ইতিহাসকে যারা অধ্যয়ন করে না, যারা শিক্ষা নিতে পারে না তারা ভবিষ্যতের পদযাত্রায় হোঁচট খায়-লোগাং গণহত্যার স্মরণসভায় পিসিপি নেতা ‍অন্তর চাকমা

হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ ১০ এপ্রিল ২০২৫ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল নিরাপত্তা বাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সংঘটিত লোগাং গণহত্যার ৩৩তম বার্ষিকীতে স্মরণসভা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত স্মরণসভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তর চাকমা, বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা, পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সজল চাকমা ও পিসিপি রাঙ্গামাটি শহর শাখার সভাপতি সুরেশ চাকমা।

পিসিপি,রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি সুমন চাকমা সভাপতিত্বে এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক মিলন চাকমার সঞ্চালনায় স্মরণসভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা। স্মরণসভার শুরুতে লোগাং গণহত্যায় নিহত ও এযাবৎকালে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

স্মরণসভায় অন্তর চাকমা বলেন, ‘আমরা বর্তমান প্রজন্ম কেউই লোগাং গণহত্যা নিজ চোখে না দেখলেও ইতিহাসের দিকে তাকালে ৩৩ বছর আগে সেনা-সেটেলার যোগসাজশে সংঘটিত লোগাং গণহত্যার বিভৎসতা, নৃশংসতা আমরা অনুভব করতে পারি। ভয়াল সেই দিনের ঘটনার স্মৃতি বারবার আমাদের শোকার্ত করে তোলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে সংঘটিত সকল গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা, জুম্ম নারী ধর্ষণ ও হত্যা, ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ —এসব মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের কোনোটিরই সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। জুম্মরা ন্যায় বিচার পাবে সেটা কল্পনাও করা যায় না। আমরা দেখেছি তৎকালীন সময়ের দেশের সংবাদমাধ্যম গুলো লোগাং গণহত্যার বিভৎসতা প্রচার করেনি। উপরন্তু সঠিক তথ্যকে আড়াল করে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। এটা নিপীড়ক রাষ্ট্রেরই এজেন্ডা।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের অতীত ইতিহাসকে গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত। ইতিহাসকে যারা অধ্যয়ন করে না, যারা শিক্ষা নিতে পারে না তারা ভবিষ্যতের পদযাত্রায় হোঁচট খায়। লোগাং গণহত্যা আমাদের সংগ্রাম করে টিকে থাকার শিক্ষা দেয়। অদূর ভবিষ্যতে শাসকগোষ্ঠী যতই নিপীড়ন চালাক তার বিপরীতে আমাদের সংগ্রাম জারি রাখতেই হবে। সুসংগঠিত সংগ্রাম করা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প পথ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত সকল গণহত্যার তাৎপর্য হলো সংগ্রামের পথ থেকে আমাদের পিছপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সজল চাকমা বলেন, ‘আমরা নিপীড়িত, শোষিত জাতি সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর সামাজিক উৎসবগুলো দরজায় কড়া নেড়ে আনন্দের বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু তার আগে পার্বত্য জনপদ ভয়াল লোগাং গণহত্যার ইতিহাসকে স্মরণে শোকে ম্রিয়মাণ হচ্ছে। শোকের আবেশে উৎসবের আমেজ অনেকটা মলিন হয়েছে।’

পিসিপি রাঙ্গামাটি শহর শাখার সভাপতি সুরেশ চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্র থেকে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য ডজনের অধিক গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল হতে দেখেছি। এসব মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের নীলনকশা তৈরী করে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী আর জুম্ম বিধ্বংসী কার্যক্রম বাস্তব রূপ দেয় সেনাবাহিনীর ও তাদের দোসর সেটেলার বাঙালিরা। অতীতে হতে বর্তমান অব্দি সেটাই চলমান রয়েছে। যুগ যুগ ধরে বিজাতীয় শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকা জুম্ম জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তম্ভিত করতে শাসকগোষ্ঠী সমস্ত রকমের নিপীড়ন চালিয়েছে। নৃশংস লোগাং গণহত্যা যার অন্যতম উদাহরণ। শাসকগোষ্ঠীর সমস্ত নিপীড়ন ছিন্ন করতে না পারা অব্দি পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নিধনযজ্ঞ চলমান থাকবে। তাই রক্তাক্ত ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে তরুণ সমাজকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে।’

হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা বলেন, ‘সেনা-সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত লোগাং গণহত্যার মতো ডজনখানেক গণহত্যার রক্তে লাল হয়েছে পাহাড় বহুবার। জুম্মদের নিজভূমি থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নীলনকশার বীজ বহুআগে বপন করা হয়েছিল পাহাড়ের বুকে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় জুম্মরা কেবল হারিয়েছে। কখনো ভূমি, কখনো বা জীবন। আজো তারা কেবল হারাচ্ছে, লুঠ করা হচ্ছে তাদের অধিকার। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বেকার অবস্থা আর বর্তমান অবস্থার মধ্য কোনো পার্থক্য নেই। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি সেটা অন্য বাস্তবতা। তবে জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।’

স্বাগত বক্তব্যে সুনীতি বিকাশ চাকমা বলেন, ‘লোগাং গণহত্যা ছিল শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জুম্ম নিধন কর্মসূচীর অংশ। এই নিধনযজ্ঞ বাস্তবায়ন হয়েছিল সেনা-সেটেলার যোগসাজশে। একটি ভিন্ন ঘটনাকে উসকে দিয়ে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা নৃশংসতম এই গনহত্যা ঘটানো হয়। ঘৃণ্য এই ঘটনার কোনোরকম সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। ভুক্তভোগীরা বিচার পাবে সেটা কল্পনা করাটাও দুঃস্বপ্ন হয়ে থেকে গেছে। শাসকগোষ্ঠীর মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া সকল গণহত্যার করুণ ইতিহাস অধ্যয়ন করে অস্তিত্বের তরে তরুণ ছাত্র সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে সুমন চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবতা নিয়ে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। লোগাং গণহত্যা সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলার কোনোটির বিচার হয়নি। পক্ষপাতদুষ্ট রাষ্ট্র এসব মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের কোনো বিচার করবে না। অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঘোষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র সমাজকে অধিকতরভাবে সামিল হতে হবে।’

স্মরণসভার সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমে আলোচনা সভা সমাপ্ত হয় এবং লোগাং গণহত্যায় শহীদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।

এছাড়াও বিভীষিকাময় লোগাং গণহত্যার ৩৩তম বার্ষিকীতে শহীদদের স্মরণে পিসিপির উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মহানগর. বাঘাইছড়িতে স্মরণসভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলেও জানা গেছে।

More From Author