হিল ভয়েস, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গতকাল (২৩ এপ্রিল) দুপুরে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি অবশেষে খারিজের আদেশ দিয়েছেন। পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অপহৃত কল্পনার কোনো হদিশ প্রদান ও অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যর্থতা নিয়ে এবং প্রতিবেদনটির উপর বাদীর নারাজি আবেদন নামঞ্জুর করেই আদালত এই মামলাটি অবসানের আদেশ দেন।
প্রায় দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মামলাটি চলার পরও রাঙ্গামাটির প্রশাসন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক অপহৃত কল্পনার হদিশ দিতে না পারা এবং অভিযুক্ত চিহ্নিত সেনাবাহিনীর লেঃ ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদকে গ্রেপ্তার করে যথাযথ বিচার করার ব্যর্থতা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান বিচারহীনতার এক চরম দৃষ্টান্ত বৈ কিছু নয়।
উক্ত আদেশের মাধ্যমে কল্পনা চাকমা অপহৃত হলেও কে বা কারা অপহরণ করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনটি আদালত মেনে নিয়েছে। ফলে এই রায়ের মাধ্যমে অভিযুক্ত লেঃ ফেরদৌস সহ অন্যান্য অপহরণকারীদের দায়মুক্তি ঘটেছে। এমনকি আদালত মামলাটির বিচারকার্যও অবসান করে দিয়েছে।
তবে, মামলাটির বাদী ও অপহৃত কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও মামলার অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট জুয়েল চাকমা ‘আদেশটি দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করে তারা ন্যায়বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
গতকাল আদালতে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমার পক্ষে শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান, অ্যাডভোকেট রাজীব চাকমা ও অ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ভোররাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে নির্মমভাবে অপহরণের শিকার হন। কল্পনার বড় ভাইয়েরা (কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমা) স্পষ্টতই টর্চের আলোতে অপহরণকারীদের মধ্যে তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস (সম্পূর্ণ নাম মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি’র প্লাটুন কম্যান্ডার মো: নূরুল হক ও সদস্য মো: সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন বলে জানান।
১২ জুন ভোর হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কল্পনার খোঁজখবর নিয়েও কোন হদিশ না পাওয়ায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ির টিএনও (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট বিষয়টি অবহিত করেন। বাঘাইছড়ি টিএনওর কাছে বর্ণিত বিবরণই বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং থানায় তা মামলা নং ২, তারিখ ১২/০৬/৯৬ ধারা ৩৬৪ দ: বি: হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
অপহরণ ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হয়, যাতে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চুড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ আদালত বাদীর দাখিলকৃত নারাজির উপর শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পুনরায় সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ জনৈক তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চট্টগ্রাম জোন সিআইডির পক্ষ থেকে চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্টেও অপহৃত কল্পনার কোন হদিশ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় এবং অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা লেঃ ফেরদৌসসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখান করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। পরে গত ২০ জুলাই ২০১৪ রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার উপর রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। এই তদন্তেও কোনো কিছুই অগ্রগতি মেলেনি।
এর দুই বছর পর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। তাঁর রিপোর্টেও পূর্বের রিপোর্টের বক্তব্যগুলো চর্বিতচর্বন করে প্রকৃত পক্ষে দোষীদের ও অভিযুক্তদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয় এবং ‘…সার্বিক তদন্তে লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি নূরুল হক ও পি.সি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে দাবি করা হয়। এমনকি রিপোর্টে ‘কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়’ বলে স্বীকার করা হলেও ‘দীর্ঘ ২০ বৎসর ৩৯ জন তদন্তকারী অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমাকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ’ বলে দায়িত্বহীন ও হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য প্রদান করা হয়।
 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
             
             
                             
                             
                             
                                                     
                                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        