বান্দরবানে চিকিৎসা সেবার নামে জুম্মদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করছেন ডা: ইউসুফ আলী!

0
1847
নিজের চেম্বারে ডা: ইউসুফ আলী ও অন্যান্যরা

হিল ভয়েস, ১৬ জুন ২০২১, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নামে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ডা: ইউসুফ আলী দরিদ্র জুম্মদের সুকৌশলে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আবারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, এর পূর্বেও হিল ভয়েসের একাধিক রিপোর্টে বান্দরবানে আদিবাসী জুম্মদের দারিদ্র্যতা, অর্থনৈতিক সুবিধা ও শিশুদের শিক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন জুম্ম পরিবার ও শিশুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্রের সাথে এই ডা: ইউসুফ আলীর শুধু জড়িত থাকার কথা নয়, এই ধর্মান্তরকরণে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলেও উঠে এসেছে।

চিকিৎসক ইউসুফ আলী বর্তমানে কক্সবাজারের বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকায় থাকেন এবং ঈদগাঁও বাজারস্থ মড়েল হাসপাতাল এন্ড ডায়াবেটিস কেয়ার সেন্টারে কাজ করেন বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ডা: ইউসুফ আলী এই ধর্মান্তরকরণের কাজে বিশেষভাবে ব্যবহার করছেন ইব্রাহিম ত্রিপুরা ও সাইফুল ইসলাম ত্রিপুরা নামের দুই ব্যক্তিকে। তিনি প্রথমে ইব্রাহিম ত্রিপুরা ও সাইফুল ইসলাম ত্রিপুরাকে আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে এদের মাধ্যমে গ্রামের গরীব ও হতদরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হবে বলে কক্সবাজারের ঈদগাঁ মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে আসেন। এরপর ভালো চিকিৎসার কথা বলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেন।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, অতিসম্প্রতি বান্দরবান থেকে একজন মুমূর্ষু রোগী ডা: ইউসুফ আলীর কাছে নিয়ে আসলে তিনি রোগীকে উন্নত চিকিৎসা পেতে হলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে বলে জানান। পরে ওই রোগীটিকে একপ্রকার জোর করে রাজি করিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। পরে ডা: ইউসুফ আলী ওই রোগীর হাতে ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ আল-কোরআন তুলে দেন।

ডা: ইউসুফ আলী বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকার বিশেষ করে ত্রিপুরা ও ম্রো জনগোষ্ঠীর লোকদের চিকিৎসা সেবার প্রলোভন দেখিয়ে কক্সবাজার ঈদগাঁ মডেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে আদিবাসী জুম্মদের একের পর এক ধর্মান্তরিত করে চলছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ডা: ইউসুফ আলী পাহাড়ি কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন ভালো স্কুলে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করার নাম করে পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে যান। কিন্তু পরে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। এরপর ধীরে ধীরে শিশুদের ইসলাম ধর্মীয় আচরণ ও ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়।

একটি সূত্রের মতে, বান্দরবান পৌরসভা, আলিকদম, রোয়াংছড়ি, লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টির অধিক জুম্ম মুসলিম পাড়া বা বসতি রয়েছে। এইসব ধর্মান্তরিত জুম্ম মুসলিমদের বলা হচ্ছে ‘নও মুসলিম’ বা ‘উপজাতি মুসলিম’। এই ধর্মান্তরিত মুসলিম বসতিগুলোকে ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করে এবং কিছু বাছাইকৃত নও মুসলিমকে সুবিধা দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ধর্মান্তরের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে।

গতবছরের জুন মাসে হিল ভয়েসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বান্দরবানের আলিকদম উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খান, ডাঃ ইউসুফ আলী, হাফেজ মাওলানা সালামাতুল্লাহ, আলিকদম সদরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদ আহম্মদ, আলিকদম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম, মোঃ জাহিদ, সাহাব উদ্দিন, মাওলানা ইমরান হাবিবি, মোহাম্মদ আইয়ুবপ্রমুখ এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ ও বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। অপরদিকে আদিবাসী থেকে ধর্মান্তরিত যেসব নও মুসলিম এসব ধর্মান্তরকরণের সাথে জড়িত তাদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হল-জনৈক চাকমা ধর্মান্তরিত মুসলিম মোঃ শহিদ, উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘের সহ-সভাপতি মৌলভী হেলাল উদ্দিন ত্রিপুরা, উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘের সম্পাদক ধর্মান্তরিত মুসলিম ইব্রাহিম ত্রিপুরা, মুসলিম পাড়া মডেল একাডেমির শিক্ষক ধর্মান্তরিত মুসলিম সাইফুল ইসলাম ত্রিপুরা, আবু বক্কর ছিদ্দিক (পূর্ব নাম অতিরম ত্রিপুরা),খাগড়াছড়ির মোঃ আব্দুর রহিম (পূর্ব নাম ভিনসেন্ট চাকমা), মোঃ আব্দুর রহমান (পূর্ব নাম ভন্দ চাকমা), মোঃ ইব্রাহিম (পূর্ব নাম ভবাৎ চাকমা) প্রমুখ।

ঐ রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় সূত্র ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, আলিকদমসহ বান্দরবানে আদিবাসী জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের সাথে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে সক্রিয় ও তৎপর হিসেবে দেখা গেছে ডা: ইউসুফ আলী নামে এক বহিরাগত চিকিৎসক ও আলিকদম উপজেলা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খানকে। তারা আদিবাসীদের অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং গরীব-অশিক্ষিত আদিবাসীদের ধর্মান্তরের জন্য এফিড্যাভিটসহ আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাঃ ইউসুফ আলীর গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়, তবে বর্তমানে কক্সবাজারে থাকেন। সেখানে ঈদগাহ মডেল হসপিটাল ও ডায়াবেটিস কেয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবাসিক সার্জন হিসেবে দায়িত্বে আছেন। জানা গেছে, তিনি অত্যন্ত সুক্ষভাবে ও সুকৌশলে বান্দরবানের আলিকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে আদিবাসী জুম্মদের ধর্মান্তরিতকরণে সক্রিয়ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা, বুদ্ধি-পরামর্শ ও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, তিনি যেহেতু নিজে একজন চিকিৎসক এবং আর্থিকভাবে সমর্থ, সেকারণে অনেক সময় বিনা পয়সায় চিকিৎসার নামে অথবা কিছু আর্থিক সহযোগিতার নামেও আদিবাসীদের ধর্মান্তরিতকরণ করছেন।

গত ২৮ মে ২০২০ তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আমাদের এক প্রিয় নওমুসলিমা পারভীন ত্রিপুরা। মানিকগঞ্জের এক মহিলা মাদ্রাসায় পড়ত। মা ও বর্তমান বাবা নও মুসলিম। সে মাদ্রাসায় পড়ালেখার কারণে তার তাকওয়া ছিল প্রশংসনীয়। বাবা-মা মুসলিম হলেও ইসলামি সংস্কৃতির চেয়ে ত্রিপুরা সংস্কৃতিকে প্রাধান্য বেশি দেয়।…তাকে একবার ছুটিতে এনে আর মাদ্রাসায় যেতে দেয়না। সে যেন বাইরে যেতে না পারে এজন্য তার বোরখাটা পুড়ে ফেলে বাবা। তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। সে শর্ত দেয় পাত্রকে হাফেজ ও আলেম হতে হবে। কিন্তু তারা এক ছেলের সাথে তার অমতে বিয়ে ঠিক করে। সে বুঝতে পারে তার ইসলামের উপর চলা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সে তার বান্ধবীর সাথে কথা বলে রাখে। ফজরের আগে উঠে বান্ধবীর বোরখা নিয়ে পালায়।… রাতে খবর পাই সে মাদ্রাসায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমরা আশ্বস্ত হই। সে আর বাড়িতে আসেনা।’

ডা: ইউসুফ আলী পরে এই পারভীন ত্রিপুরার সাথেই কক্সবাজারের ঈদগাহ কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা সালামাতুল্লাহ’র বিয়ের ব্যবস্থা করেন।