একুশের চেতনা প্রতিফলিত হোক পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে

0
784

সুমন মারমা

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সকল জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতির অস্তিত্বকে স্বীকার করার চেতনাবোধ থেকে। কিন্তু স্বাধীনতার পর হয়েছে ভিন্ন। স্বাধীনতা উত্তর সেই চেতনাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এক জাতি এক দেশ বাঙালির দেশ বাংলাদেশ। দেশের পথ চলা শুরু হয়েছে নানা জাতিগত-ভাষার বিষয় নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে সংবিধান রচিত হয়। সেই সংবিধানে প্রথম বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়। শোষণের হাত প্রশস্ত হওয়া শুরু করা হয়। বাংলাদেশে বাঙালি বাদে অন্য আরও ৫৪ টির অধিক জাতির বাস রয়েছে এদেশে। কিন্তু তাদের আদৌ স্বীকার করেনি এই বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র। তাহলে একুশের চেতনা রক্ষা করতে পারল কি রাষ্ট্র?

বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ। হাজারও তরুণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আত্মবলিদান দেবার ব্রতী হয়। প্রকৃত অর্থে, একটি জাতি বেঁচে থাকে তার ভাষার মধ্য দিয়ে। কিন্তু যখন সে ভাষাটি রাষ্টযন্ত্র দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয় তখন বিদ্রোহ হবার দেরি হয় না। হ্যাঁ, বিদ্রোহ। স্বাভাবিকভাবে নিজের মাতৃভাষা যখন খর্ব হতে থাকে তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ভাষার প্রতিধ্বনি। তাজা রক্তের হৃদয় কম্পনে কম্পিত হতে থাকে বিদ্রোহের মাঠ। তাই তো রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও ঠাঁয় না দেবার প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র কোন কালে-স্থানে নমনীয় হয়নি। তাইতো গর্জে ওঠে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার কন্ঠ।

সেদিন আত্মবলিদান দেয়া হলো ভাষাকে রক্ষা করার জন্য। শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকতসহ অগণিত তরুণ। তার পাশাপাশি মিলিত কন্ঠস্বর জ্বলে উঠল জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে। এটাই ইতিহাস। ভাষাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের ইতিহাস। সেদিন যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে দু’একজন বেঁচে আছেন। তাদের ভাষ্যমতে, সেদিন শুধু বাংলার জন্য নয়, বরং প্রতিটা মানুষের যে ভাষার অধিকার রয়েছে সে বক্তব্যটি সেদিন জোরালো হয়ে উঠেছিল।

এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে হয়, বাংলাদেশে বাঙালির বাইরে আরও অনেক জাতি বাস করে। যাদের আইএলওর সংজ্ঞানুসারে ‘আদিবাসী’ বলা হয়। পাহাড়ে ভিন্ন ভাষাভাষি ১৪টি জুম্ম জাতি বাস করে। তারাসহ বাংলাদেশে ৫৪ টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে। যাদের রয়েছে স্বতন্ত্র পরিচয়, সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্য। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী সেসকল ভাষার মানুষকে দমিয়ে রেখে শোষণ করছে যুগের পর যুগ।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর। যে জাতি ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিল সে জাতি কিভাবে আরেক জাতির ভাষাকে ভক্ষণ করে।

আমি আজকে বাংলায় লেখা লিখছি। কথাও বলছি। কারণ আমি আরেকটা ভাষাকে সম্মান দিয়েছি। কিন্তু আমার ভাষাকে কেন বাঙালিরা সম্মান জানায় না?

আজকের ভাষার মাস পূর্বের তুলনায় বহু ভিন্ন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ জেগে ওঠেছে। সোচ্চার হচ্ছে ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে। দমিয়ে রাখা যাবে না আর। মানুষের মগজে রাজনৈতিক চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। ভাষার জন্য লড়াই করতে এবং জীবন দিতে প্রস্তুত মানুষ।

আদিবাসীরা লেখালেখি করছে। বাংলার পাশাপাশি নিজের ভাষাকে বিকাশ করছে। তরুণদের চেতনায় ভাষা রক্ষার প্রতিজ্ঞা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একটাই সমস্যা। তা হলো আমাদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চার হার হ্রাস পেয়েছে।

অনেকের মধ্যে দেখা যায় ভাষাকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করা। কথায় কথায় বাংলা শব্দের ব্যবহার মাধুর্যতা দেখানোর প্রতিযোগিতা হয় পাহাড়ে এবং সমতল আদিবাসীদের মধ্যে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের মধ্যে পরের ভাষা অপচর্চা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে অন্যান্যা ভাষাভাষিদের ক্ষেত্রে তা অনেকাংশ কম। সাধুবাদ জানাতে হয় গ্রামীণ অঞ্চলের সাধারণ নর-নারীদের। তারা এখনও নিজেদের ভাষাকে শুদ্ধ করে চর্চা করে চলেছেন। আমরা অনেক সময় তাদের (গ্রামীণ নর-নারী) ঠাট্টা-তামাশা করে প্রকৃত ভাষা যারা চর্চা করে না তাদের মুখোমুখি করি। এটা ঠিক না। বাজারে বা কোন দুর্গম পাহাড়ে গেলে নিজেদের শহুরে দাবি করে গ্রামীণ মানুষের কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠতরভাবে উপস্থাপন করি। যা মূর্খতা বললে ভুল হবে না। ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটি আসলে নানা আয়োজন করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি মাতৃভাষা চর্চা করছি কি? বন্ধু-বান্ধব আর পাড়া-প্রতিবেশির কাছে আমি সবার সেরা দাবি করতে গিয়ে অজান্তে নিজের ভাষার সাথে প্রতারণা করেছি। তা কিন্তু চলতে দেয়া যায় না।

চাকমা ভাষায় টয়লেটকে ‘আগোনিছাল’ বলা হয়। অনেকেই তা ‘ওয়াশরুম্মো হুনদি?’ (ওয়াশরুম কোনদিকে?) বলি। বলা উচিত হলো, ‘আগোনিছালান হুনদি’? শহরে গেলে অনেকেই পথে-ঘাটে বা গাড়িতে-ট্রেনে মাতৃভাষায় কথা বলতে শরম পান। তাছাড়া বাঙালিরাও কেমন যেন প্রতিক্রিয়া দেখায় বাংলার বাইরে অন্য ভাষা দিয়ে কথা বললে। তাহলে কি একুশের চেতনা ডুবে যাচ্ছে? যাচ্ছে বললেও চেতনাধারীরা নিছক বেজার পাবে। আর যায়নি বললেও অসত্য বলা হবে।

আমাদের সবচে বড় যে জাত তার ভাষা অন্য জাতের ভাষাকে প্রভাবিত করে। এজন্য মূলত সরকারকে আইন করে তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু তা করেনি সরকার। শুধু সমাবেশ, সেমিনার এবং বক্তব্যে দৃঢ় থেকেছেন তারা। তবে এযাবতকালে সরকার যেটি উদ্যোগ নিয়েছে নিশ্চয় ভাল উদ্যোগ। কিন্তু তা এমনি এমনি হয়নি। এক যুগের বেশি হলো আন্দোলন হচ্ছে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষাদান করানোর জন্য। সরকার করবে করবে বলে যাচ্ছে। অবশেষে চাকমা, মারমা, ককবরক, গারো এবং সাঁদ্রী ভাষায় প্রাথমিকে শিক্ষা দেয়ার কথা বলেছে। তাও ওলোনসালের উপরে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছ সরকার। সেখানেই আলোর মুখ দেখতে পেল না মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কর্মসূচি।

বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ অন্য মানুষের ভাষাকে সম্মান দেখায় না। আজকে যদি সম্মান দেখাতো তাহলে বাঙালির মধ্যে এত বড় বিতর্ক বা তাচ্ছিল্য করার ঘটনা ঘটতো নয়। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই এখনও আদিবাসীদের ভাষাকে সম্মান দেখায় না। দেখায় না বলেই আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেবার বিপরীতে অবস্থান করে। একুশের চেতনা সেদিন মর্যাদাপূর্ণ হবে যেদিন আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে।

পার্বত্য চুক্তিতে স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের কথা উল্লেখ আছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৩৩ নম্বর ধারায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা, মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষার কথা উল্লেখ আছে। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে একুশের চেতনা ধূলোয় মিশে না যাক, তাহলে উদ্যোগ নিতে পারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করার। তাহলে বলা যেতে পারে শহীদদের রক্ত আসলেই বৃথা যায়নি। অন্যথায় একুশ হবে শুধু বাঙালির একুশ।