হিল ভয়েস, ১ এপ্রিল ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলায় সেনা-মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠন মগ পার্টির পক্ষ হয়ে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত সেটেলার বাঙালি সন্ত্রাসী বিভিন্ন এলাকায় ও বাজারে বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এতে এলাকার ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ ও অসহায় হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
শফিকুল ইসলাম, সাইদুল, বেলাল, প্রান্ত ঘোষ রনিসহ অন্তত ১২ হতে ১৫ জন চিহ্নিত সেটেলার বাঙালি বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে মগ পার্টির প্রতিনিধি ও চাঁদা সংগ্রাহক হিসেবে পরিচয় দিয়ে এলাকার মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা সংগ্রহ ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে মারধর করছে এবং অনেককে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মগ পার্টির হয়ে সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক প্রকাশ্যে এহেন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে স্থানীয় সেনাবাহিনীর যোগসাজস ও মদদ রয়েছে বলে ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ। তাদের ধারণা, স্থানীয় সেনাবাহিনীও চাঁদার একটি বড় অংশ ভাগ পায়।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ২০২৪, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজস্থলীর বাঙ্গালহালিয়া এলাকায় মগ পার্টির সশস্ত্র আস্তানা গুড়িয়ে দেয় স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালি জনতা। এরপর জনতার ধাওয়া খেয়ে অস্ত্রসহ পালিয়ে যায় মগ পার্টির সদস্যরা। তাদের মধ্যে কিছু বাঙ্গালহালিয়া সেনা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় এবং কিছু সদস্য ডংনালা এলাকার দিকে পালিয়ে যায়। কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও হঠাৎ জানা যায় বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আদোমং মারমাকে অপহরণ করার ঘটনা। ১ কোটি টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যানকে মুক্তি দেয়ার কথা হলেও পরে ৭০ লক্ষ টাকায় ছেড়ে দেয়া হয় আদোমং চেয়ারম্যানকে। এর মাস খানেক আগে গাইন্দ্যা এলাকায় ঠিকাদারী কাজ করতে গিয়ে এক বাঙ্গালিকে অপহরণ করে মগ পার্টির সদস্যরা। পরবর্তীতে তাকে ফেরত দেয়নি বলে জানা যায়। সেই ঘটনায় অপহৃত আত্মীয়রা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সহযোগিতা চাইলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা দেখায়নি সে ঘটনায়। তারও আগে গাইন্দ্যার একটি বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে অপহরণ করে হত্যা করে। এছাড়া জনসংহতি সমিতির স্থানীয় বহু নেতাকর্মীকে হত্যা ও গ্রামছাড়া করে মগ পার্টির সন্ত্রাসীরা।
সম্প্রতি জানা গেছে, বিভিন্নভাবে তোপের মুখে পড়ে এবং নানা প্রশ্ন তৈরি হওয়ায় অবশেষে রাজস্থলীর পোয়াইতু পাড়া এলাকায় পুনরায় অবস্থান নিয়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে মগ পার্টিও সন্ত্রাসীরা। বিশেষ করে কিছু সেটেলার বাঙালি সন্ত্রাসী দিয়ে রাজস্থলী বাজার, ৫ নাম্বার বাজার, বাঙ্গালহালিয়া বাজার, রাইখালী বাজারসহ রাঙ্গুনিয়ার লিচুবাগান সহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজী করছে মগ পার্টি।
স্থানীয়রা জানান, শফিকুল ইসলাম, সাইদুল, বেলাল, প্রান্ত ঘোষ রনিসহ ১২ হতে ১৫ জন সেটেলার বাঙালির মাধ্যমে নাইক্যছড়া, ফুলতলি, মতিপাড়া, কাড়িগর পাড়া এবং ডংছড়ি আর্মি ক্যাম্পের পাশে অবস্থান নিয়ে চাঁদাবাজি করছে মগ পার্টি। চাঁদা দিতে না পারলে মারধর করছে তারা। সাধারণ ক্ষেত-খামারি ও সবজি বিক্রেতাও চাঁদাবাজিরর শিকার হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব চাঁদাবাজি হচ্ছে। এছাড়া কিছু উঠতি বয়সী সেটেলার বাঙালি ছেলেদের টাকার দিয়ে তাদের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করছে মগ পার্টির সদস্যরা। সেসব সেটেলার বাঙালি ছেলেরা ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় ঢুকছে। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ দিলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এতে করে এক ধরনের অস্বস্তি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে রাইখালী, ডংনালা, ফুলতলি, কারিগর পাড়া, বাঙ্গালহালিয়া, শরীয়তপুর, ৫ নাম্বার, রাজস্থলী ও নাক্যছড়া এলাকায়। মগ পার্টিসহ ঐসব সেটেলার বাঙালিদের অত্যাচার, অনাচার ও চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ সাধারণ জনগণ।
নিম্নে কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদা সংগ্রহকারীর পরিচয় দেয়া হল:
মগ পার্টির অন্যতম ভাড়াটে সন্ত্রাসী, চাঁদা ও অস্ত্র সংগ্রহকারী হচ্ছে শফিকুল ইসলাম। তার বাড়ি রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়ার ৪ নাম্বার এলাকায়। বর্তমানে তা বান্দরবানের রাজবিলা ইউনিয়নের অধীনে পড়েছে। মিতু মেম্বারের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। জানা গেছে, সে ট্রাকও চালায়। সে ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় এবং মগ পার্টি ও সেনাবাহিনীর তথ্য সংগ্রাহক হিসেবেও কাজ করে। রাজস্থলী, বাঙ্গালহালিয়া, রাইখালীর মতিপাড়া, ফুলতলী, বান্দরবান সদরের রাজবিলা ও কুহালং-এ গিয়ে ব্যবসায়ী সেজে তথ্য সংগ্রহ করে। বহু নিরীহ মানুষকে মারধর করা এবং পাহাড়ি নারী ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই শফিকুলের কাছে সবসময় ২টি পিস্তল থাকে বলে জানা যায়। মগ পার্টির সদস্যরা যখন গ্রুপ নিয়ে টহলে যায়, তখন এই শফিকুলও অস্ত্র নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়।
মগ পার্টির আরেক চাঁদা কালেক্টর সাইদুল এর বাড়ি বাঙ্গালহালিয়ার ২ নাম্বার এলাকায়। সে কোমড়ে পিস্তল গুজিয়ে ফুলতলী ও বাঙ্গালহালিয়া বাজারে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করে থাকে স্থানীয়দের অভিযোগ। অপরদিকে, মগ পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা বেলাল কাঠ ব্যবসায়ী সেজে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, মগ পার্টি ও সেনাবাহিনীর জন্য বিভিন্ন তথ্য ও চাঁদা সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে হুমকি দেয় বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং জনসংহতি সমিতিকে আঘাত করার জন্য মগ পার্টিকে জন্ম দিয়েছিল তৎকালীন বান্দরবান ৩০০ আসনের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা এবং রাঙ্গামাটি আসনের এমপি দীপংকর তালুকদার ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী। তখন থেকে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট নিয়ে চাঁদাবাজি এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের হত্যা ও হুমকিসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে মগ পার্টি।