১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক পাহাড়িদের উপর কমপক্ষে ১৩টি গণহত্যা চালানো হয়। বাংলাদেশ সরকার এই গণহত্যাগুলোর একটিরও বিচার এখনও পর্যন্ত করেনি। এমনই এক নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল মার্চের আজকের এই দিনে যা নিরাপত্তাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক সংগঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মরা যখন নিজেদের বৃহৎ সামাজিক উৎসবটি পালন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, চারদিকে যখন উৎসবের আমেজ ঠিক সেময়ই ভিডিপি—বিডিআর—সেটেলার বাঙালিরা ‘চাকমার রক্ত চাই, আল্লাহ আকবার’ ধ্বনিতে হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে পানছড়ির লোগাংয়ের গুচ্ছগ্রামে। এই হত্যাকাণ্ডে দুই শতাধিক পাহাড়ী মারা যায় ও শতাধিক আহত হয় এবং পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডে ‘বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংলান, পাতা, সাংক্রাই, সাংগ্রাইং, চাংক্রান’ উৎসবের আনন্দ শোকে পরিণত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলকে ধ্বংস এবং জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলীকরণের লক্ষ্যেই ভিডিপি—বিডিআর—সেটেলার বাঙালিরা পরিকল্পিতভাবে বর্বরোচিত এই গণহত্যা ঘটিয়েছিল।
গণহত্যার সূত্রপাত:
৩১ মে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির অনিয়মিত মুখপত্র ‘জুম্ম সংবাদ বুলেটিন’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয় তা নিয়ে প্রথমে মতভেদ ছিল। অনেকে জানায় একজন অপ্রকৃতিস্থ ছেলেসহ তিনজন সেটেলার বাঙালি গরু চড়ানোর সময় (অথবা মাছ ধরার সময়) নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করলে একজন নিহত হয়। অন্যরা শান্তিবাহিনী মেরেছে এই মর্মে লোগাং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্পে জানালো ঘটনার সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সচিব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি ও সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক মো: সাইফুল ইসলাম দিলদও বলেন— ‘গরু চড়ানোর সময় শান্তিবাহিনী নামধারী ব্যক্তিরা একজন্য বাঙালিকে হত্যা অপর দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করার পরই এই ঘটনার সূত্রপাত হয়।’ (পার্বতী ২৪— ৩০ এপ্রিল)। কিন্তু ঘটনার প্রত্যক্ষ শিকার গীতা চাকমা জানায়— ‘সেদিন আমরা ৩ জন মহিলা পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চড়াচ্ছিলাম। সেই সময় দুজন সেটেলার বাঙালি আমাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে আমার চিৎকার শুনে আমার স্বামী মঙ্গল (পার্শ্বর্বর্তী জঙ্গলে কাজ করছিল) সেটেলার বাঙালিদের বাঁধা দেয়। ফলে তাদের সাথে আমার সামীর কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে সেটেলার বাঙালিরা আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করে ও তারাও রক্তাক্ত অবস্থায় বিডিআর ক্যাম্পে ছুটে যায়। তারপরে উত্তেজিত সেটেলার বাঙালিরা সশস্ত্র ভিডিপি ও বিডিআরসহ লোগাংয়ের গুচ্ছগ্রামে আক্রমণ করে ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।’ হত্যাকাণ্ডের আরও এক প্রত্যক্ষদর্শী সরকারের গঠিত ‘গণ প্রতিরোধ কমিটি’র সভাপতি হিমাংশ্র চাকমা বলেন— ‘মাঠে কর্মরত জুম্ম নারীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে মহিলাদের আত্মরক্ষাত্মক দা—ও আঘাতে একজন যুবক নিহত হলে উত্তেজিত সেটেলার বাঙালিরা সশস্ত্র ভিডিপি ও বিডিআরসহ একচেটিয়ো গুলিবর্ষণ ও সেটেলার বাঙালিরা বর্শা, দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে গুচ্ছগ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়।’
হত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া ভীত সন্ত্রস্ত জুম্মরা আশ্রয় গ্রহণ করে পার্শ্ববর্তী হারুবিল, ধুদুকছড়া, নোয়া আদাম, পূজগাং ও পানছড়ির বিভিন্ন গ্রামে। এছাড়াও অনেকেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের করবুক, পঞ্চরাম, তাকুমবাড়ী ও লেবাছড়া শরণার্থী শিবিরেও আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে।
হত্যাকাণ্ডে যারা নেতৃত্বে দেয়:
আসন্ন বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংলান, পাতা, সাংক্রাই, সাংগ্রাইং, চাংক্রান এর আনন্দঘন উৎসবটিকে রক্তস্নাত উৎসবে পরিণত করেছিল ভিডিপি—বিডিআর ও সেটেলার বাঙালিরা। এই হত্যাকাণ্ডে যারা প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের মধ্যে ক’জন হল: (১) হাবিবুর রহমান— সুবেদার, ২৪ ব্যাটালিয়ন, বিডিআর, লোগাং ক্যাম্প, (২) সরোয়ার হোসেন— নায়েক সুবেদার, ২৪ ব্যাটালিয়ন, বিডিআর, লোগাং ক্যাম্প, (৩) কেরামত আলী— ভিডিপি কমাণ্ডার, লোগাং, (৪) সিদ্দিকুর রহমান — ভিডিপি কমাণ্ডার, লোগাং, (৫) মোহাম্মদ নূর মিঞা— আনসার, লোগাং, (৬) মো: তরু মিঞা— চেয়ারম্যান, লোগাং ইউনিয়ন, (৭) সিরাজুল ইসলাম — মেম্বার, লোগাং ইউনিয়ন, (৮) কাজী হানিফ — মেম্বার, লোগাং ইউনিয়ন (সেটেলার বাঙালি), (৯) হাবিব উল্লাহ— মেম্বার, লোগাং ইউনিয়ন (সেটেলার বাঙালি)।
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের কারণে উৎসবের আনন্দ শোকে পরিণত হয়। ১৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক—সাংবাদিক বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে শামিল হন। হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণ করা হয়।
সংবাদমাধ্যম ও সরকারি ভাষ্য ও গৃহীত উদ্যোগ:
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণমতে দুই শতাধিক জুম্ম নরনারী নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দিতে স্থানীয় সামরিক ও বেসমারিক কতৃর্পক্ষ সংবাদপত্রকে ব্যবহার করে। ১১ এপ্রিলের বাংলাদেশের সকল জাতীয় দৈনিকে শান্তিবাহিনীর হামলায় খাগড়াছড়িতে ১১জন নিহতের খবার প্রকাশিত হয়। সবার্ধিক প্রচারিত ইত্তেফাক এই খবরে শিরোনাম ছিল ‘শান্তিবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞে ১১জন নিহত, দুইশত ঘরবাড়ি ভস্মীভূত’ আর সংবাদে ছিল খাগড়াছড়িতে শান্তিবাহিনীর গুলিতে ১১জন নিহত’। টেলিগ্রাফ এর শিরোনাম ছিল— “1078 houses set on fire, Shanti Bahini Massacres 11”। স্থানীয় সাপ্তাহিক পরবর্তীতে শান্তিবাহিনীকে দায়ী করে হত্যাকাণ্ডে ১২জন নিহত ও ১৩ জন আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়।
অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১৩জন নিহত ও ১৩জন আহত হওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছে। ১১ এপ্রিল ১৯৯২ তারিখ সকালে খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ, বিডিআর সেক্টর কমাণ্ডার, পুলিশ সুপার, খাগড়াছড়ির স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান সমীরণ দেওয়ান ও খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো: সফি লোগাং গুচ্ছগ্রাম সফর করেন। সেখানে তাদেরকে ১৩টি লাশ দেখানো হয়। ব্রিগেডিয়ার আজিজ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় বিডিআর হাবিলদার শান্তিবাহিনী গুলি করে মেরেছে বলে জানায়। ব্রিগেডিয়ার আজিজ শনাক্তকৃত লাশের আত্মীয়—স্বজনকে সান্তনাস্বরূপ লাশপ্রতি ২০০ টাকা, প্রতি পরিবারকে ৫ কেজি চাউল ও ১টি লুঙ্গি প্রদান করেন। আত্মীয় স্বজনদের আকুল আবেদন সত্ত্বেও কোন লাশ ফেরত দেওয়া হয়নি। এরপর কোন ধরণের ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশগুলি তারাবন্যা ছড়ার মুখে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
হত্যাকাণ্ডের জনরোষকে ধামাচাপা দিতে ১৩ এপ্রিল পানছড়ি থানার ওসি ৬জন ভিডিপি সদস্য ও ৬ জন সেটেলার বাঙালিকে গ্রেফতার করে খাগড়াছড়িতে হাজতে চালান দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রশ্রয়ে উক্ত গ্রেফতারকৃত অপরাধীরা তিনদিন পরে ১৬ এপ্রিল বেকসুর খালাস পেয়ে পানছড়িতে ফিরে আসে। এছাড়াও লোগাং নিবাসী মন্টু মিঞা, জলিল ও মন্নান তালুকদার জানায় যে, শত শত জুম্ম হত্যা করার কৃতিত্বের জন্য গ্রেফতারকৃতদের জনপ্রতি নগত ১০ হাজার টাকা ও এক বছরের ফ্রি রেশন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
পিসিপির বিক্ষোভ, পদযাত্রা ও প্রতিবাদ:
লোগাং গুচ্ছগ্রামে জগণ্যতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। জুম্ম আদিবাসীদের জাতীয় উৎসবের পূর্ব মুহুর্তে সংগঠিত এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাই জাতীয় উৎসব জাতীয় শোকে পরিণত হয়ে যায়। জাতীয় উৎসব বর্জন করে নানা জায়গায় প্রতিবাদ জানানো হয়। এই জাতীয় উৎসবে যোগদান করতে ঢাকা থেকে যে ২৩ জন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তারা খাগড়াছড়ি সদরে পৌঁছে গেলেও বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু.. উদযাপন কমিটি উৎসব বাতিল করে দিয়ে খাগড়াছড়িতে ১২ এপ্রিল ও রাঙ্গামাটিতে ১৪ এপ্রিল শোকসভার অনুষ্ঠিত করে। উল্লিখিত নেতৃবৃন্দ শোকসভায় উপস্থিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন ।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ১৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি শহরে হাজারো ছাত্র জনতার সম্মিলনে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ১৯ এপ্রিল রাজধানী ঢাকায় এক শোক মিছিল আয়োজন করে। উক্ত মিছিলে শতাধিক পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হতে মিছিল সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবে যায়। প্রেস ক্লাবের সম্মুখে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে আবারও মিছিল সহকারে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় তেঁজগাও—এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মিছিলটি বাংলা মোটরে এসে পৌছলে পুলিশ বাঁধা প্রদান করে। সেখান থেকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পুলিশের জীপে করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে লোগাং—এর হত্যাকান্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
লোগাং—এ নিহতদের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে ২৮ এপ্রিল ১৯৯২ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে লোগাং— এর উদ্দেশ্যে মৌন পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় এই পদযাত্রা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান থেকে আগত হাজার হাজার ছাত্র জনতা অংশ গ্রহণ করে। ঢাকা থেকে বাসদ নেতা আব্দুল্লাহ সরকার এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নেতা নূর আহমেদ বকুল, রুহিন হোসেন প্রিন্স, আব্দস সাত্তার খানসহ অনেক ছাত্র নেতা ও সাংবাদিক এ পদ যাত্রায় সামিল হন। ১০ এপ্রিল লোগাং গুচ্ছগ্রামে সংঘটিত হওয়া গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ পুস্পস্তবক অর্পন করে এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। এরপর সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সভা হয়।
এর পরেরদিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে এক সভার আয়োজন করা হয়। সভায় পিসিপির নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা থেকে আগত অথিতিবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
বিশিষ্টজনদের লোগাং সফর:
বৈসুক, সাংগ্রাই, বিজু.. উৎযাপন কমিটির আমন্ত্রণে রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, লেখক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা এবং মানবাধিকার কর্মীর ২৩জনের এক প্রতিনিধি দল ১১ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে পৌঁছেন। ঢাকা থেকে উৎসবে যোগ দিতে যাওয়া রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, লেখক—সাংবাদিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যেতে চাইলে তাদের নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের বাধা দেয় পানছড়ি উপজেলার সেনাবাহিনী। প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আইনজীবী সারা হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ সহ ২৩ জন ঢাকায় ফিরে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে জানানো হয়, খাগড়াছড়ি গিয়ে আমরা স্বভাবতই ঐ অঞ্চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি ঘটনার সত্যাসত্য জানবার দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু পরের দিন ১২ই এপ্রিল লোগাং যাবার পথে পানছড়িতে আমরা বাধাপ্রাপ্ত হই এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা বলে নিরাপত্তাবাহিনী আমাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধা প্রদান করে। ফিরবার পথে এবং খাগড়াছড়িতে বহুসংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যাক্তির সাথেও আমাদের কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে।
একজন বাঙালি কিশোর নিহত হওয়ার সূত্র ধরে সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রামে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (ভিডিপি) ও আনসার বাহিনীর কিছু বাঙালি দুষ্কৃতকারীর সহযোগিতায় হামলা চালায়। চারশরও বেশি ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় এবং শিশু—নারী—বৃদ্ধসহ ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এ বর্বর গণহত্যার বর্ণনা শুনে আমরা স্তম্ভিত হই, এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এ ববর্র গণহত্যার কারণে পুরো অঞ্চলে পাহাড়ি জনগণের বার্ষিক উৎসবের সকল কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয়। আনন্দমুখর জনপদ শোক ও অশ্রুর জনপদে পরিণত হয়। ঘরছাড়া, মা হারানো, বাবা হারানো, সন্তান হারানো নিরীহ দুর্বল দরিদ্র জনগণের সঙ্গে আমরাও ক্ষুব্ধ। একই সঙ্গে আমরা ক্ষুব্ধ প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের ন্যাক্কারজনক চেষ্টায়।
বিবৃবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের এরূপ পরিস্থিতির জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য ৬টি সুপারিশমালা পেশ করা হয়। এগুলো হলো:
(১) নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত; (২) গত ২০ বছরের পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি, রাজস্ব ব্যয় ও ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ; (৩) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান; (৪) আলোচনার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন; (৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা; (৬) জুম্ম জনগণের জীবন, ভাষা, সংস্কৃতি ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা;
বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন— পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য(ন্যাপ), দিলীপ বড়ুয়া (সাম্যবাদী দল), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (লেখক) নিজামুল হক নাসির (আইনজীবী), মুস্তফা মুহাম্মদ (অধ্যাপক), সৈয়দ আলী হাশেমী (অধ্যাপক), আদিলুর রহমান খান শুভ্র (আইনজীবী), সারা হোসেন (ব্যারিস্টার), নাছির উদ্দিন (ছাত্র ইউনিয়ন), আহাদ আহম্মেদ (ছাত্র ফেডারেশন), বিপ্লব রহমান (ছাত্র ফেডারেশন)সহ আরো অনেকেই।
বিরোধী দলীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর লোগাং সফর:
লোগাং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত হত্যাকাণ্ড উদঘাটনের জন্য জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৬জন বিরোধী তিন দলীয় সংসদ সদস্যসহ ১৭ এপ্রিল লোগাং গুচ্ছগ্রাম সফর করেন। শোকার্ত জুম্ম জনগণ শেখ হাসিনাকে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দেন। বিকেলে খাগড়াছড়িতে আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দেন— কল্পরঞ্জন চাকমা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, দীপংকর তালুকদার, শাহজাহান সিরাজ, আইভি রহমান, মতিয়া চৌধুরী ও শেখ হাসিনা।
আপামর জুম্ম ছাত্র জনতা, দেশের বুদ্ধিজীবী ও শেখ হাসিনার লোগাং সফর সরকারকে এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। তাই এই হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দিতে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৭ই মে খাগড়াছড়ি সফরে আসেন। এদিন তিনি লোগাং গুচ্ছগ্রামও সফর করেন। এ উপলক্ষে সেখানে আয়োজিত সভায় তিনি লোগাং গণহত্যার জন্য সামান্য দু:খ প্রকাশ করে জুম্মদেরকে আবার গুচ্ছগ্রামে ফেরত যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর খাগড়াছড়িতে আয়োজিত জনসভায় তিনি পার্বত্য জেলা পরিষদকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর উচ্চ প্রশংসা করা মাত্রই উপস্থিত ছাত্রজনতার বিক্ষোভের সম্মুখীন হন। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমীরণ দেওয়ান বক্তৃতা দিতে উঠলেই দর্শক ও শ্রোতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন এবং মহিলারা পায়ের জুতা ও সেণ্ডেল দেখিয়ে ধিক্কার দেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যকাণ্ডের একটিরও বিচার রাষ্ট্রযন্ত্র করেনি বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গণহত্যার হোতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী গণহত্যাগুলো সংঘটিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র এসব গণহত্যা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পাহাড়ের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ কখনও গণহত্যার কথা ভুলেনি এবং গণহত্যার শহীদদের আত্মত্যাগের কথা ভূলে যাবে না। পাহাড়ের নতুন প্রজম্ম শহীদদের আত্মত্যাগকে শিরোধার্য্য করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অধিকতর সামিল হবে এবং নতুন সূর্যোদয় আনার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করার শপথ নিবে। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না।
তথ্যসূত্র: জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন নং ৭, ২য় বর্ষ, বরিবার, ৩১ মে, ১৯৯২