পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী উৎসব উপলক্ষে পিসিপি ও এইচডাব্লিউএফের শুভেচ্ছা বার্তা

হিল ভয়েস, ১২ এপ্রিল ২০২৫, রাঙ্গামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রধানতম সামাজিক ও জাতীয় উৎসব ‘বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, চাংক্রান, সাংক্রাই, সাংগ্রাইং, সাংলান, পাতা – ২০২৫’ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডাব্লিউএফ)-এর পক্ষ থেকে একটি যৌথ শুভেচ্ছা বার্তা প্রদান করা হয়েছে।

পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অন্বেষ চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক চন্দ্রিকা চাকমা স্বাক্ষরিত উক্ত বার্তায় জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকতর সামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘চৈত্র সংক্রান্তি ও নতুন বছরের আগমনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৃহত্তম এই উৎসবটিকে ম্রোরা চাংক্রান, চাকরা সাংগ্রাইং, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু, খুমিরা সাংক্রাই, খেয়াংরা সাংলান, সাঁওতালরা পাতা ও চাকমারা বিঝু নামে এই উৎসবটিকে স্বকীয় ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক আয়োজনে আনন্দমুখর ও ধর্মীয় আবহে উদযাপন করে থাকেন। ভাষাগত বৈচিত্র্য ও তারিখগত পার্থক্য থাকলেও এই উৎসবের মূল তাৎপর্য, আবেদন ও চেতনা এক ও অভিন্ন এবং বস্তুত এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসবটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যময় ও অনন্য সংস্কৃতির অন্যতম মূল উপাদান। বস্তুতপক্ষে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের মাঝে এ উৎসবের ঐতিহ্যগত ও আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। স্মরণাতীত কাল থেকে উদযাপিত হয়ে আসা এই উৎসবটি জুম্ম জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার অংশ যা তাদের পারস্পরিক ঐক্যতান ও ভ্রাতৃত্ববোধকে একইসূত্রে গেঁথে আবহমানকাল ধরে বহমান রেখেছে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবটি যতই ঘনিয়ে আসে ততই ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪টি জুম্ম জাতিসমূহের জাতীয় জীবনে যেমনি ঐক্য, সাম্য, সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দিন হিসেবে শিহরণ সৃষ্টি করে তেমনি জুম্ম জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামগ্রিক বাস্তবতার নিরিখে জুম্ম জনগণের মনে জাগিয়ে দেয় উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা। শাসকগোষ্ঠীর ক্রমাগত দমন-পীড়নের কারণে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব আজ বিপন্ন ও হুমকির সম্মুখীন। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর গত ১৮, ১৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সেনা-সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের উপর বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত এবং ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকার বুকে আদিবাসী ছাত্র-জনতার উপর সেটেলার বাঙালিদের সশস্ত্র হামলায় ১৫ জনের অধিক আহত হওয়ার ঘটনা নির্দেশ করে পাহাড় ও সমতলে কোনো জায়গায় আদিবাসী জাতিসমূহ আজ নিরাপদ নয়। এমনকি জুম্ম জনগণের আত্মপরিচয়ের অধিকার আজও চরমভাবে উপেক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীলতা ও সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। উৎসবটি উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফ থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সেটি যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে পিসিপি ও এইচডাব্লিউএফসহ আপামর জুম্ম ছাত্রসমাজ উৎসবটি উপলক্ষে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে কমপক্ষে ৫ (পাঁচ) দিন সরকারি ছুটির দাবি করা সত্ত্বেও সেটি এখনও অধরাই রয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১২-১৬ এপ্রিল পর্যন্ত (রাবিপ্রবির ক্ষেত্রে ১০-২০ এপ্রিল পর্যন্ত) ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখতে বিজ্ঞপ্তি জারি করলেও কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি নির্দেশনা না থাকায় বাকি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীরা নিজেদের গ্রাণের উৎসব পালন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

বিবৃতিতে দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে উৎসবটিকে সামনে রেখে আপামর জনগণের প্রতি জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকতর সামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট নিম্নোক্ত দাবিসমূহ উত্থাপন করা হয়-

(১) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করাসহ কমপক্ষে পাঁচ দিন ছুটি প্রদান করুন;

(২) সকল সরকারি-বেসরকারি-আধাসরকারি-স্বায়ত্বশাসিত-শিল্প কলকারখানায় কর্মরত জুম্ম কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের জন্য কমপক্ষে পাঁচ দিন ছুটি প্রদান করুন;

(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা, বিকাশ ও গবেষণার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন;

(৪) ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর নাম পরিবর্তন করুন;

(৫) আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার বিচার নিশ্চিতকল্পে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন;

(৬) দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণাপূর্বক অতিদ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

অপরদিকে, উৎসবমুখর দিনে আপামর জুম্ম জনগণের প্রতি নিম্নোক্ত আহ্বান জানানো হয়-

(১) সকল ক্ষেত্রে স্ব স্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় সমুন্নত রাখুন;

(২) জুম্ম জাতিসমূহের আন্ত:জাতিগত ভাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করুন;

(৩) সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে আনন্দমুখর পরিবেশে উৎসব পালন করুন;

(৪) জুয়া খেলাসহ অপসংস্কৃতি চর্চা থেকে বিরত থাকুন;

(৫) প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয় এমন জিনিস ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন;

(৬) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকতর সামিল হউন।

More From Author

+ There are no comments

Add yours