বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১তম কাউন্সিল ও সম্মেলন সম্পন্ন

হিল ভয়েস, ৯ মার্চ ২০২৫, ঢাকা: “আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ে আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সামিল হোন”এই স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ তম কাউন্সিল ও সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে।

গত ৭ই জানুয়ারি ২০২৫ রোজ শুক্রবার সকাল ১১ টায় ঢাকার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে উইমেন্স ভলান্ট্যারি এসোসিয়েশন অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১তম কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় এবং ২য় অধিবেশনে নবকমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করা হয়।

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক নাঈম হাজং এর সঞ্চালনায় এবং সভাপতি অলিক মৃ’র সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এন্ড্রিউ সোলামর। আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হিরনমিত্র চাকমা, ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক উজ্জল আজিম, ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রিপন চন্দ্র বানাই, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি এ্যান্টনি রেমা,পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা , হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা এবং পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এন্ড্রিউ সোলামর তার বক্তব্যে বলেন, দেশের যেসকল অঞ্চলের আমাদের আদিবাসীরা রাজনৈতিকভাবে ও বিভিন্নভাবে পিছিয়ে আছে, তাদেরকে এই সংগঠনে যুক্ত করতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সংগ্রামে অনেক বাধা বিপত্তি আসবে। কিন্তু আমাদের আশাহত হওয়া যাবে না। দেশের সকল আদিবাসী ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী এই সংগঠনকে সামনে রেখে আদিবাসী তরুণ সমাজকে অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে জোরদার ভূমিকা পালন করতে হবে।

উজ্জল আজিম বলেন, মধুপুরের ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে নিহত হওয়া আলফ্রেড সরেনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকার বুকে একটি বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সেসময় পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নেতারা সম্মিলিতভাবে একটি ছাত্র সংগঠন গঠন করে। পৃথিবী থেকে অনেক আদিবাসী ইতোমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরাও হারিয়ে যাবো যদি আমরা এক হয়ে লড়াই-সংগ্রাম না করি। জীবনে চলার পথে যেমন বাধা বিপত্তি, উঁচু নিচু থাকে ঠিক তেমনি সংগঠনের চলার পথেও বাধা বিপত্তি আসবেই। লড়াই সংগ্রাম করে আমাদের টিকে থাকতে হবে। লড়াই ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই।

হিরন মিত্র চাকমা বলেন, আমরা যদি নিজ সমাজকে না জানি তাহলে সমাজের অসংগতিগুলো সম্পর্কে জানতে পারবো না এবং পরিবর্তন আনতে পারবো না। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান জানতে হবে। সংগঠনের অভ্যন্তরিন সম্পর্ক ও মান উন্নয়ন প্রয়োজন। আমরা যত বেশী ঐক্য হব তত বেশী দৃঢ় আন্দোলন হবে।

হরেন্দ্রনাথ সিং বলেন, মানুষের জন্মটাই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়। আদিবাসীদের জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলে যায়। বিভিন্ন বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে আদিবাসীদের এগিয়ে যেতে হবে। কতটুকু অর্জন করতে পারলাম বা ব্যর্থ হলাম সেগুলো মাপার প্রয়োজন নেই। আমাদের সকলকে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আত্মস্বীকৃতি ও আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের জন্য যা যা করা দরকার আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করতে হবে।

রিপন চন্দ্র বানাই বলেন, আদিবাসী বিষয়ক রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই জরুরি। কেননা কেন্দ্রীয় সরকার কখনো আদিবাসীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে নাই। আমাদের আদিবাসী যারা মূল ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যায় তারাও আমাদের কথা বলতে পারে না। সুতরাং আমাদের আন্দোলন আমাদেরই করতে হবে। তাই আমাদের আদিবাসী ভাই-বোনদের আরো বেশী শক্তিশালী হয়ে আন্দোলন করতে হবে, আরো বেশী জ্ঞান নিয়ে। আর সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের এক কাতারে নিয়ে এসে আন্দোলন করতে আমাদের এই প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ একটা প্লাটফর্ম হতে পারে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ বিদায়ী কমিটির পক্ষ থেকে নব কমিটির সকলকে অগ্রীম শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আমাদের সকলকে রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন হতে হবে। সংগঠন করলে সেটিকে পুরোপুরি ধারণ করতে হবে। সমগ্র আদিবাসী ছাত্র সমাজের একটি সম্মিলিত সংগঠন হলো বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। প্রত্যেকটি আদিবাসী জাতিসত্ত্বার মানুষের কাছাকাছি আমাদের যেতে হবে। তাদেরকে জানতে হবে। আমাদের নেতৃত্বের আরও বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য আমাদের প্রত্যেককে একেকজন সন্তু লারমা হতে হবে, পীরেন স্নাল হতে হবে।

আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সভাপতি ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, আদিবাসী নারীদের আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, গারো, খাসি এইসব চিন্তায় পড়ে থাকলে হবে না। কালেক্টিভ চিন্তার মাধ্যমে আদিবাসী আন্দোলনে এক হয়ে লড়তে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা বলেন, রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের সময়, সরকার পরিবর্তনের পর আদিবাসীদের উপর নানান নির্যাতন ও নিপীড়ন সংঘটিত হয়েছে। বিগত দিনগুলোতে যেভাবে সংগ্রাম করে আসছি, সামনের দিনগুলোতে এর চেয়ে বেশী পরিমানে আন্দোলন করে বাঁচতে হবে। একটা সংগঠনের কার্যক্রম সার্বিকভাবে পরিচালনার জন্য্ দক্ষতা প্রয়োজন। আর এই জন্য আমাদের রাজনৈতিক অধ্যয়ন বাড়াতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে অধিকতর সামিল হতে হবে।

এ্যান্টনি রেমা বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা অনেক। তিনি আদিবাসীদের আন্দোলনকে রিলে দৌড়ের সাথে তুলনা করে বলেন, রিলে দৌড়ে যেমন করে একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে দৌড়ে গিয়ে স্টিকটি দেওয়া হয় ঠিক তেমনি করে আমাদের আদিবাসী অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে। সেই মহান দায়িত্বকে আমাদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। পাহাড় ও সমতলের সকল আদিবাসীদের যেকোনো লড়াই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন,বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতল তথা সমগ্র আদিবাসী ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন, যেখানে নানা ধরনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সম্মিলন ঘটে। যারা নবগঠিত কমিটিতে আসছেন আপনাদের সবাইকে বলব, আমাদের রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন হতে হবে ও রাজনৈতিক জ্ঞান চর্চা করতে হবে। আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমাদের সকলকে আরও সম্মিলিত হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সংগ্রামে এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

উক্ত অনুষ্ঠানে সংহতি জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন,গারো ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম সহ অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা।

আলোচনা সভা শেষে অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি, ন যেত্রাকে সাধারণ সম্পাদক এবং শুভ্র মাহাতোকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠন করা হয়।
উক্ত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান বিদায়ী কমিটির সভাপতি অলিক মৃ।

More From Author