লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ভূমি রক্ষাকমিটির বিরুদ্ধে রাবার ইন্ডাস্ট্রির ৬ মামলা দায়ের

লামা ও আলিকদমে ভূমি জবরদখল (পর্ব-২)

হিল ভয়েস, ১৭ মার্চ ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক:লামা উপজেলার সরই এলাকার জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দা বলেন, রিংরং ম্রো ২০২২ সাল থেকে সেখানে ৪০০ একর জুম ভূমি রক্ষা আন্দোলন করে আসছেন। সে সময় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৪০০ একর জুম ভূমি নিজেদের ইজারা পাওয়ার দাবি করে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠে। পরে সেখানে বেশ কয়েকটি ঘর নির্মাণ করেন ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন।

পরে ম্রো ও ত্রিপুরা বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলা করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে একটি মামলা খালাস হয়। পরবর্তীতে পাঁচটি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছিলেন রিংরং ম্রো। তাদের ব্যবহার করা একটা ঝিরির পানিতে কীটনাশক বিষ ঢেলে দেওয়ার অভিযোগে পাড়াবাসীরা মামলা করেন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এই মামলার অভিযুক্ত কারো বিরুদ্ধেই পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো পুলিশ ভূমিদস্যু লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করে চলেছে।

রিংরং ম্রো’র ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী যোহন ম্রো অভিযোগ করে বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে সরইয়ে কোয়ান্টাম এলাকা থেকে তার বাবাকে গ্রেফতার করে একদল সাদা পোশাকের পুলিশ।

এসময় লামা সরই ভূমি রক্ষা কমিটি’র সদস্য-সচিব লাংকম ম্রো যুগ্ম আহ্বায়ক রেংয়েন ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক ফদরাম ত্রিপুরা, যুগ্ম আহ্বায়ক সংলে ম্রো, সদস্য মথি ত্রিপুরা, সদস্য রুইপাও ম্রো।

বান্দরবান জেলার লামা উপজেলাধীন সরই ইউনিয়নের ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজায় আমাদের ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ৪০০ একর জুম ভূমি রয়েছে। যা ম্রো ও ত্রিপুরারা বংশ পরম্পরায় তিন গ্রামবাসী লাংকম পাড়া (ম্রো কারবারি), জয় চন্দ্রপাড়া (ত্রিপুরা) ও রেংইয়েন পাড়ার (ম্রো) ৩৯ পরিবার ভোগদখল করে আসছি। গত ৯ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম গং ২০০ জনের অধিক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ভাড়া করে ভূমিজ সন্তান লাংকম পাড়া, জয় চন্দ্রপাড়া ও রেংয়েন পাড়াবাসীদের উক্ত জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা চালায় এবং ম্রো ও ত্রিপুরাদের লাগানো ফলদ চারা যেমন আনারস, বরই, আম, জাম, কাঠাল গাছ ও বাঁশবাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সাফ করে দেয়। এরপর ২৬ এপ্রিল ২০২২ সালে তারা ওই জমির বাগানে আগুন দিয়ে প্রাকৃতির পরিবেশসহ লাখ লাখ টাকার সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করেছে।

তিনি আরো বলেন, লামার বিস্তীর্ণ এলাকার জমি একসময় সম্পূর্ণ ম্রো ও ত্রিপুরাদের সমষ্টিগত মালিকানার অধীনে ছিল। সে সময় সেখানে পাহাড়িরা জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তখন সেখানে কোন কোম্পানি ও ব্যক্তির নামে কোন প্রতিষ্ঠান বা বহিরাগতের জমি ছিল না।

মন্নানবাগান, মকবুল উকিল বাগান, ক্লিফটন এগ্রো, মেরিডিয়ান এগ্রো, গাজী গ্রুপ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, নিজামপুর এগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড, হামেলা হোসেন ফাউন্ডেশন, পাহাড়িকা প্লানটেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমিদস্যুরা জমি লিজ নেয়। এর ফলে সেসব জমি থেকে পাহাড়িরা উচ্ছেদ হয়ে যায়। রাবার বাগান সৃজনের কারণে ১৯৮৮ সালে ফাইয়ং পাড়া এবং ঙুইন পাড়া ধ্বংস হয়।

উক্ত দুই পাড়ায় ৮০ পরিবারের অধিক পাহাড়ির বসবাস ছিল। অনুসন্ধানী তথ্য মতে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ডলুছড়ি মৌজায় ১৯৮৮-৮৯ সালে ১৬ জন শেয়ারহোল্ডারে নামে জনপ্রতি ২৫ একর করে মোট ৪০০ একর এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে একই মৌজায় ২৮ জনের নামে জনপ্রতি ২৫ একর করে মোট ৭০০ একর ও ১৯৯৪-৯৫ সালে ৪ জনের নামে ২৫ একর করে ১০০ একর জুম ভূমি বরাদ্দ নেয়। অর্থাৎ ডলুছড়ি মৌজায় মোট ৪৮ জনের নামে ১২০০ একর জমি লিজ নিয়েছিল। অপরদিকে একই ইউনিয়নের সরই মৌজায় ১৬ জন শেয়ারহোল্ডার ২৫ একর করে মোট ৪০০ একর ভূমি লিজ নেয়। অর্থাৎ লামা রাবার ইন্ড্রাষ্টিজ লিমিটেড ৪০ বছরের জন্য ৬৪ জনের নামে দুই মৌজায় (১৯৮৮-১৯৯৪) সর্বমোট ১৬০০ একর জমি লিজ নেয়।

তবে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর নামে দলিলে লিজ নেওয়া জমির পরিমাণ ১,৬০০ একর হলেও বাস্তবে তার পরিমাণ ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ একরেরও বেশি। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এত বিশাল পরিমাণ জমি নানান কায়দায় বেদখল করেও ক্ষান্ত হয়নি এবং তার জমির ক্ষুধা মেটেনি। এখন কোম্পানিটির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে পূর্ব দিকে অবস্থিত লাংকমপাড়া, জয়চন্দ্র পাড়া এবং দক্ষিণে রেংয়েন পাড়ার জমি। এই জমিতেও তারা রাবার বাগান সৃজন করতে চাইছে। লিজ চুক্তিতে ইজারা গ্রহীতাদের ২৮টি শর্ত দেওয়া হলেও কোনটিই তারা মেনে চলেনি।

রংধজন ত্রিপুরা আরো বলেন, ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুম ভূমি ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর উদ্ভূত সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে পরিষদের সদস্য মোজাম্মেল হক বাহাদুরকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ১০ মে ২০২৩ সালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং পাড়াবাসীদের সাথে কথা বলেন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা ১৯ মে ২০২৩ সালে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর সকল ইজারা বাতিল, ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরাদের জুমচাষ এবং বাগান উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান, অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেফতারসহ ৪ দফা সুপারিশ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্থায়ী কমিটি বরাবরে প্রেরণ করেন।

এরপর ২১ মে ২০২৩ সালে ৪০০ একর জমি সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে বান্দরবান জেলা প্রশাসন কর্তৃক স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মো: লুৎফর রহমানকে প্রধান করে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির উদ্যোগে লামার ৫নং সরই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে ৩৯ পরিবারকে পরিবার প্রতি ৫ একর করে জমি প্রদানের প্রস্তাব দেয়া হলে উপস্থিত গ্রামবাসী তা প্রত্যাখ্যান করেন।

সর্বশেষ গত ১৬ আগস্ট ২০২৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর সভাপতিত্বে অপর এক শুনানিতেও পূর্বের ন্যায় পরিবার প্রতি ৫ একর করে জমি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু ভূমি রক্ষা কমিটি পুনরায় এই অন্যায্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে উল্লেখ করে রংধজন ত্রিপুরা বলেন, আমাদের পেছনে যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। আমাদের বাঁচার শেষ অবলম্বন ৪০০ একর জমি রক্ষার জন্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা নেই। ভূমিদস্যুদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে হুমকি- ধমকি, মিথ্যা মামলা ও হামলার শিকার হতে হচ্ছে।

গত ১৩ জুলাই ২০২৩ সালে ভূমিদস্যু কামাল উদ্দিন, মোয়াজ্জেম হোসেন, জহির উদ্দিন গং ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রংধজন ত্রিপুরার প্রাণ নাশের উদ্দেশ্যে ডলুছড়ি হেডম্যান কার্যালয়ে তার উপর হামলা চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে ৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকতে বাধ্য হন। ভূমিদস্যুরা রেংয়েন কারবারি পাড়ায় নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালিয়ে বিহার সম্পত্তি ভাঙচুর করে এবং ২টি বুদ্ধ মুর্তি লুট করে নিয়ে যায়। ভূমিদস্যু কামাল উদ্দিন গং ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা, সদস্য সচিব লাংকম ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক রেংয়েন ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক ফদরাম ত্রিপুরা, সদস্য মথি ত্রিপুরাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে।

More From Author