হিল ভয়েস, ৮ এপ্রিল ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদন: আগামীকাল (৯ এপ্রিল ২০২৫) থেকে রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহের ঐতিহ্যবাহী সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, চাংক্রান, পাতা-২০২৫ উপলক্ষে শুরু হচ্ছে চার (৪) দিনব্যাপী সর্বজনীন অনুষ্ঠানমালা। প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও সর্বজনীন এই অনুষ্ঠানমালার উদ্যোক্তা বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, চাংক্রান, পাতা-২০২৫ উদযাপন কমিটি রাঙ্গামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম।
উদযাপন কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় বা শ্লোগান হল- ‘আদিবাসী জুম্ম জাতির অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে অধিকতর সামিল হই’।
আগামী ৯, ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল ২০২৫ চার দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন কাজল তালুকদার (কৃষিবিদ), চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, সার্কেল চীফ, চাকমা সার্কেল এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ঊষাতন তালুকদার, সাবেক সাংসদ, ২৯৯নং রাঙ্গামাটি আসন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা (অব: উপসচিব), আহ্বাযক, উদযাপন কমিটি। এছাড়াও এতে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার কর্মসূচিসমূহ নিম্নরূপ:
৯ এপ্রিল ২০২৫ (বুধবার): জমায়েত: সকাল ৯ ঘটিকা, উদ্বোধন: সকাল ৯:৩০ ঘটিকা, স্থান: রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণ, র্যালি: সকাল ১১:৩০ ঘটিকা (রাঙ্গামাটি পৌরসভা হতে রাজবাড়ি শিল্পকলা একাডেমি)।
১০ এপ্রিল ২০২৫ (বৃহস্পতিবার): আদিবাসী জুম্ম খেলাধূলা (সকাল ৯ ঘটিকা হতে বিকাল ৪ ঘটিকা পর্যন্ত), শিশু চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা (বিকাল ৩ ঘটিকা): ক গ্রুপ (শিশু শ্রেণি-২য় শ্রেণি), খ গ্রুপ (৩য় শ্রেণি-৫ম শ্রেণি) ও গ গ্রুপ (৬ষ্ঠ শ্রেণি-৯ম শ্রেণি), আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ: সন্ধ্যা ৬ ঘটিকা, স্থান-রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়াম।
১১ এপ্রিল ২০২৫ (শুক্রবার): বলি খেলা (বিকাল ৩ ঘটিকা), কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (সন্ধ্যা ৬ ঘটিকা), স্থান-রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়াম।
১২ এপ্রিল ২০২৫ (শনিবার): ফুল নিবেদন অনুষ্ঠান (সকাল ৬:৩০ ঘটিকা), জমায়েত-রাজবন বিহার স্বর্গঘর, স্থান-রাজবন বিহার পূর্বঘাট।
উদযাপন কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘বহু জাতি, বহু ভাষা ও বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীদের বৃহত্তম সামাজিক ও জাতীয় উৎসব চাকমাদের বিঝু, মারমাদের সাংগ্রাই, ত্রিপুরাদের বৈসু, গুর্খা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু, অহমিয়াদের বিহু, খুমীদের সাংক্রাই, ম্রোদের চাংক্রান, সাঁওতালদের পাতা হলেও মূল বিষয়বস্তু কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন এবং বস্তুত এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসব পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম সংস্কৃতির অন্যতম মূল উপাদান।’
এতে আরও বলা হয়- ‘ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি যতই ঘনিয়ে আসে ততই আদিবাসী জুম্মদের হৃদয়ে আনন্দ ও সম্প্রীতির শিহরণ যেমনি সৃষ্টি করে, তেমনি জুম্ম জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামগ্রিক বাস্তবতার বিবেচনায় জুম্মদের মনে জাগিয়ে দেয় উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা। নানা কারণে সামগ্রিকভাবে আদিবাসীরা আজও বিপন্নতা ও বঞ্চনামুক্ত নয়। আদিবাসীদের ভূমি ও আত্মপরিচয়ের অধিকার আজও উপেক্ষিত। সংস্কৃতির বিকাশও বাধাগ্রস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের মর্যাদা ও আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দীর্ঘ সাতাশ বছরেও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত ও কার্যকর না হওয়ার কারণে জুম্মরা এখনো শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার। ফলে উৎসবের অনাবিল আনন্দ থেকে আদিবাসী জুম্মরা এখনো বঞ্চিত।’
এতে আরও বলা হয়- ‘তবে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই উৎসব আদিবাসী জুম্মদের মাঝে জাতীয় চেতনা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতাবোধ, সম্প্রীতি, বৈষম্যহীনতা, গণতান্ত্রিকতা, উদারতা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা আর সমতাবোধকে জাগ্রত ও জোরদার করে। এটি আমাদের আদিবাসী জুম্মদের সংস্কৃতি ও জীবনের কথাই বলে। অতএব এই উৎসবকে সামনে রেখে সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান- আদিবাসী জুম্ম জাতির অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে অধিকতর সামিল হই।’
উল্লেখ্য, মূলত প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন (খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জীর ১২ ও ১৩ এপিল) এবং নববর্ষ তথা ১লা বৈশাখ (খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জীর ১৪ এপ্রিল)- এই তিন দিনকে কেন্দ্র করে এই উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। এজন্য প্রতিবছর উৎসবের নির্ধারিত দিনের বেশ কয়েকদিন পূর্ব থেকে এবং পরেও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা সংগঠন, এমনকি এলাকাবাসীর উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এবারেও বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এধরনের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।