাছের জন্য ২০ টাকা হারে এবং অন্যান্য গাছ হলে প্রতি ঘনফুট ১৫ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
পাসমার্কা দেয়ার পর পরবর্তী ধাপ হচ্ছে এসিএফ কর্তৃক কর্তিত গাছগুলোতে ঠিকমত পাসমার্কা দেয়া হয়েছে কিনা সরেজমিন চেক করা। এ বাবদে এসিএফ’কে আবার প্রতি ঘনফুট ৩ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
এরপর কর্তিত গাছ পরিবহনের জন্য ডিএফও অফিস থেকে ‘ডি’ ফর্ম অনুসারে লকবুক ইস্যু করা। এই লকবুকের জন্য ডিএফও’কে আবার প্রতি ঘনফুটে ৫ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
এরপর কাপ্তাই হ্রদের জলপথে পরিবহনের সময় বন বিভাগের প্রতিটি ঘাটে (চেকপোস্টে) প্রতি ঘনফুট গাছের জন্য ৬ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়। বরকল, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি- যেখান থেকে আনা হোক না কেন রাঙ্গামাটি সদর পর্যন্ত পরিবহন করতে বন বিভাগের অন্তত দু’টি চেকপোস্ট অতিক্রম করতে হয়। তাই ঘনফুট প্রতি দু’টি চেকপোস্টে মোট ১২ টাকা ঘুষ বা চাঁদা দিতে হয়।
রাঙ্গামাটিতে গাছগুলো স্টক করার পর সেখান থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়ক পথে পরিবহনের জন্য ‘সড়ক পরিবহন পাস’ (রোপ ট্রান্সপোর্ট পাস বা আরটিপি) নিতে হয়। সেসময় রেঞ্জার’কে ৩ টাকা এবং ডিএফও’কে ২ টাকা হারে প্রতি ঘনফুটে মোট ৫ টাকা হারে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়।
এরপর রাঙ্গামাটি জেলা সদর থেকে সড়ক পথে ঢাকায় নেয়ার পথে বন বিভাগ ও পুলিশের কমপক্ষে ৮টি চেকপোস্ট অতিক্রম করতে হয়। প্রতিটি চেকপোস্টে প্রতি গাড়ি বাবদ ৩,০০০ টাকা করে ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়। তদনুসারে প্রতিটি চেকপোস্টে ৩,০০০ টাকা করে ৮টি চেকপোস্ট বাবদে ২৪,০০০ টাকা ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়। প্রতিটি গাড়িতে গড়ে ৩৬০ ঘনফুট গাছ পরিবহন করা হলে সড়ক পথে গাড়ি ভাড়া ছাড়া কেবল ঘুষ/চাঁদা বাবদ খচর হয় প্রতি ঘনফুটে ৭০ টাকা। উল্লেখ্য যে, রাঙ্গামাটি থেকে ঢাকা পর্যন্ত উল্লেখিত ৮টি চেকপোস্ট ছাড়া ট্রাক সমিতি, স্থানীয় সরকার পরিষদ, বিভিন্ন স্থানীয় সমিতি, ক্ষমতাসীন দলের অন্তত দুই ডজন কর্তৃপক্ষকে চাঁদা দিয়ে হয়।
এছাড়া কাপ্তাই হ্রদের জলপথে পরিবহনের সময় বিজিবি ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্টেও এধরনের চাঁদা দিতে হয়। বরকল উপজেলা থেকে জলপথে রাঙ্গামাটি সদর পর্যন্ত ৩টি চেকপোস্ট যথাক্রমে ছোট হরিনা বিজিবি জোন, বরকল সদর বিজিবি জোন ও সুবলং সেনা ক্যাম্পের চেকপোস্ট রয়েছে। সূত্র মতে, ছোট হরিনা বিজিবি জোনকে কাঠ বোঝাই প্রতি বোটের জন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা, বরকল জোনকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা এবং সুবলং সেনা ক্যাম্পকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়। অধিকন্তু নানা অজুহাতে বরকল ও ছোট হরিনা বিজিবি জোনে প্রতি বোট থেকে ৩০/৪০ লক গাছ তুলে রাখা হয়।
তদনুসারে উক্ত ৩টি চেকপোস্টে প্রতিটি কাঠ বোঝাই বোটের জন্য গড়ে ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়। প্রতিটি বোটে গড়ে ২,০০০ ঘনফুট গাছ পরিবহন করা হলে প্রতি ঘনফুট গাছ বাবদে সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে গড়ে প্রায় ৫৫ টাকা ঘুষ/চাঁদা দিতে হয়। এই ঘুষ লেনদেনে বিজিবির মধ্যস্থতাকারী দালাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেটেলার বাঙালিদের। সেই দালাল সেটেলার বাঙালিরাও একটা মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়।
পূর্বে গাছের পারমিট দেয়ার প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা ছিল। সেসময় পারমিট প্রদানে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প/সাব-জোন/জোন কম্যান্ডাররাও একটা মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিতেন। কিন্তু পরবর্তীতে এর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় পারমিট প্রদানের প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা বিলুপ্ত করা হয়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় বনজ সম্পদ বাণিজ্যে পারমিট অনুমোদন, মেজারিং, কাটিং ও পরিবহন প্রক্রিয়ায় ঘুষ/চাঁদা লেনদেনের পরিমান একনজরে নিম্নের সারণীতে দেয়া গেল:
ক্রমিক | অফিস/কর্তৃপক্ষ | ঘুষের পরিমাণ (টাকা) |
১ | ডিসি অফিসের কেরানী | ৫০০ টাকা (চিঠি ইস্যু) |
২ | ইউএনও অফিস | ৪ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
৩ | ডিসি অফিস | ১ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
৪ | বন বিভাগের অফিসের কেরানী | ৫০০ টাকা (চিঠি ইস্যু) |
৫ | রেঞ্জার (খাড়া মার্কার জন্য) | ৫ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
৬ | এসিএফ | ৩ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
৭ | ডিএফও (কাটিং অর্ডারের জন্য) | ৫ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
৮ | রেঞ্জার (পাসমার্কার জন্য) | ২০ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
৯ | এসিএফ (পাসমার্কা চেক করা) | ৩ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
১০ | ডিএফও (‘ডি’ ফর্ম) | ৫ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
১১ | বরকল, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ওবিলাইছড়ি থেকে রাঙ্গামাটির পথেদু’টি চেকপোষ্টে প্রতি চেকপোষ্টে প্রতিঘনফুট ৬ টাকা হারে) | ১২ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
১২ |
আরটিপি বাবদ রাঙ্গামাটি অফিসে (রেঞ্জারকে ৩ টাকা ওডিএফও’কে ২ টাকা)
|
৫ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
১৩ | রাঙ্গামাটি থেকে ঢাকা ৮টি চেকপোষ্ট | ৭০ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
১৪ | ছোট হরিনা ও বরকল বিজিবি জোনএবং সুবলং ক্যাম্প | ৫৫ টাকা (প্রতি ঘনফুট) |
মোট | মোট ঘুষ/চাঁদা বাবদ খরচ | ১৮৮ টাকা (প্রতি ঘনফুটে খরচ) |
জানা যায় যে, পূর্বে প্রতিটি পারমিটের পেছনে ১৬ থেকে ১৮ হাজার ঘনফুট গাছের অনুমোদন দেয়া হতো। বর্তমানে প্রতি পারমিটে ৫ থেকে ৭ হাজার ঘনফুট গাছের অনুমোদন দেয়া হয় বলে জানা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বন বিভাগের চারটি ডিভিশন রয়েছে। পূর্বে প্রত্যেক ডিভিশন থেকে প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৭০ লাখ ঘনফুট গাছের পারমিট দেয়া হতো বা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অন্য জেলায় নেয়া হতো। বর্তমানে গাছ কমে যাওয়ায় প্রতিটি ডিভিশনে প্রতি মাসে গড়ে ৫ লক্ষ ঘনফুট গাছের পারমিট দেয়া হয় বা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অন্য জেলায় নেয়া হয়।
【পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ বন বিভাগের ৪টি ডিভিশন থেকে এক বছরে ২ কোটি ৪০ লক্ষ ঘনফুট গাছ পাচার করা হয়। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় প্রতি ঘনফুট গাছের পেছনে ১৮৮ টাকা ঘুষ দিলে বছরে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫১ কোটি ১২ লক্ষ টাকা।】
তদনুসারে প্রতি মাসে প্রত্যেক ডিভিশন থেকে গড়ে ৫ লক্ষ ঘনফুট গাছের পারমিট দেয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ বন বিভাগের ৪টি ডিভিশন থেকে এক বছরে ২ কোটি ৪০ লক্ষ ঘনফুট গাছ পাচার করা হয়। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় প্রতি ঘনফুট গাছের পেছনে ১৮৮ টাকা ঘুষ দিলে বছরে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫১ কোটি ১২ লক্ষ টাকা। এই ঘুষ/চাঁদাবাজির হিসাব কেবল গাছ ব্যবসার ক্ষেত্রে। এছাড়া আরো রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ বাঁশ আহরন ও ব্যবসার পেছনে লক্ষ কোটি টাকার ঘুষ/চাঁদাবাজি।
রাঙ্গামাটি জেলা থেকে খাগড়াছড়ি জেলায় বনজ সম্পদ বাণিজ্যে ঘুষ/চাঁদার পরিমাণ আরো বেশি। খাগড়াছড়ি জেলায় জোট পারমিটের জন্য আবেদন করার পর থেকে তদন্তের জন্য চিঠি ইস্যু বাবদ ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে ২,০০০ টাকা প্রদানের মাধ্যমে ঘুষ/চাঁদা শুরু হয়। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা/পানছড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়ক পথে কাঠ পরিবহনের সময় সরকারি অফিস ও কর্তৃপক্ষসহ ট্রাক সমিতি, স্থানীয় সরকার পরিষদ, বিভিন্ন স্থানীয় সমিতি, ক্ষমতাসীন দল ইত্যাদি ২৬টি কর্তৃপক্ষকে ঘুষ/চাঁদা দিয়ে হয়। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বনজ সম্পদ বাণিজ্যে পারমিট অনুমোদন, মেজারিং, কাটিং ও পরিবহন বাবদে ঘুষ/চাঁদা লেনদেনের পরিমাণ একনজরে নিম্নের সারণীতে দেয়া গেল-
ক্রমিক | খাত | বিবরণী |
১ | খাড়া মার্কা | ৭,০০০ ঘনফুট X ৫ টাকা |
২ | পাস মার্কা | ৭,০০০ ঘনফুট X ২৩ টাকা |
৩ | কাটিং অর্ডার | ৭,০০০ ঘনফুট X ১৭ টাকা |
৪ | ডিএফও অফিস | ৭,০০০ ঘনফুট X ৫ টাকা |
৫ | এসিএফ অফিস | ৭,০০০ ঘনফুট X ৭ টাকা |
৬ | ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, হেডম্যান অফিসে তদন্ত ও ফিল্ডভিজিট, খাদ্য ইত্যাদি বাবদ প্রতি পারমিট পিছু সর্বমোট ১৬২,০০০ টাকা কিংবা গড়ে প্রতি ঘনফুট গাছে ২৩ টাকা খরচহয় (প্রতি পারমিটে ৭০০০ ঘনফুট গাছের অনুমোদন দেয়া হয়)। | |
৭ | খাগড়াছড়ির দীঘিনালা/পানছড়ি থেকে ধুমঘাট ফরেস্টার ফাঁড়িপর্যন্ত ২৬টি সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে প্রতি গাড়ি বাবদ সর্বমোট ৬৬,০৫০ টাকা কিংবা গড়ে প্রতি ঘনফুট গাছে ১৮৩টাকা খরচ পড়ে (প্রতি ট্রাকে গড়ে ৩৬০ ঘনফুট গাছ বহন করা হয়)। | |
৮ | উপরেল্লেখিত তথ্য অনুসারে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রতি ঘনফুটগাছে ঘুষ/চাঁদা বাবদ খরচ হয় ২৬৩ টাকা। |
উক্ত সারণীর হিসাব অনুসারে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় পরিবহন খরচ বাদে গাছের পারমিট অনুমোদন, মেজারিং, কাটিং ও পরিবহনে খাগড়াছড়ি জেলায় সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষ বাবদে প্রতি ঘনফুট গাছে ঘুষ/চাঁদা হিসেবে খরচ হয় ২৬৩ টাকা, যা রাঙ্গামাটি জেলার তুলনায় প্রায় দেড়গুণ।
উল্লেখ্য যে, ঘুষ বা চাঁদা নেয়ার এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে গাছের পারমিট অনুমোদন, মেজারিং, মার্কিং, কাটিং, পরিবহন, পুন:ছাড়পত্র ইত্যাদি চক্রাকার প্রক্রিয়ায় ডিএফও তিনবার (প্রতি ঘনফুট যথাক্রমে কাটিং অর্ডারের জন্য ৫ টাকা, ডি ফর্মের জন্য ৫ টাকাও আরটিপির ২ টাকা করে সর্বমোট ১২ টাকা) এবং রেঞ্জার দুইবার (প্রতি ঘনফুট যথাক্রমে ২০ টাকা পাসমার্কার জন্য ও ৩ টাকা আরটিপির সর্বমোট ২৩ টাকা) ঘুষ বা চাঁদা নিয়ে থাকেন। তাই রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় গাছের পরিবহন খরচ বাদে কেবল সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোকে ঘুষ ও চাঁদা প্রদান করতেই প্রতি ঘটনফুট গাছে খরচ হয় ১৮৮ টাকা।
আঞ্চলিক দল থেকে একটা গাছের একবার পাস নিলেই সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরলেও সেই দলকে উক্ত গাছের জন্য দ্বিতীয়বার কোন চাঁদা দিতে হয় না। অথচ সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোকে গাছের দলিলাদি এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে স্থানান্তর হলে, গাছ কাটার পূর্বে ও পরে মেজারিং ও মার্কিংয়ের প্রতিটি ধাপে, গাছ পরিবহনের সময় প্রতিটি ঘাটে ও চেকপোস্টে দফায় দফায় চাঁদা দিতে হয়। বলা যায়- খেয়ে থাকেন ফকির বাবাজি, নাম হয় চোর বাবাজির। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে এধরনের মধুমাখা চাঁদাচক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিজিবি, ডিজিএফআই থেকে শুরু করে প্রশাসনের আমলা ও ক্ষমতাসীনরা কোন দু:খে সোচ্চার হবে?
সেজন্যই বন বিভাগ, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সেনাবাহিনী-বিজিবির এত বিপুল পরিমাণ ঘুষ বা চাঁদাবাজির বিষয়ে কোন কর্তৃপক্ষই কোন উচ্চবাহ্য করে না। অথচ বনজ সম্পদ ব্যবসা-বাণিজ্যে সেনাবাহিনী, বিজিবি, আমলা, ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব নিজেরাই প্রায় সাড়ে চারশ’ কোটির ঘুষ ও চাঁদাবাজি করে চলেছে, কিন্তু গলা ফাটিয়ে কামান দেগে চলেছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মাত্র ৪০ কোটি টাকার (দৈনিক মানবজমিনের মতে) চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। এটাই বলে- ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’
জোত বাগানের নামে পারমিট দেয়া হলেও মূলত উক্ত পারমিটের দোহাই দিয়ে বন বিভাগ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যোগসাজসে সরকারি রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে অধিকাংশ গাছ আহরণ ও পাচার করা হয়। এছাড়া স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক সংঘবদ্ধভাবে বনজ সম্পদ লুণ্ঠন এবং বিগত ৬০ বছর ধরে কর্ণফুলী পেপার মিল কর্তৃক বাঁশ আহরণের বিষয়টি তো রয়েছেই। সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের এধরনের নজীবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ সম্পদ দ্রুত উজার হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীব-বৈচিত্র্য দ্রুত নষ্ট হয়ে পড়ছে। জলের উৎস থেকে গাছ-বাঁশ উজার, ব্যাপকভাবে পাথর উত্তোলন ও পাহাড় কাটার ফলে ছড়া, ঝিড়ি, ঝর্ণা শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। অথচ জুম্ম জনগণের জুম চাষ, বন্য পশু-পক্ষী শিকার, গাছ-বাঁশ কর্তনের অভিযোগ এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ সম্পদ উজার ও জীব-বৈচিত্র্যতা নষ্টের দায় চাপানো হচ্ছে আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর।
আরো চলবে….