নৃশংসতম লংগুদু গণহত্যা: বিচারহীনতার ৩৬ বছর

হিল ভয়েস, ৪ মে ২০২৫; বিশেষ প্রতিবেদক: ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলার বাঙালিদের কতৃর্ক পাহাড়ীদের উপর কমপক্ষে ১৩টি গণহত্যা চালানো হয়। বাংলাদেশ সরকার এই গণহত্যাগুলোর একটিরও বিচার এখনও পর্যন্ত করেনি। এমনই এক নৃসংশ গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে আজকের এই দিনে যা সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম ভয়াবহতম গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার লংগুদুতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলিম সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক জুম্মদের উপর এক ভয়াবহ গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ কমপক্ষে ৩২জন জুম্ম নিহত, অন্তত ১১জন আহত এবং ৯টি গ্রামের মোট ১০১১টি ঘরবাড়ি, ৬টি বৌদ্ধ বিহার এবং ১টি প্রাথমিক ও ১টি উচ্চ বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং লুটপাট চালানো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলকে ধ্বংস এবং জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলীকরণের লক্ষ্যেই সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলার বাঙালিরা পরিকল্পিতভাবে ভয়াবহতম এই গণহত্যা ঘটিয়েছিল।

লংগুদু গণহত্যার সূত্রপাত:
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম মুসলিম সেটেলার বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হলো লংগুদু উপজেলা। একদা এই উপজেলাটি জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আশি দশকে সমতল থেকে ৪ লক্ষাধিক মুসলিম বাঙালি পুনর্বাসনের পর এটি অঞ্চলটি মুসলিম সেটেলার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। সেই মুসলিম সেটেলার বাঙালি অধ্যুষিত লংগুদু উপজেলায় ১৯৮৯ সালের ৪ মে, বিকাল ৪-৫ টা নাগাদ লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান মুসলিম সেটেলার বাঙালিদের নেতা আব্দুর রশিদ সরকার তার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। মুসলিম সেটেলার বাঙালিদের নেতা আব্দুর রশিদ সরকারের মৃত্যুর জন্য শান্তিবাহিনীকে দায়ী করা হলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন কারণ খুঁজে পায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ঠিক আড়াই ঘন্টার পর পরিকল্পিতভাবে লংগদুতে জুম্ম অধ্যুষিত ৯টি গ্রামের উপর ভয়াতম প্রতিহিংসামূলক সা¤প্রদায়িক হামলা শুরু করে মুসলিম সেটেলার বাঙালিরা। গ্রামগুলো হলো-তিনটিলা, মানিক্কিজোড় পাড়া, বাত্যা পাড়া, লংগদুর বড়াদাম, মাজন পাড়া, সনে, বামে আটারকছড়া, ডানে আটারকছড়া ও করল্যাছড়ি।

লংগুদু গণহত্যার নেতৃত্বে যারা ছিল:
মুসলিম সেটেলার নেতা আব্দুর রশিদের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিশোধ নিতে জুম্ম অধ্যুষিত ৯টি গ্রামে হামলা চালানোর জন্য পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন তৎকালীন মাইনী মুখ জোনের ১৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জাকির হোসেন। এ হামলায় স্থানীয় ভিডিপি (গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী) ও মুসলিম সেটেলার বাঙালিরা অংশ নেয়। মেজর জাকিরের নির্দেশ অনুসারে স্থানীয় ভিডিপি, মুসলিম সেটলার বাঙালিরা সন্ধ্যা ৬:১৫ ঘটিকার দিকে আক্রমণ শুরু করে। এ গণহত্যা ০৬ মে ১৯৮৯ তারিখ পর্যন্ত চলে।
মুসলিম সেটলার বাঙালিদের মধ্যে হামলায় যারা নেতৃত্ব দেন-১. ইউসুফ আলী, ইসলামাবাদ গ্রাম, সোনে এলাকা, লংগদু উপজেলা; ২.রুহুল আমীন, মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, সনে এলাকা,লংগদু উপজেলা; ৩.নুরুল ইসলাম তালুকদার,সনে এলাকা,লংগদু উপজেলা; ৪. মোহাম্মদ সিরাজ, চেয়ারম্যান, আটারকছড়া ইউনিয়ন পরিষদ,লংগদু উপজেলা।

ভয়াবহ লংগুদু গণহত্যার বিবরণ:
ভয়াবহতম লংগুদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ স্বরূপ ‘৮৯ সালের ৯ মে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়, সাবেক সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, সাবেক সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও ন্যায়ানুগ বিচার দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
লিখিত স্মারকলিপিতে তাঁরা এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা তুরে ধরেন। স্বারকলিপির বর্ণনা অনুযায়ী-‘উপজেলা সদরে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য, লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও ৩নং লংগদু মৌজার হেডম্যান অনিল বিহারী চাকমা তাঁর নিজ বাস ভবনে হামলার শিকার হন। দৈব্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের অনেকে যারা হেডম্যানের বাস ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের সবাই এই নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল­ম ইত্যাদিসহ আগ্নয়াস্ত্রের দ্বারা গুলি করে এইসব নিরীহ নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করে, হত্যা করেই হন্তক’রা ক্ষান্ত হননি। মৃতদেহ গুলো বাড়িতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন।
অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ি থেকে বের করে বাড়ির পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত ধরে পাহারা দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকে থানায় খবর দিতে এসে পরে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন খোঁজ পাননি। পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় মৃতদেহ গুলো ধর্মীয় বিধান মতো সৎকার করাও সম্ভব হয়ে উঠেনি।’

অন্যদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ বিষয়ে রিপোর্ট করেছে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ৪ মে, বিকাল ৪-৫ টা নাগাদ লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার তার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার আড়াই ঘন্টা পর লংগদুতে পাহাড়ি আদিবাসী গ্রামের উপর প্রতিহিংসা মূলক সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়। প্রতিহিংসা প্রতিশোধমূলক এ হামলায় ৩৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশু মারা যায়। তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে রিপোর্টে বলা হয়। আব্দুর রশিদ সরকারের মৃত্যুর জন্য শান্তি বাহিনীকে দায়ী করা হলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন সত্য নির্ভর যোগ্য কারন খুঁজে পায়নি।

অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়, ‘সেদিন কম করে ৬টি গ্রাম আক্রান্ত হয়, পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি, অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং খ্রিস্টানদের দুটি গির্জা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। হামলায় যাঁরা বেঁচে যান তাঁরা আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ে ও জঙ্গলে পালান এবং তাদের একটা সংখ্যাগুরু অংশ বিপদ মাথায় নিয়ে বর্ডার ক্রস করে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় পাশের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী হন।’
কোন রিপোর্টে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তথ্য উঠে আসেনি; কারণ স্থানীয় এলাকা অবরুদ্ধ ছিল এবং তৎকালীন সময়ে যেকোনো ধরনের মিছিল-আন্দোলন নিষিদ্ধ ছিল। অন্যদিকে পুরোপুরি এটা জানাও সম্ভব ছিল না কতজনকে হত্যা করা হয়েছে কারণ সেনা-মুসলিম সেটেলার বাঙালিরা অনেক লাশ গায়েব করেছিল।
সম্ভবত লংগদু গণহত্যায় সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হয়েছিল তিনটিলা গ্রামের মি.অনিল বিকাশ চাকমার বাড়িতে। তিনি ইউপি‘র সাবেক চেয়ারম্যান এবং সরকার সমর্থিত ট্রাইভেল কনভেনশনের সহসভাপতি এবং ৫নং লংগদু মৌজার হেডম্যান।মি. অনিল বিকাশ চাকমা সরকারের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক এবং সরকারের পক্ষে দাসের মত অনুগত হয়ে কাজ করতেন।
কিন্তু সরকার ও সেনা কতৃর্পক্ষ তাঁর পরিবারের সদস্যদের জগণ্যভাবে হত্যা করে এবং তাঁর ঘরকে নরকে পরিণত করে। কাকতালীয়ভাবে মি. অনিল বিকাশ চাকমা সেদিন ঘরে ছিলেন না, যখন আক্রমণ শুরু হয় তাঁ স্ত্রী পালাতে পারে নি। তাঁকে প্রথম গুলি করা হয় এবং পরে সেটলার এসে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তাঁর মতন অনেক প্রতিবেশী তাঁদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারাঁ অনেকেই নিহত এবং গুরুতর আহত হয়।
উদাহারণ-মি.মুরতি মোহন চাকমা, লংগদুর সরকারি পরিবার পরিকল্পনা অফিসের একজন কেরাণি,ত্ঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং শরীর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। তাঁর পুত্র সজল চাকমা(৯) বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয় এবং আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। জাগরণ চাকমা(১১): তিনটিলা গ্রামের বিজয়শীলের পুত্র, তাঁকে গলায় বেয়নেট বসিয়ে দেয়,পরে শরীর কেটে টুকরো টুকরো করে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। মি.ক্যয়া মং মারমা(৫৫),কক্সবাজারের হার্বাঙ এলাকার মি. হ্লা সাথোয়াই মারমার পুত্রমি.রাঙা মং মারমা,লংগদুতে ব্যবসা করতেন। তাঁরা করল্যাছড়ি বাজার থেকে ফিরছিলেন।ফেরার পথে সেটলাররা তাঁদের আটকায় এবং হত্যা করে।

অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি:
মুসলিম সেটেলার বাঙালিরা শুধু গণহত্যায় ক্ষান্ত হয়নি; তারা জুম্মদের ঘর,স্কুল ও মন্দিরের পুড়িয়ে ধ্বসংস করে দেয়। এ হামলায় জুম্মদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ—
১.ঘর ৬৬৩ টি
২.রান্না ঘর-২৪৬টি
৩.ধানের গোলা ঘর-১০২টি
৪.সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,সনে এলাকা,রাঙামাটি
৫.লংগদু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,বড়াদাম গ্রাম,লংগদু
৬.তিনটিলা বন বিহার,সেটলাররা ৭ লক্ষ থাকার মালামাল লুট করে এবং বুদ্ধ মুর্তি(থাইল্যান্ড সরকার এটি দিয়েছিল যা থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল) ধ্বংস করে।
৭.মনোরমা বৌদ্ধ বিহার,আটারকছড়া গ্রাম,বাঙালি সেটলার দ্বারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৮০,০০০ টাকা।
৮.দশবল ধর্ম রত্ন বৌদ্ধ বিহার,সনে এলাকা,সেটেলাররা একটি পিতলের নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি,হাতির দন্তে তৈরি ২টি বুদ্ধ মূর্তি লুট করে।পরে মন্দিরটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ৬০,০০০ টাকার সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৯.সনে বৌদ্ধ বিহার,সেটলাররা একটি পিতলের মূর্তি লুঠ করে এবং বিহারটি পুড়িয়ে দেয়।এতে প্রায় ৬০,০০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১০.করল্যাছড়ি বৌদ্ধ বিহার,করল্যাছড়ি,মুসলিম সেটেলাররা ৩টি পিতলের বুদ্ধ মূর্তি লুট করে,এরপর পুড়িয়ে দেয় এবং প্রায় ৫০,০০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১১.বড়াদাম বৌদ্ধ বিহার,বড়াদামে সেটলাররা বৌদ্ধ বিহারে আগুন লাগায় এবং ৩টি পিতলের মূর্তি লুট করে নিয়ে যায়।এতে প্রায় ৯০,০০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ:
ভয়াবহতম এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জুম্ম জনগন দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ গড়ে তোলে। যেমন-
১. ০৭ মে ১৯৮৯ তারিখে বর্বরোচিত এ গণহত্যার প্রতিবাদ এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে লংগুদু উপজেলার জুম্ম জনগণের বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে।
২. ০৯ মে ১৯৮৯ তারিখে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়, সাবেক সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, সাবেক সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ গণহত্যার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে।
৩. ২১ মে ১৯৮৯ তারিখে লংগুদু গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকার রাজপথে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ মৌন মিছিল বের করে এবং মিছিল সহকারে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট ছয়দফা দাবিনামাসহ স্মারকলিপি পেশ করে।
৪. ৩০মে ১৯৮৯ তারিখে পার্বত্য বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের সভাপতি বিমল বংশ মহাথেরো এবং সচিব ধর্মলংকার ভিক্ষু এর নেতৃত্বে লংগুদু হত্যাকাণ্ড এবং বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস ও অপবিত্র করার প্রতিবাদে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান করে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়াঃ
বাংলাদেশ সরকার লংগদু গণহত্যায় জড়িত মুসলিম সেটেলার বাঙালি ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অন্যদিকে লংগদু গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘটিত করার কারণে রাজা দেবাশীষ রায়কে ১১-১৪ মে ১৯৮৯ গৃহবন্দী করা হয় এবং মিডিয়াকে লংগদু গণহত্যা ও জুম্ম ছাত্র-বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রকাশ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
০৫মে ১৯৮৯, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম, রাঙ্গামাটি সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাফাত এবং কয়েকজন পাহাড়ি নেতা গৌতম কুমার দেওয়ানসহ (রাঙামাটি উপজেলা চেয়ারম্যান) তিনটিলা গ্রামে পরিদর্শনে যাস এবং সেখানে মিটিং হয়। মিটিং এ মি.দেওয়ান সেটেলার বাঙালিদের জিজ্ঞেস করেন কেন তারাঁ লংগদু এলাকায় পাহাড়িদের উপর হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। জবাবে একজন সেটেলার নেতা বলেন সরকারের নির্দেশ এবং নির্দেশনা ছাড়া এ হত্যাকান্ড হত না। তৎক্ষনাৎ ব্রিগেডিয়ার সাফাত মি. দেওয়ানের হাত থেকে মাইক কেড়ে নেন এবং এ ধরনের কিছু বন্ধ করতে বলেন।
সম্ভবত এটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল যে আব্দুস সালাম যখন লংগদু এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন, এর পরবর্তীতে ০৬মে ১৯৮৯ সালে সেটলাররা আবারো সুগুরিপাদা গ্রাম আক্রমণ করে। লংগদু গণহত্যার ফলে অধিকাংশ জুম্ম পার্শবর্তী জঙ্গলে পালিয়ে যায় এবং অনেকে মিজোরামে প্রবেশ করে। এর মধ্যে সরকার জুম্মদের জায়গায় মুসলি সেটেলার বাঙালিদের পূনর্বাসন করে।

লংগুদু গণহত্যার প্রতিবাদে দেশে বিদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হলেও এর কোন বিচার হয়নি বরং বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গণহত্যার হোতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী গণহত্যাগুলো সংঘটিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র এসব গণহত্যা ভূলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পাহাড়ের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ কখনও গণহত্যার কথা ভূলেনি এবং গণহত্যার শহীদদের আত্মত্যাগের কথা ভূলে যাবে না। পাহাড়ের নতুন প্রজম্ম শহীদদের আত্মত্যাগকে শিরোধার্য্য করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অধিকতর সামিল হবে এবং নতুন সূর্যোদয়ের আনার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করার শপথ নিবে। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না।

More From Author

+ There are no comments

Add yours