আদিবাসী খেয়াং নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ

হিল ভয়েস, ৮ মে ২০২৫, রাজশাহী: বান্দরবানের থানচি উপজেলার আদিবাসী খেয়াং নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে রাবি ও রুয়েট আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দের আয়োজনে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দ,জাতীয় আদিবাসী পরিষদ,কেন্দ্রীয় কমিটি,আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং সর্বজনের সংস্কৃতির প্রতিনিধিবৃন্দ।

সংহতি বক্তব্যে মং ক্য চিং খেয়াং বলেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাহাড়ের ইতিহাস উদঘাটন করলে আমরা এরকম অহরহ ধর্ষণের ঘটনা দেখতে পাই যার বিচার এখনো হয়নি। তিন পার্বত্য জেলায় এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিচারহীনতার কারণে ধর্ষকরা দিন দিন এ ধরনপর ঘটনা সংগঠিত করতে আরো সাহস পাচ্ছে। তিনি ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের দ্রুত চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর কাজী মামুন হায়দার তাঁর সংহতি বক্তব্যে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধর্ষণের সময় আমি পাহাড় ও সমতলকে কখনোই আলাদা করে দেখতে চাইনা। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরবর্তীতে আমাদের পুরো রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের পরেও এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। সে ঘটনারই ধারাবাহিকতায় বান্দরবানের থানচি উপজেলায় এক খেয়াং আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আপনারা সাম্প্রতিক সময়ে যদি দেখতে চান, নারী কমিশনের যারা কাজ করছেন তাদেরকে নিয়েও ভয়ংকর সব কথাবার্তা বলা হচ্ছে। তাদেরই মতে, নারীকে ধর্ষণ করা জায়েজ, নারীকে নির্যাতন করা জায়েজ, নারীর উপর অত্যাচার করা জায়েজ, তিনি এ ধরণের মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ জানান।

তিনি আরো বলেন, এটি পাহাড় কিংবা সমতলের গল্প নয়, এটি পুরো বাংলাদেশের গল্প। পুরো বাংলাদেশেই নারী রাস্তাঘাটে বের হতে পারছে না, নারী মানুষ হয়ে বাঁচতে পারছে না। তারই ধারাবাহিকতায় আজ পাহাড়ে আরেক নারীকে ধর্ষিত হতে হয়েছে। আমরা আদিবাসীদের সাথে সবসময় আছি এবং থাকবো। আমরা আরো জানতে পেরেছি যে, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদের এক মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হওয়ার পর তিনি আত্মহত্যা করেন তার বিচারও আমরা পাইনি। নারী নিয়ে কথা বলতে গেলেই একটা গোষ্ঠী ফুঁসে উঠে। তাছাড়াও নারী কমিশন বাস্তবায়ন নিয়েও কথা বলেন তিনি। আমি আজকের এ সমাবেশে আদিবাসীদের সাথে সংহতি জ্ঞাপন করচি এবং ধর্ষণকারীদের চিন্হিত করে দৃষ্টান্তমূলক শান্তির দাবি জানাচ্ছি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রাচুর্য্য চাকমা বলেন, পাহাড়ের প্রত্যেকটি ঘটনায় একটা অদৃশ্য শক্তি কাজ করে। এখন পাহাড়ি নারী তাঁর ইচ্ছেমতো জুমেও যেতে পারছে না, তাঁকে জুম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। তাহলে আদিবাসী পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তা কোথায়? পাহাড়ে সেনাশাসনের নামে যে অধিক পরিমাণ সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে সাধারণ জনগণকে হয়রানি করা হচ্ছে সেই সেনাবাহিনীরই উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ পাহাড়ি আদিবাসী নারীর এক আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে আপলোড করে। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি পাহাড়ে সেনাবাহিনীরাও এক একটা ধর্ষকের ভুমিকা পালন করে। ১৬ এপ্রিল রাঙামাটির কাউখালিতে ফাহিম কর্তৃক এক মারমা তরুণীকে নিজ বাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। তাঁরই প্রতিবাদ করতে গেলে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে শান্তিপূর্ণ মিছিলে রাষ্ট্রের প্রশাসন কর্তৃক বাঁধা প্রদান করা হয়। তিনি বলেন, ধর্ষক পুলিশ হেফাজতে কিছুদিন রাখার পর ছাড়া পেয়ে আবার সেই একই কাজ করে। প্রশাসনের দুর্বলতা ও উদাসীনতার কারণেই ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে তাঁর সংহতি বক্তব্য সমাপ্ত করেন।

সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী শামীন ত্রিপুরা তার বক্তব্যে বলেন, পাহাড় এবং সমতলে ধর্ষণ নিত্যদিনের প্রচলিত একটি ঘটনা হয়ে গিয়েছে। ধর্ষকরা বুঝতে পেরেছে যে, ধর্ষণ করলে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় না। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষকরা মনে করে যে ধর্ষণ করে কিছুই হবে না। তারা জানে, পুলিশ তাঁদের কিছুদিন ধরে নিয়ে গিয়ে আবার ছেড়ে দিবে। এর দায় একমাত্র রাষ্ট্রের আইনের রাষ্ট্রের প্রশাসনের। এ ধরণের কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা জানায়। পরবর্তীতে এরকম কিছু হলে কঠোর আন্দোলন হবে বলে হুশিয়ারী জানান। তাছাড়া তিনি কল্পনা চাকমার কথাও বলেন। তিনি বলেন, সমতল থেকে অপরাধীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। যার ফলে পার্বত্যবাসীই এর ভুক্তভোগী হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তিনি এই ধর্ষণের ঘটনার এবং ধর্ষণকারী ও হত্যার বিচার চান।

রাবির বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান শুভ তাঁর সংহতি বক্তব্যে বলেন, এ ধরণের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, জেলা পুলিশ তাঁদের প্রেস রিলিজে হত্যার কথা উল্লেখ করা হলেও কোথাও ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এই দরণের বায়াসড শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। নারী অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং নারী কমিশন করতে হবে বলেন এবং পাহাড় ও সমতলে সমান আইন প্রণয়নের কথা বলেন। সর্বোপরি ধর্ষকদের তদন্ত সহকারে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হেমব্রোম তার বক্তব্য বলেন, বাংলাদেশ সরকার কখনোই আদিবাসী বান্ধব ছিল না। সরকার পাহাড়-সমতলে একই সাথে নিপিড়নমূলক নীতি জারি রেখেছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমিতি পরিবর্তন করে সেখানে ইসলামিক সম্প্রসারণবাদ জারি রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আশি দশকের শেষের দিকে সমতল থেকে বাঙালি পূনর্বাসন করে৷ আজকে যে চিংমা খেয়াং ধর্ষণের ঘটনা তারই একটি অন্যতম প্রতিফলন হিসেবে আমরা লক্ষ্য করছি৷ তাই বাংলাদেশ সরকার যদি সত্যিকার অর্থে বহু জাতি,বহু ভাষা, বহুত্ববাদকে স্বীকার করতে চায় এবং আদিবাসী বান্ধব হিসেবে প্রমাণ করতে চায় তাহলে পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের উপর সংগঠিত সকল ধর্ষণ, গণহত্যা সহ সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার অবশ্যই করতে হবে৷

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী অন্বেষণ চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বিজয় চাকমা।

সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় এবং বিক্ষোভ মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্যারিস রোডে এসে শেষ হয়।

More From Author