বান্দরবান শহরে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মগপার্টির সশস্ত্র গ্রুপের রাতযাপনে ক্যশৈহ্লার উদ্বেগ

0
3676

হিল ভয়েস, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, বান্দরবান: বান্দরবান জেলা শহরের উজানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ মগপার্টির সশস্ত্র গ্রুপের রাতযাপন করায় এক জরুরী সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের বান্দরবান জেলা সভাপতি ক্যশৈহ্লা মারমা। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র মগপার্টি সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব এবং বান্দরবান শহরে অবস্থানের কথা স্বীকার করলেন।

গতকাল মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১:০০ টায় বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কক্ষে তিনি এই সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করেন। এতে বান্দরবানের সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে উজানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চিংম্যায়ি মারমাও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রধান শিক্ষিকা জানান যে, “১৮ সেপ্টেম্বর স্কুলভিত্তিক বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য আমি বান্দরবান স্টেডিয়ামে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অবস্থান করি। এই সময় আমার স্কুলের পিয়ন আমাকে ফোন করে জানান স্কুলের মধ্যে অস্ত্রধারী কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ এসেছে। তাদের কাছে বিভিন্ন ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে। যাতে আমি জরুরিভাবেই স্কুলে আসি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি স্কুলে গেলে সন্ত্রাসী গ্রুপ আমাকে জানান যে, একটি রাতের জন্য তারা উজানী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশ্রাম করবে। তখন আমি ভীত সন্তপ্ত হয়ে তাদেরকে সেখানে অবস্থান করতে দিই এবং পরদিন ভোরবেলা তারা স্কুল থেকে চলে যান।”

সাংবাদিক সম্মেলনে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা জানান, “১৮ সেপ্টেম্বর রবিবার মগপার্টির অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ বিকাল ৩:০০ টা থেকে ৪:০০ টার দিকে বান্দরবান জেলা শহরের উজানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করে। আর সন্ত্রাসী গ্রুপের এই অবস্থানকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকার মাঝে।” বান্দরবানবাসী তথা সকল সচেতন মহলকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য তিনি আন্তরিক আহ্বান জানান।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি তখন ঢাকায় যাচ্ছিলাম, তখন কুমিল্লায় পার হচ্ছিলাম, তখন বিকাল ৫:০০ টার দিকে প্রথম বান্দরবান পৌরসভার মেয়র জানিয়েছিলেন যে, বান্দরবান সদরের উজানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ অবস্থান করছে। এরপর রোয়াংছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমাকে জানাই। এরপর সত্যতা যাচাই করেছি। আমি খবর পাওয়ার পর সাথে সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই। তবে বান্দরবান জেলার এসপি সাহেবকে ফোন করেও তাকে পাইনি। আমি যখন ঢাকায় পৌঁছি তখন এসপি সাহেব নিজেই আমার সাথে যোগাযোগ করেন।”

তিনি তখন এসপি সাহেবকে জানান, “শহরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী অবস্থান করা খুবই ন্যাক্কারজনক, ভয়ংকর। এই এলাকার নিরাপত্তায় যারা আছে তারা তো দেখার বিষয়। এরপর এসপি সাহেব ‘দেখতেছি’ বলে আমাকে জানান। সবাই বলে এরা হচ্ছে মগপার্টি।”

তিনি সাংবাদিকদে বলেন, “আমি এসপি সাহেব জানাই, উজানি পাড়া হল শহরের একেবারে নাভিতে। স্কুলটি হল একেবারে পাড়ার ভিতরে। এখানে সশস্ত্র গ্রুপ আসা, তাছাড়া একটা স্কুলে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলে আসা খুব ন্যাক্কারজনক, খুব দুঃখজনক। শুধু ন্যাক্কারজনক নয়, ভয়ঙ্কর, কঠিন।”

সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে, আপনি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, আর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের বান্দরবান জেলা সভাপতি, আপনি কি বান্দরবানে শহরে এধরনের সশস্ত্র গ্রুপের অবস্থানের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন কিনা?

সাংবাদিক সম্মেলনে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, “বান্দরবান একটি শান্তিপ্রিয় জেলা। একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ এখানে অবস্থান করেছে তার জন্য মানুষ আতঙ্কে আছে। কিন্তু তাদের এই অবস্থানের কোনো কারণ কেউ জানেন না। আমি আপনাদের সাংবাদিকদের লেখনীর মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্য তারা কীভাবে শহরে ঢুকলো এসব সত্য বিষয়াদি তুলে ধরার জন্য অনুরোধ করছি।”

এভাবে মগপার্টির তৎপরতার উপর সংবাদ সম্মেলন করায় চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার উপর মংথেন নামে মগপার্টির কম্যান্ডার ক্ষুব্ধ হয়ে তার ফেসবুকে লিখেছেন যে, “চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার অনুরোধে শুরুবার (১৬ সেপ্টেম্বর) এমএনপি সদস্যরা বান্দরবান জেলায় প্রবেশ করে। পরের দিন শনিবার (১৭ সেপ্টম্বর) তার আশ্রয়ে বান্দরবান সদর উপজেলার রাম জাতি তংপ্রু পাড়ায় অবস্থান নেয়। এবং রবিবার (১৮ সেপ্টম্বর) রাতে ভাত খাওয়ার জন্য এমএনপি সদস্যদেরকে বান্দরবান জেলা শহরের উজানী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থানের অনুমতি দেয়। আর এখন সংবাদ সম্মেলন করে আমাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে ডাকছে।” মংথেন চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লাকে প্রশ্ন করে আরো লিখেন, “বান্দরবান জেলা শহরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দল এবং এমএন লারমা জেএসএস কীভাবে অস্ত্র নিয়ে থাকার সুযোগ পায়?”

স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, সংবাদ সম্মেলনে ক্যশৈহ্লা মগপার্টি সম্পর্কে না জানার ভান করলেও এই মগ পার্টির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা হচ্ছেন তিনি। এছাড়া সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা ও পরিচালনা করে থাকে।

তারই ফলশ্রুতিতে গত ২২ মার্চ ২০২২ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা’র বাসভবনের পাশেই মগ পার্টির ১৪ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রটির মতে, ক্যশৈহ্লা মারমার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা সেখানে অবস্থান করে। স্থানীয়দের ধারণা, মগ পার্টির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমাই মগ পার্টির সন্ত্রাসীদের সেখানে ডেকে এনেছেন এবং নিজের বাসভবনে অথবা তার আশেপাশে জায়গায় আশ্রয় দিয়েছেন।

আরো জানা যায় যে, গত ২৯ মার্চ ২০২২ সকাল ১০:০০ টায় চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার সাথে মগ পার্টির সন্ত্রাসীদের সাথে একটি গোপন বৈঠক হয়। তবে ঐ বৈঠকে আরো কারা কারা ছিলেন তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। বৈঠকে গুপ্তহত্যা ও অপহরণের পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানা যায়।

এরপর ৩০ মার্চ ২০২২ বান্দরবান শহরস্থ ডিসি অফিসের সামনে অবস্থিত ‘ফোরস্টার হোটেল’ নামে একটি আবাসিক হোটেলে মগ পার্টির ৬ সন্ত্রাসী অবস্থান করে। সেসময় চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমাই ঐ আবাসিক হোটেলে ওই সন্ত্রাসীদের যাবতীয় থাকা-খাওয়ার খরচ যোগান দেন। সেসময়ও সেনা গোয়েন্দা ডিজিএফআই ও এনএসআই এর সদস্যরা সেখানে সন্ত্রাসীদের নিরাপত্তা ও পরিচর্যার সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন।

উল্লেখ্য যে, ১৮ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪:০০ টায় মগপার্টির উক্ত ২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী সদস্যদেরকে বান্দরবান সেনা ব্রিগেডের নিয়োজিত তিনজন গোয়েন্দা সদস্যের তত্ত্বাবধানে বান্দরবান শহরের উজানী পাড়ার পাড়া কেন্দ্র স্কুলে আনা হয়। সেখানে তাদের জন্য খাওয়া-দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর ভোর ৪:৩০ টার দিকে গোয়েন্দা বাহিনীর উক্ত তিনজন সদস্যের তত্ত্বাবধানে শহরের বড়ুয়া টেক হয়ে তাম্ব্রু এলাকার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরো উল্লেখ্য যে, আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) মায়ানমারের রাখাইন (আরাকান) প্রদেশের একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী দল। একসময় আরাকানের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্দেশ্যে আলোচনা-বৈঠকের জন্য মায়ারমান সরকারের সাথে যুদ্ধ বিরতিতে অবতীর্ণ হয়। তখন দলটির সাধারণ সম্পাদকসহ অধিকাংশ নেতা-কর্মী আরাকানে চলে যায়।

ঐ সময়ে এএলপি সদস্যদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ (১৪-১৭ জনের মতো) মায়ানমারে পাড়ি না দিয়ে ভারতের মিজোরামে থেকে যায়। পরে তাদের পরিবারে খাবারসহ বিভিন্ন অভাব দেখা দিলে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বান্দরবান জেলার থানচির বলিপাড়া এলাকায় সশস্ত্রভাবে চলে আসে। পাড়াবাসী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করে দলটি। সেখান থেকে রুমা, রোয়াংছড়ি এলাকায় এসেও চাঁদাবাজি করতে থাকে। একসময় লামা, আলিকদমে গিয়ে দলটি চাঁদাবাজি করে বলে জানা গেছে।

পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নির্বাচনে তাদের পক্ষে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দ্যা ইউনিয়নের গব ও পোয়াইতু পাড়া এলাকায় এনে মোতায়েন করে। বিভিন্ন নির্বাচনে শাসকদল আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত পোয়াইতু পাড়ায় স্থায়ীভাবে ঘাঁটি গেড়ে আছে।